কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার ঐতিহ্যবাহী রামমোহন তমিজিয়া উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে আজ রবিবার (২৫ ডিসেম্বর) মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানে বাংলাদেশের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক টেরাকোটা ম্যুরাল উদ্বোধন করা হয়েছে। এরই মাধ্যমে কুমিল্লার কোন গ্রামে এই প্রথম মুক্তিযুদ্ধ ও ইতিহাসের উপর এই ধরনের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক টেরাকোটা মূর্যাল স্থাপিত হলো।
উক্ত বিদ্যালয়ের ৭৫ বছর পূর্তিতে প্লাটিনাম জয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের পরিকল্পনায় ৪/২০ ফুটের এই ম্যুরালটি তৈরি হয়েছে। বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বৃদ্ধির এবং মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানানোর লক্ষ্যে এই টেরাকোটা ম্যুরালটি স্থাপন করা হয়।
রামমোহন তমিজিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের ওয়ালে স্থাপিত ম্যুরালটির উদ্বোধন করেন কুমিল্লা-৭ (চান্দিনা) আসনের এমপি অধ্যাপক ড. প্রান গোপাল দত্ত এবং কুমিল্লা-৮ (বরুড়া) আসনের এমপি নাসিমুল আলম চৌধুরী। এসময় তারা মূর্যালটির ভূয়সী প্রশংসা করেন।
বিদ্যালয়ের কয়েকজন প্রাক্তন ছাত্র ও প্রবাসীদের অর্থায়নে বাংলাদেশের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এ টেরাকোটা মূর্যালটি নির্মাণে ব্যয় হয় প্রায় ২ লাখ টাকা। টেরাকোটা মূর্যালটির লে-আউট ডিজাইন করেছেন রাঢ় বাংলাদেশের শিল্পী ভাস্কর মামুন। এটি নির্মান করতে সময় লেগেছে দেড় মাস।
টেরাকোটা ম্যুরালটিতে ১৯৪৭ সালের দেশভাগ, ৫২'র ভাষা আন্দোলন, ৬৯'র গনঅভুত্থান, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, মুক্তিযুদ্ধ ও পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের দৃশ্য ফুটে উঠেছে।
১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশে দুইশ বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান হয় এবং ভারতীয় উপমহাদেশের অভিন্ন ভূখণ্ড ভেঙ্গে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্টি হয় ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি দেশ। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান (পূর্ব বাংলা) এবং পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান নামের রাষ্ট্র।
দেশ শুরু থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শোষণের কবলে পড়ে পূর্ব বাংলা। প্রথমেই আঘাত আসে আমাদের মাতৃভাষা বাংলার উপর। পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার প্রতিবাদে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তার আশেপাশের এলাকায় ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করলে পুলিশের গুলিতে সালাম, বরকত, জব্বার সহ আরো অনেকে শহীদ হন। শহীদদের তাজা রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়। অতঃপর শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।
১৯৬৯ সালে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে দেশব্যাপী গণঅভ্যুত্থান শুরু হয়। ৬৯'র গণঅভ্যুত্থানে পুলিশের গুলিতে ছাত্র আসাদ এবং সার্জেন্ট জহুরুল হক শহীদ হন।
১৯৭১ সালে ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৮ মিনিটব্যাপী একটি কালজয়ী ভাষণ দেন। সেখানেই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।” বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানী সেনাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কৌশলে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করে এবং যুদ্ধ পরিচালনার সুবিধার্থে সারা বাংলাদেশকে এগারোটি সেক্টরে বিভক্ত করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। লাখ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম ও শহীদদের রক্তের বিনিময়ে নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী আত্মসমর্পণ করে। এভাবেই আমাদের বিজয় অর্জিত হয় এবং অভ্যুদয় হয় লাল সবুজের পতাকা সম্বলিত স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের।