বুটেক্স ভিসি হতে মরিয়া বিতর্কিত ড. আলিমুজ্জামান বেলাল!
বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় (সংক্ষেপে যা বুটেক্স নামে অধিক পরিচিত) বাংলাদেশের বস্ত্র প্রকৌশল শিক্ষায় দেশের প্রথম ও একমাত্র সরকারি টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য প্রফেসর মোহাম্মদ আবুল কাশেমের মেয়াদ শেষ ইচ্ছে আগামী ১৭ ফেব্রুয়ারি। এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়টির টেক্সটাইল ইঞ্চিনিয়ারিং অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. শাহ আলিমুজ্জামান নতুন ভিসি হতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। তার বিরুদ্ধে গবেষণা চুরি করে বই লেখা এবং বুটেক্সের নিয়মনীতি ভঙ্গ করেই নিয়োগ জালিয়াতির মতো গুরুতর অভিযোগের প্রমাণ এসেছে ভোরের পাতার হাতে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বুটেক্সের টেক্সটাইল ইঞ্চিনিয়ারিং অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. শাহ আলিমুজ্জামান ওরফে ড. বেলাল জানুয়ারি ২০০৯ সালে এবং পরবর্তীতে দ্বিতীয় সংস্করণ হিসাবে ২০১৬ সালের মে মাসে "Understanding Textiles For A Merchandiser" বইটি প্রকাশ করেন। ৬৮৪ পৃষ্ঠার গুরুত্বপূর্ণ এই বইটির বর্তমান বাজারমূল্যও ২০ মার্কিন ডলার এবং বাংলাদেশি টাকায় ১১৬০ টাকা। ইংরেজিতে লেখা ‘‘Understanding Textiles For A Merchandiser" বইটির প্রকাশক হিসাবে এল.বি গ্রাফিক্স এন্ড প্রিন্টিংয়ের নাম থাকলেও বইটির সর্বস্বত্ব লেখক ড. শাহ আলিমুজ্জামান বেলালের নামেই রয়েছে। এছাড়া। বইটির দ্বিতীয় সংস্করণের কম্পোজ এবং ডিজাইনও তিনি নিজেই করেছেন বলে লিখিত রয়েছে বইয়ের শুরুতেই। সেখানে নোট হিসাবে বড় হরফে লেখা আছে, ''No part of this book be reproduced or transmitted in any from or by any means , mechanical or electronic, including photocopying, recording, or any storage system , without permission in writing from the author."
অর্থাৎ, ‘‘Understanding Textiles For A Merchandiser" বইটির কোনো অংশ কেউ ফটোকপি বা থেকে শুরু করে কোনো ডিজাইন কেউ ব্যবহার করতে চাইলে প্রফেসর. ড. আলিমুজ্জামান বেলালের কাছ থেকে লিখিত অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু তিনি নিজেই তাঁর লেখা বইটিতে হুবুহু ডিজাইন এবং লেখা চুরি করে বসিয়েছেন বলেও নিশ্চিত হয়েছে ভোরের পাতা।
এদিকে, বইটি মুখবন্ধে ড. শাহ আলিমুজ্জামান বেলাল দেশের প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি সরকারি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম উল্লেখ করার পাশাপাশি বেশকিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম উল্লেখ করে সেখানকার শিক্ষার্থীদের জন্য বইটিকে তার মৌলিক দাবি করে খুবই প্রয়োজন পাঠ্য বলে দাবি করেন। উল্লেখ্য, আন্তজার্তিক মানসম্পন্ন বইয়ের ক্ষেত্রে অবশ্যই International Standard Book Number (আইএসবিএন) নাম্বার থাকে। কিন্তু প্রফেসর ড. শাহ আলিমুজ্জামানের বইয়ের কোথাও কোনো আইএসবিএন নাম্বারের অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায়নি।
তবে ভোরের পাতার এ প্রতিবেদকের হাতে আসা D J Spencer এর লেখা ‘‘Knitting Technology: A Comprehensive Handbook and Practical Guide’’ বইটি থেকে বুটেক্সের নতুন ভিসি মরিয়া প্র. ড. শাহ আলিমুজ্জামান অবিকল নকল/ কপি করে কমপক্ষে ২০ টি ডিজাইন এবং হুবুহু লেখা নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছেন তার প্রকাশিত বইটিতে। D J Spencer এর লেখা বইটি প্রকাশ করেছে বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা Woodhead publishing limited এবং বইটির আইএসবিএন নাম্বার (1855733331)।
ড. শাহ আলিমুজ্জামান বেলালের লেখা ‘‘Understanding Textiles For A Merchandiser" বইটির দ্বিতীয় সংস্করণের সময়ও D J Spencer এর লেখা ‘‘Knitting Technology: A Comprehensive Handbook and Practical Guide’’ বইটির ২ নম্বর পৃষ্ঠার হুবুহু ডিজাইন নিজের লেখা বইয়ের ৩২২ পৃষ্ঠায় ব্যবহার করেছেন। এভাবে ক্রমানুসারে ৮/৩২৩, ২৩/৩৩৮, ২৫/ ৩৪৩, ৩২/৩৪৪, ৩৩/৩৪৪ ব্যবহার করার পাশাপাশি একটু মৌলিকত্ব আনার উদ্দেশ্যে এলোমেলোভাবেও D J Spencer লেখা বইয়ের ৪৮ নাম্বার পৃষ্ঠা থেকে হুবুহু নকল করেছেন নিজের লেখা বইয়ের ৩২৩ পৃষ্ঠায়। পুরো বইটিতে কমপক্ষে ড. আলিমুজ্জামান ৫০ টি ডিজাইন এবং লেখা নকল করেছেন। যা গবেষণা চুরির সামিল বলেও দাবি করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। সংস্থাটির দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা যিনি গবেষণা চুরি রোধে অ্যান্টি–প্লাজিয়ারিজম সফটওয়্যার ‘টার্নিটিন’ নিয়ে কাজ করেন তিনি বলেন, একজন সম্মানিত শিক্ষকই যদি অন্যের লেখা বই থেকে হুবুহু কপি করেন, সেটা দুঃখজনক। অবশ্যই আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করবো।
উল্লেখ্য, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটে দেয়া সংজ্ঞা অনুযায়ী, অন্য কারো কাজ বা লেখা নিজের বলে চালিয়ে দেয়াকে প্লেইজারিজম বলা হয়। এটা ইচ্ছাকৃত, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কিংবা অনিচ্ছাকৃতও হতে পারে।
কেউ যদি ইচ্ছাকৃত অথবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে এ কাজ করে তাহলে সেটি শৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রফেসর, সাবেক ভিসি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস্ (বিউপি);র সাবেক উপ উপাচার্য, শিক্ষাবিদ ড. নাজমুল আহসান কলিম উল্লাহ ভোরের পাতাকে বলেন, ‘‘দেখুন আমি যখন রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছি, তখনই গবেষণা চুরি রোধে অ্যান্টি–প্লাজিয়ারিজম সফটওয়্যার ‘টার্নিটিন’ সংস্থাপনের ব্যবস্থা করেছিলাম। এতে খরচও তেমন বেশি হয় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েটসহ কয়েকটি মাত্র প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের সফটওয়্যার রয়েছে। আমার মনে হয়, সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই এ ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। তাহলে যিনি অন্যের লেখা নিজের নামে চালিয়ে দিচ্ছেন, তিনিও লজ্জিত হবেন এবং যেসব শিক্ষার্থীরা তাঁর লেখা পড়ছে তারাও জানতে পারবেন সঠিকটা। এক্ষেত্রে অবশ্যই সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে সকল দপ্তরকে আরো বেশি সজাগ থাকতে হবে। কারণ মৌলিক বিষয়বস্তু ছাড়া বই লেখার মতো ন্যাংকারজনক ঘটনা আমরা এর আগেও দেখেছি, এতে করে যারা প্রকৃত গবেষক তারাও লজ্জিত হন। তাই আমাদের এখন থেকেই ব্যবস্থা নেয়া জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।’’
উল্লেখ্য, ২০১৫ সালে অধ্যাপক হিসাবে পদোন্নতির জন্য ড. শাহ আলিমুজ্জামান বেলাল যখন আবেদন করেন, তখন একজন সিন্ডিকেট সদস্য এই বইয়ের রেফারেন্স টেনে জালিয়াতির দায়ে তাকে পদাবনতির জন্য সুপরিশ করেন। কিন্তু তিনি অনৈতিক সুবিধা দিয়ে তৎকালীন সময়ে পদোন্নতি বাগিয়ে নেন পরবর্তীতে। এ বিষয়টিও বুটেক্সের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র ভোরের পাতাকে নিশ্চিত করেছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে বুটেক্সের টেক্সটাইল ইঞ্চিনিয়ারিং অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. শাহ আলিমুজ্জামান ওরফে ড. বেলাল ভোরের পাতাকে বলেন, ‘‘Understanding Textiles For A Merchandiser" আমার মৌলিক বই। এই বইয়ের একটি ডিজাইন ও লেখা অন্য বই থেকে চুরি করি নাই। মার্কেটে আমার ১০ হাজারের বেশি বই আছে। আপনি আমার অফিসে আসেন কথা বলবো, বলেই ফোন কেটে দেন তিনি।
আগামী পর্বে: আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মহসিনাকে চাকরি দিয়েছিলেন ড. বেলাল, নেপথ্যে কি?