#নেপথ্য নায়ক প্রধান প্রকৌশলী উজ্জল মল্লিক। #মামলা তুলে নেবার জন্য প্রকৌশলীকে চাপ।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) আবার দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। গত ৭ মাস আগে নতুন চেয়ারম্যান পদে মো. আনিছুর রহমান মিঞা যোগদান করার পর অনিয়ম, দুর্নীতির মাত্রা আরো বেড়ে গেছে বলে গুঞ্জন উঠেছে। গোটা রাজউকের ‘চেইন অব কমান্ড’ও ভেঙে পড়েছে প্রকৌশলী উজ্জল মল্লিকের কারণে। তিনি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে যা খুশি তাই করছেন বলে গুঞ্জন উঠেছে রাজউকের ভবন জুড়ে।
অভিযোগ আছে, রাজউকের প্রকল্পে পিডি নিয়োগ, ভবনের প্ল্যান পাশ, অনুমোদনহীন নকশা বর্হিভুত ভবন ভাঙা, প্লট হস্তান্তর, প্লটের শ্রেণি পরিবর্তন, নকশা অনুমোদন, কর্মচারি বদলী, নিয়োগ, প্রকৌশলী পদায়ন, প্রকল্পের ঠিকাদার নিয়োগ সব কিছুই হচ্ছে এই প্রকৌশলী (উজ্জল মল্লিক) এর নির্দেশে। দুদকের অনুসন্ধানে থাকা এই প্রকৌশলীর পরামর্শমত ফাইল ‘ওয়ার্ক’ করতে গিয়ে বিপদের মুখে পড়েছেন চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমান মিয়াও। তিনি এখন উচ্চ আদালতের মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন! উজ্জল মল্লিকের বিরুদ্ধে রাজউকের ১০ হাজার কোটি টাকার একটি বৃহত্তর প্রকল্পের কাজ থেকে ১ হাজার কোটি টাকা লোপাট করাসহ অসংখ্য ‘অনিয়ম-দুর্নীতির’ অভিযোগ উঠেছে। তিনি বিদেশে হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন এমন তথ্যও প্রকাশিত হয়েছে ইতিপূর্বে গণমাধ্যমে। কিন্তু গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে ম্যানেজ করে তিনি সব অভিযোগ ধামাচাপা দিয়ে রেখেছেন অভিযোগ রয়েছে।
বদলী নিয়ে তোলপাড়: সম্প্রতি একটি বদলী ও পদায়ন আদেশকে কেন্দ্র করে রাজউকে তোলপাড় চলছে। একজন তত্বাবধায়ক প্রকৌশলীকে ঢাকা ছাড়া করানোর জন্য ঘটানো হয়েছে জঘন্য সব কান্ড। মন্ত্রণালয়কে ‘ম্যানেজ’ করে বদলী আদেশ জারির ক্ষেত্রে ভংগ করা হয়েছে রাজউকের প্রশাসনিক ‘বিধি বা রুলস’। এমন কি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের গেজেটের বিধি বিধানকেও উপেক্ষা করা হয়েছে। ‘শেষঅব্দি’ উচ্চ আদালতের আদেশকে অবমাননা করে বদলী আদেশ বাস্তবায়ণে নানা প্রকার জাল জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছে ‘রাজউক কর্তৃপক্ষ’। অনেক ক্ষেত্রে ‘ঘোড়ার আগে গাড়ি চলে যাবার মত’ ঘটনাও ঘটেছে।
জানা গেছে, প্রায় দেড় বছর আগে কমপক্ষে ৩ জন সিনিয়র প্রকৌশলীর জ্যেষ্ঠতার লংঘন করে উজ্জল মল্লিককে রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী পদে চলতি দায়িত্ব দেয় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। এই আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রীট মামলা দায়ের করেন তত্ত্ববধায়ক প্রকৌশলী মো. নুরুল ইসলাম। যেটি এখনো চুড়ান্ত শুনানীর অপেক্ষায় রয়েছে। প্রধান প্রকৌশলী (চলতি দায়িত্ব) উজ্জল মল্লিক এই রীট মামলাটি তুলে নেবার জন্য চাপ দেন তত্ত্ববধায়ক প্রকৌশলী মো. নুরুল ইসলামকে। কিন্তু তিনি কোন চাপের কাছে মাথা নত না করলে তাকে ঢাকার বাইরে বদলী করার হুমকি দেওয়া হয়। সে হুমকিতেও প্রকৌশলী নুরুল ইসলাম রীট মামলা প্রত্যাহার না করায় প্রধান প্রকৌশলী উজ্জল মল্লিক ক্ষুব্ধ হন এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রীকে ম্যানেজ করে মন্ত্রণালয় থেকে একটি বদলী আদেশ জারি করান। যার স্মারক নং ২৫.০০.০০০০.০১৯.৩১.০০৩.১৪.৬৭৬ তাং ১৫/১২/২০২২ ইং।
এই আদেশে তত্ত্ববধায়ক প্রকৌশলী মো. নুরুল ইসলামকে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনে বদলী করা হয়। বিষয়টি অবগত হয়ে প্রকৌশলী নুরুল ইসলাম মন্ত্রণালয়ের ওই আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট বেঞ্চে রীট আবেদন করে আদেশটির স্থাগিতাদেশ প্রার্থনা করেন। হাইকোর্ট বেঞ্চ রীট আবেদনটি মঞ্জুর করে গত ০৪/০১/২০২৩ তারিখে ৬ মাসের স্থগিতাদেশ প্রদান করেন। যে আদেশের কপি ও উকিল সনদ গত ০৫/০১/২০২৩ ইং তারিখে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী,সচিব ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানকে প্রদান করা হয়।
কিন্তু হাইকোর্টের এই আদেশের বিষয় জানতে পেরে রাজউক কর্তৃপক্ষ ‘ব্যাকডেটে’ (পিছনের তারিখে) গত ২৭/১২/২০২২ইং তারিখ উল্লেখ করে বদলী ও পদায়নপত্র জারি করেন। যার স্মারক নং ২৫.৩৯.০০০০.০০৯.১২.০৫০.(৬)২১.৭৯৯০। এই বদলী ও পদায়ন আদেশটি কম্পিউটারের প্রিন্টিং ‘বেসলাইনে’ একদম (নীচের দিকে) ২০২৩ সালের ৫ তারিখে প্রিন্ট অর্ডার দেখা যায়। অর্থাৎ এটি যে ‘ব্যাকডেটে’ জারি করা হয়েছে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। অতএব হাইকোর্টের আদেশ অমান্য করে তারা এই আদেশটি জারি করেছেন। ফলে তারা উচ্চ আদালতের আদেশ অবমাননার দায়ে দোষী হতে যাচ্ছেন।
এ বিষয়ে ভোরের পাতাকে জানিয়েছেন, আগামী ২/১ দিনের মধ্যেই হাই কোর্টের দ্বারস্ত হবেন ক্ষতিগ্রস্থ রীট আবেদনকারীরা।
আরো জানা গেছে, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. নুরুল ইসলামকে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় যখন বদলী আদেশ জারি করেন তখন তিনি ৩ দিনের ট্রেনিং এ রাজউক ভবন থেকে অবমুক্ত ছিলেন। এছাড়া বাংলাদেশ গেজেট রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কর্মকর্তা-কর্মচারি) সরকারি চাকরি বিধিমালা ২০১৩-এর ৮নং উপধারায় প্রেষণ ও পূর্বস্বত্ত্ব: (২) উপবিধি (৩) এ বলা আছে যে, তবে শর্ত থাকে যে, কোন কর্মচারিকে তাহার সন্মতি ব্যতিরেকে হাওলাত গ্রহণকারি সংস্থায় প্রেষণে কর্মরত থাকিবার জন্য নির্দেশ দেওয়া যাইবে না। অথচ গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় রাজউক প্রধান কার্যালয় থেকে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনে বদলীর সময়ে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. নুরুল ইসলামের কোন প্রকার মৌখিক বা লিখিত সন্মাতি গ্রহন করেনি। ফলে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ওই বদলী আদেশটি অবৈধ বলে ঘোষিত হবে।
পত্র জারি ৫ তারিখে যোগদান ৪ তারিখে: বিস্ময়কর ব্যাপারই বটে। হাইকোর্টের আদেশ অবমাননার চার্জে যাতে না পড়তে হয় সেজন্য নানা প্রকার জাল জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছে রাজউক কর্তৃপক্ষ। আর সেটি যে এভাবে ধরা পড়ে যাবেন তা তারা কল্পনাও করতে পারেনি।
ঝিলমিল প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক পদে পদায়নকৃত মোহাম্মদ মুজাফ্ফর উদ্দিনের যোগদান পত্রে দেখা যায় তিনি গত ০৪/০১/২০২৩ ইং তারিখে স্মারক নং ২৫.৩৯.০০০০.৬৬.৯৯.০০১.২১-৮৫ মোতাবেক প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব গ্রহন করেছেন। কিন্তু রাজউকের পত্র জারি শাখার রেজিষ্টার থেকে দেখা যায়, তিনি গত ০৫/০১/২০২৩ ইং তারিখে পত্রখানা নিজ স্বাক্ষরে গ্রহণ করেছেন। যার ক্রমিক নং ৭৯৯০তাং ২৭/১২/২০২২ইং। সেখানে তাহলে দেখা গেছে পত্র গ্রহনের একদিন আগেই মোহাম্মদ মোজাফ্ফর প্রকল্পের পিডি পদে যোগদান করেছেন।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে রাজউকের একাধিক কর্মকর্তারা ভোরের পাতাকে বলেছেন, উজ্জল মল্লিক এমন একজন স্যার। যার কথায় এই ভবনে সব কিছুই হয়। তিনি সব সময়ই এই ভবনের আলোচনায় থাকেন। এতেও কারণ আছে। তার হাতে শত শত কোটি টাকার কাজ এখনো চলমান। তার ইশারার বাহিরে কোন প্রকৌশলী কথা বললেই তাকে বদলী করা হয়। কারণ সবাই জানেন তার সঙ্গে মিনিস্টার স্যারের সঙ্গে ভালো সর্ম্পক।
তারা আরো বলেন, রাজউকে যত চেয়ারম্যানই এসেছেন সবাই ভালো ছিলেন। তারা চেয়েছিলেন সঠিক নিয়মে কাজ করতে। কিন্তু কি-আর করার টাকা এবং ক্ষমতার কাছে সবাই অসহায়। এই বর্তমান চেয়ারম্যানেরও আমরা কাছ থেকে যতদূর দেখছি .... তাই।
এই বিষয়ে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমান মিঞা এর সঙ্গে কথা বলতে তার দপ্তরে যোগাযোগ করা হলে মিটিং এ আছেন বলে জানানো হয় ভোরের পাতাকে। মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। খুদেবার্তা পাঠালে ফিরতি কোন জবাব দেয়নি মো. আনিছুর রহমান মিঞা।
এই বিষয়ে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এর প্রধান প্রকৌশলী উজ্জল মল্লিকের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। খুদেবার্তা পাঠালে ফিরতি কোন জবাব দেয়নি।
এ বিষয়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব নিয়োগ কাজী ওয়াছি উদ্দিন এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘রাজউকে বদলি সংক্রান্ত একটি চিঠি হাতে পেয়েছি। সেখানে আদালতের বিষয়টিও সেটা উল্লেখ করা হয়েছে আমরা তা যথাযথ পালন করবো। তাছাড়া গত ১৯ জানুয়ারি আমাদের মন্ত্রনালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব পূরবী গোলদার তার একটি চিঠিতে রাজউককে জানিয়েছেন বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য।’
এসব অভিযোগের বিষয়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ এর সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি।