ঢাকার ঐতিহ্যবাহী রমনা কালী মন্দির দখলে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছে একটি অশুভ কালো সিন্ডিকেট। মা কালীর চেয়ে শক্তিশালী মনে করা এই সিন্ডিকেটের মূল হোতাদের খুঁজে পেয়েছে ভোরের পাতা। শ্রী শ্রী রমনা কালী মন্দির ও শ্রীমা আনন্দময়ী আশ্রম পরিচালনা পরিষদের কমিটির সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়াই ২০২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর সম্মেলন করার জন্য কার্ডও ছাপানো হয়েছিল। মন্দির পরিচালনা পরিষদের একাধিক সদস্য ভোরের পাতাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শ্রী শ্রী রমনা কালী মন্দির ও শ্রীমা আনন্দময়ী আশ্রমে যারা কোনোদিন অনুদান দেয়া তো দূরের কথা, ভক্তদের সাথেও যোগাযোগ রক্ষা করেন না তারাই মিলে মন্দির কমিটি ভেঙে দিয়ে নিজেদের লোকজন বসাতে সর্বোচ্চ অপচেষ্টা চালিয়েছিলেন। যদিও বর্তমান পরিচালনা পরিষদ এখনো বহাল রয়েছে। তবে ৩০ ডিসেম্বর ভুয়া সম্মেলন করার কার্ড ছাপানো হলেও সেদিনই ৮৩ সদস্যের কার্যনির্বাহী পরিষদের মধ্যে ৬৩ জনের উপস্থিতির পর ঐক্যমতের ভিত্তিতে শ্রী শ্রী রমনা কালী মন্দির ও শ্রীমা আনন্দময়ী আশ্রম পরিচালনা পরিষদের সভাপতি উৎপল সাহা এবং সাধারণ সম্পাদক সজীব বিশ্বাসের নেতৃত্বেই আগামী সম্মেলনের তারিখ ঘোষনা না হওয়া পর্যন্ত কমিটি পরিচালনা করবেন। এ সংক্রান্ত ৬৩ জনের স্বাক্ষরিত রেজুলেশনের কপিটিও ভোরের পাতার হাতে রয়েছে।
তবে, ৩০ ডিসেম্বরের বৈঠকে অনুপস্থিত কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভোরের পাতাকে নিশ্চিত করেছেন, শ্রী শ্রী রমনা কালী মন্দির ও শ্রীমা আনন্দময়ী আশ্রম পরিচালনা পরিষদের সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা থেকে শুরু করে নয়, এর আগেই এই ঐতিহ্যবাহী মন্দিরটি দখলে নিয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কাছে নিজেদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন কয়েকজন, যারা এখনো সক্রিয় রয়েছেন। তাদের মধ্যে খাদ্য মন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য, সংসদ সদস্য মৃণাল কান্তি দাস, অসীম কুমার উকিল, ড. বীরেন শিকদার, পঙ্কজ দেবনাথসহ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এ্যাড. রানা দাশগুপ্ত, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি জে এল ভৌমিক এবং ঢাকা মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি মনিন্দ্র কুমার নাথ। এছাড়া নেপথ্যে থেকে ইন্ধন দিচ্ছেন যুবলীগের একজন প্রভাবশালী নেতাও।
ভোরের পাতার হাতে থাকা অবৈধ নিমন্ত্রণ পত্রে উপরোক্ত ব্যক্তিদের নামও রয়েছে। যদিও সেখানে নামগুলোতে বানানের কিছু ভুল রয়েছে। এ বিষয়ে শ্রী শ্রী রমনা কালী মন্দির ও শ্রীমা আনন্দময়ী আশ্রম পরিচালনা পরিষদের সভাপতি উৎপল সাহা এবং সাধারণ সম্পাদক সজীব বিশ্বাস দুইজনেই এ প্রতিবেদককে নিশ্চিত করে জানিয়েছেন, যারা এই কার্ড ছাপিয়েছিল তারা কখনোই রমনা কালী মন্দিরে কোনো অনুদান তো দূরের কথা, ভক্ত হিসাবে নিয়মিত আসেন না। সম্মেলন করার দায়িত্ব আমাদের কার্যনির্বাহী কমিটির। আমাদের কমিটির ৮৩ জনের মধ্যে ৬৩ জনই এই কমিটির ওপর পূর্ণ আস্থা রেখেছেন বলেই আমরা কাজ করে যেতে পারছি। ভবিষ্যতেও আমরা ভক্তদের জন্য শ্রী শ্রী রমনা কালী মন্দির ও শ্রীমা আনন্দময়ী আশ্রম পরিচালনা পরিষদের সবাইকে নিয়ে কাজ করতে চাই। এ জন্য সরকারের সর্বোচ্চ মহলের সুদৃষ্টিও আমরা কামনা করছি। কেননা, রমনা কালী মন্দির নিয়ে কোনো ষড়যন্ত্র হলেও মা কালীও রুষ্ট হতে পারেন।
উল্লেখ্য, প্রায় ৫০০ বছর আগে বদরীনাথের যোশীমঠ থেকে গোপালগিরি নামে এক উচ্চমার্গের সন্ন্যাসী প্রথমে ঢাকায় এসে সাধন-ভজনের জন্য উপযুক্ত একটি আখড়া গড়ে তোলেন। সেখানেই আরও ২০০ বছর পরে মূল রমনা কালীমন্দিরটি নির্মাণ করেন আর এক বড় সাধু হরিচরণ গিরি। তবে পরবর্তী সময়ে এই মন্দিরের প্রধান সংস্কারকার্য ভাওয়ালের ভক্তিমতী ও দানশীলা রানি বিলাসমণি দেবীর আমলেই হয়। ১৯৭১ সালের ২৬ ও ২৭ মার্চ। এই দুটো দিন রমনা কালীমন্দিরের পবিত্র ভূমি ঘিরে পাকিস্তানি সেনারা যে বিভীষিকার রাজত্ব তৈরি করেছিল তার করুণ কাহিনী ইতিহাসের পাতায় চিরদিন লেখা থাকবে। এক তীর্থভূমি রাতারাতি পরিণত হয়েছিল বধ্যভূমিতে। রমনা কালীমন্দিরের তৎকালীন অধ্যক্ষ স্বামী পরমানন্দ গিরিসহ সেখানে উপস্থিত প্রায় ১০০ জন নারী ও পুরুষকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল পাক সেনারা। শিশুরাও রেহাই পায়নি। এই হত্যাকাণ্ডের সময় রমনা কালীমন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রম দাউ দাউ করে জ্বলেছিল। রমনা কালীমন্দিরের চূড়া ছিল ১২০ ফুট, যা বহুদূর থেকে দেখা যেত। সেটিও ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় ওই বর্বর সেনারা। পরবর্তীতে ২০০৬ সালে ভারত সরকারের উদ্যোগে ৭কোটি টাকা ব্যয় করে রমনা কালীমন্দির আবার নতুনভাবে নির্মাণ করা হয়। পুজোর্চ্চনাও শুরু হয়। তারপর ২০২১সালে স্থাপনার কাজ হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০বছর পূর্তিতে ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ তা উদ্বোধন করেন আর রমনা কালীমন্দির ফিরে পায় তার ৫ শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্য।
এছাড়া, ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ পাকিস্তানী সেনাবাহিনী রমনা কালী মন্দির কমপ্লেক্সে প্রবেশ করে এবং এক ঘন্টার মধ্যে ১০০০ জনেরও বেশি লোককে হত্যা করে। মন্দির চত্বরে আশ্রয় নেওয়া বেশ কিছু মুসলমানকেও হত্যা করা হয়। ২০০০ সাল পর্যন্ত, মন্দির ধ্বংসের প্রমাণগুলি বেঁচে থাকা এবং সাক্ষীদের মৌখিক সাক্ষ্যের উপর নির্ভর করেছিল। ২০০০ সালে, বাংলাদেশ সরকার আওয়ামী লীগ, তদন্তের জন্য একটি পাবলিক অনুসন্ধান করে। ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে চেয়ারম্যান বিচারপতি কে এম সোবহান একটি প্রাথমিক প্রতিবেদন পেশ করেন।
গণহত্যার শিকার হয়েছে এমন প্রায় ৫০জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং অন্য নিহতদের স্বজনরা হয় মৃত বা বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গেছে। রমনা কালী মন্দির হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া মানুষের জীবিত আত্মীয়দের জন্য একটি বিশ্বব্যাপী আবেদন করা হয়েছে যাতে তারা তাদের মৃত পরিবারের সদস্যদের নাম ভবিষ্যতের স্মৃতিসৌধে তালিকাভুক্ত করতে অবদান রাখে।
এ অবস্থায় ঐতিহ্যবাহী শ্রী শ্রী রমনা কালী মন্দির ও শ্রীমা আনন্দময়ী আশ্রম নিয়ে কোনো ষড়যন্ত্রকারীরা যেন ভক্তদের মনে আঘাত দিতে না পারে, সেদিকে খেয়াল রাখারও পরমর্শ দিয়েছেন নিয়মিত মন্দিরে যাওয়া সহস্রাধিক ভক্ত।