অযোগ্য মহসিনাকে নিয়ম ভেঙে নিয়োগ দিয়েছিলেন বুটেক্সের ড. বেলাল!
বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় (সংক্ষেপে যা বুটেক্স নামে অধিক পরিচিত) বাংলাদেশের বস্ত্র প্রকৌশল শিক্ষায় দেশের প্রথম ও একমাত্র সরকারি টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য প্রফেসর মোহাম্মদ আবুল কাশেমের মেয়াদ শেষ ইচ্ছে আগামী ১৭ ফেব্রুয়ারি। এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়টির টেক্সটাইল ইঞ্চিনিয়ারিং অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. শাহ আলিমুজ্জামান নতুন ভিসি হতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। তার বিরুদ্ধে গবেষণা চুরি করে বই লেখা এবং বুটেক্সের নিয়মনীতি ভঙ্গ করেই নিয়োগ জালিয়াতির মতো গুরুতর অভিযোগের প্রমাণ এসেছে ভোরের পাতার হাতে। বুটেক্সের অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের থাকছে আজ দ্বিতীয় পর্ব।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বুটেক্সের টেক্সটাইল ইঞ্চিনিয়ারিং অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. শাহ আলিমুজ্জামান ওরফে ড. বেলাল ২০১৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টির এ্যক্রিডাইটেড ল্যাবের পরিচালক এবং নিয়োগ যোগ্যতা যাচাই কমিটির সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তৎকালীন সময়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ বিধিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সহকারী পরিচালক (রিপোটিং) পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন উম্মে মহসিনা আছিয়া বেগমকে।
ভোরের পাতার হাতে আসা তথ্য ও প্রমাণে দেখা গেছে, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় (বুটেক্স) ২০১৭ সালের ৯ সেপ্টেম্বর শূণ্যপদে ১৩ টি পদের জন্য একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। যার স্মারক নাম্বার: বাটেবি/প্রশাঃ/২২/৬ষ্ঠ খন্ড/২০১৭/৫৯৭।
নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে ৭ নং পদ সহকারী পরিচালক (রিপোটিং) এর জন্য একটি পদে যোগ্যতা হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘‘প্রার্থীকে কোনো অনুমোদিত বিশ্ববিদ্যালয়/প্রতিষ্ঠান হতে সকল পর্যায়ে নূন্যতম ২য় শ্রেণী/বিভাগ বা ইহার সমতূল্য জিপিএ/ সিজিপিএসহ এম.এসসি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রিধারী এবং এক্রিডাইটেড ল্যাবে অফিসার বা সমমানের ১ম শ্রেণীর পদে নূন্যতম ৪ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন হতে হবে। কম্পিউটার ওয়ার্ড প্রসেসিং, এক্সেল এবং ডাটাবেস এর কাজে অভিজ্ঞ ও সক্ষম প্রার্থীদেরকে অগ্রাধিকার প্রদান করা যেতে পারে। অথবা প্রার্থীকে কোনো অনুমোদিত বিশ্ববিদ্যালয়/প্রতিষ্ঠান হতে সকল পর্যায়ে নূন্যতম ২য় শ্রেণী/বিভাগ বা ইহার সমতূল্য জিপিএ/ সিজিপিএসহ বি.এসসি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রিধারী এবং এক্রিডাইটেড ল্যাবে অফিসার বা সমমানের ১ম শ্রেণীর পদে নূন্যতম ৫ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন হতে হবে। কম্পিউটার ওয়ার্ড প্রসেসিং, এক্সেল এবং ডাটাবেস এর কাজে অভিজ্ঞ ও সক্ষম প্রার্থীদেরকে অগ্রাধিকার প্রদান করা যেতে পারে।’’
ওই নিয়োগের প্রার্থী যাচাই বাছাই করার ক্ষেত্রে প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করা বুটেক্সের টেক্সটাইল ইঞ্চিনিয়ারিং অনুষদের বর্তমান ডিন প্রফেসর ড. শাহ আলিমুজ্জামান ওরফে ড. বেলাল তৎাকলীন সময়ে তার পছন্দের প্রার্থী উম্মে মহসিনা আছিয়া বেগমকে নিয়োগ দিতে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার যেসব বিষয়গুলো উল্লেখ করেছিলেন সেগুলোর কোনটাই পরিপূর্ণভাবে পূরণ করতে পারেননি তিনি। তারপরও অনৈতিক সুবিধা নিয়ে নিয়োগ কমিটির সভাপতি ড. শাহ আলিমুজ্জামান ওরফে ড. বেলাল সেটি করিয়েছিলেন। যদিও নিয়োগ কমিটির একজন সদস্য লিখিতভাবে নোট অব ডিসেন্টে মহসিনার নিয়োগকে অবৈধ দাবি করেছিলেন। এ নিয়েও সেই সদস্যের ওপর ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন প্রফেসর ড. শাহ আলিমুজ্জামান। একক স্বেচ্ছাচারিতায় ড. বেলাল নিজে স্বাক্ষর করে মহসিনাকে যোগ্য হিসাবে চূড়ান্তভাবে নিয়োগ দেয়ার জন্য ব্যবস্থা করেছিলেন ২০১৭ সালের ১২ নভেম্বর।
বুটেক্সের একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে এবং ভোরের পাতার হাতে থাকা তথ্য ও প্রমাণ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সহকারী পরিচালক (রিপোটিং) এক্রিডাইটেড ল্যাবে অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়া উম্মে মহসিনা আছিয়া এখন এখনো কর্মরত রয়েছেন। যদিও নিয়োগ পরীক্ষীয় অংশ নেয়ার জন্য যোগ্যতার কোনোটাই পরিপূর্ণভাবে পূরণ করতে পারেননি। তিনি এম. এইচ.সি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা করেননি। সেক্ষেত্রে তিনি নিয়োগের প্রথম ক্যাটাগরিতেই বাদ পরে যান। তাই অনেকটা সুচারুভাবে অথবা দিয়ে প্রার্থীর যোগ্যতায় বি. এইচি. সি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পাশাপাশি এক্রিডাইটেড ল্যাবে অফিসার বা সমমানের ১ম শ্রেণীর পদে নূন্যতম ৫ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন হতে হবে বলে যোগ করে দিয়েছিলেন নিয়োগ যোগ্যতা যাচাই কমিটির সভাপতি প্রফেসর ড. শাহ আলিমুজ্জামান ওরফে ড. বেলাল।
কিন্তু সেখানেও শর্তপূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন ড. বেলাল ও মহসিনা গং। এক্রিডাইটেড ল্যাবে অফিসার বা সমমানের ১ম শ্রেণীর পদে নূন্যতম ৫ বছরের অভিজ্ঞতার সনদ হিসাবে উম্মে মহসিনা আছিয়া বেগম যে কোম্পানির অভিজ্ঞতাপত্রটি জমা দিয়েছিলেন, সেটি তৎকালীন সময়ে এ্যক্রিডাইটেড ল্যাবের স্বীকৃতিই পায়নি। Esquire Testing Services (BD) Ltd এর যে অভিজ্ঞতাপত্রটি জমা দিয়েছিলেন তিনি, সেটির কোনো বৈধতা নেই কারণ ল্যাবটি এ্যাক্রিডাইটেড ল্যাব ছিল না। উল্লেখ্য, নিজউটি লেখার সময় প্রতিবেদক কৌতুহলবশত ইস্কয়ার টেস্টং সার্ভিসেস (বিডি) লিমিটেডের ওয়েবসাইটে প্রবেশ করেন। (http://www.labgo.in/lab/esquire-testing-services-bd-ltd) লিংকে প্রবেশ করার সাথে সাথে সেখানে কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করার জন্য বুটেক্সের সহকারী পরিচালক (রিপোটিং) উম্মে মহসিনা আছিয়া বেগমের মোবাইল নাম্বার এবং ইমেইল দেয়া আছে যোগাযোগের জন্য।
এসব অভিযোগের বিষয়ে উম্মে মহসিনা আছিয়া বেগমকে ফোন করা হলে এ প্রতিবেদকের পরিচয় পাওয়ার সাথে সাথেই বলতে শুরু করেন, আপনারা কি যে শুরু করেছেন। এরপর কোনো প্রশ্নেরই সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি। তবে বারবার দাবি করেছেন, তার অভিজ্ঞতা সনদ দেয়া Esquire Testing Services (BD) Ltd এ্যক্রিটাইডেট কোম্পানি ছিল। তখন প্রশ্ন করা হয়, আপনি তো সেখানে ৭ বছর চাকরি করেছেন, কতসালে এ্যাক্রিটাইটেশন সার্টিফিকেট পেয়েছিল, সেটি বলতে গিয়ে বলেন, তিনি সেটা ভুলে গেছেন। এরপর কাঁচপুরে অবস্থিত ওই কোম্পানিতে ফোন করেন এ প্রতিবেদক। মহসিনার ব্যবহৃত অফিসিয়াল নাম্বার টি এখন পরিবর্তিত হয়ে যার কাছে চলে গেছে, তিনি বলেন এ্যাক্রিডাইটেশন সার্টিফিকেট কতসালে পেয়েছে কোম্পানিটি সেটা তারও জানা নেই।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে বাংলাদেশে টেক্সটাইল খাতে গবেষণার জন্য স্বীকৃত এ্যাক্রিডাইটেড ল্যাব ছিল মাত্র কয়েকটি। সেগুলোর মধ্যে ছিল না Esquire Testing Services (BD) Ltd । তখন বিএসটিআই, বুয়েট, বিজিএমই ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন এন্ড টেকনোলজির ল্যাবগুলো ছিল স্বীকৃত।
বুটেক্সের একটি সূত্র জানিয়েছে, গবেষণা চুরির দায়ে অভিযুক্ত ড. শাহ আলিমুজ্জামান বেলালের প্রত্যক্ষ মদদে নিয়মনীতি ভেঙে উম্মে মহসিনা আছিয়া বেগমকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। মূলত বুটেক্স প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তিনি এখন বুটেক্সের নতুন ভিসি হওয়ার দৌঁড়েও রয়েছেন। যদিও শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, কোনো গবেষণা চুরির দায়ে অভিযুক্ত কাউকে নতুন ভিসি প্যানেলেই নেয়া হবে না। তার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো মন্ত্রণালয় খতিয়ে দেখবে।