‘আমার স্বামীকে হত্যার আগে ফারদিন হত্যায় জড়িত থাকার কথা বলা হয়েছিল। এখন ডিবি ও র্যাব বলছে, ফারদিন আত্মহত্যা করেছে। তাহলে আমার স্বামীকে কেন গুলি করে মারলো? তার বিরুদ্ধে অন্য কোনও অভিযোগ থাকলে আইনের মাধ্যমে বিচার করতো; কিন্তু তাকে র্যাব এভাবে হত্যা করতে পারে না। আমি এই হত্যার বিচার চাই। তাকে এভাবে হত্যার অধিকার র্যাবের নেই। র্যাবের অনেক বড় বড় কর্মকর্তা রয়েছেন; আমার স্বামীকে হত্যার ঘটনায় তারা কোনও পদক্ষেপ নেননি। তাহলে কার কাছে বিচার চাইবো।’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে এসব কথা বলেছেন নারায়ণগঞ্জের চনপাড়া এলাকার রাশেদুল ইসলাম শাহীন ওরফে সিটি শাহীনের স্ত্রী রোকেয়া আক্তার ইতি। গত ১০ নভেম্বর র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন শাহীন।
চনপাড়া এলাকার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের দোতলা বাড়িতে দুই ছেলেকে নিয়ে থাকেন ইতি। জীবনের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে এবং অজ্ঞাত হুমকির কারণে স্বামী হত্যার ঘটনায় মামলা করতে ভয় পাচ্ছেন তিনি।
আমার স্বামীকে বিনাদোষে হত্যা করা হয়েছে দাবি করে ইতি বলেন, ‘ধরে নিলাম স্বামী অপরাধী ছিলেন, তাই বলে হত্যা করবে? জানি বিচার পাবো না। তাই আল্লাহর কাছে বিচার দিয়েছি, আল্লাহ তাদের বিচার করবে। আমি মামলা করবো না। কার বিরুদ্ধে কি বলবো, যাদের বিরুদ্ধে বলবো তারা আমাকেও মেরে ফেলবে। আমাকে র্যাব দিয়ে ধরিয়ে চালান দিয়ে দেবে। মামলা করে কই যাবো, আমার কোনও অভিভাবক নেই। কাজেই মামলা করে এখানে টিকে থাকতে পারবো না। আমার দুই ভাই আছে। তাদের বিরুদ্ধেও মিথ্যা মামলা করেছে, যাতে এলাকায় থাকতে না পারে। এ অবস্থায় স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে কোথায় মামলা করবো। তখন আমার জীবনের নিরাপত্তা দেবে কে?’
স্বামী হত্যার ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ইতি বলেন, ‘প্রথমে বলা হয়েছিল বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে, পরে বলা হয়েছে গোলাগুলিতে মারা গেছে। আসলে ওসব কিছুই ঘটেনি। ওই দিন র্যাবের সঙ্গে কেউ গোলাগুলি করে নাই, র্যাবের কেউ আহত হয় নাই। সেদিন শাহীন গোলাগুলি করবেন কীভাবে, তিনি সেখানে একা ছিলেন। ঘটনার দিন সকালে ঘুম থেকে উঠলে শাহীনকে ফোন করে চনপাড়া বালুর মাঠে ডেকে নেন শাহাবুদ্দিন (স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা)। লুঙ্গি পরে বাসা থেকে বের হয়ে যান। বালুর মাঠে পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পর খবর পাই র্যাব তাকে গুলি করেছে। প্রথমে শাহীনের দুই পায়ে গুলি করেছে। পরে টেনেহিঁচড়ে জামদানি হাউজের কাছে একটি গাড়িতে নিয়ে আবারও গুলি করেছে। গাড়ি থেকে নামিয়ে আনার সময় এক লোক ঘটনার ভিডিও করেছেন। ওই ভিডিও সিটি শাহীন নামে ফেসবুক আইডি থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করা হয়েছে।’
রাজনৈতিক পদের দ্বন্দ্বের জেরে শাহীনকে হত্যা করা হয়েছে দাবি করে ইতি বলেন, ‘আমার স্বামী আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতেন। ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ চেয়েছিলেন। সেই পদ নিয়ে গেছেন চনপাড়া শেখ রাসেল নগর ইউনিয়নের বর্তমান স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি এস এম শফিকুল ইসলাম জাহিদ ও সাধারণ সম্পাদক আবুবকর সিদ্দিক। এ নিয়ে তাদের সঙ্গে আমার স্বামীর দ্বন্দ্ব ছিল। ঘটনার কয়েকদিন আগে শফিকুলের সঙ্গে ঝগড়াও হয়েছিল। এরপর থেকে শুনতেছিলাম, স্বামীকে তুলে নিয়ে র্যাব দিয়ে মেরে ফেলবে তারা, পরে তাই ঘটেছে।’
চনপাড়ার আরেক আওয়ামী লীগ নেতা শাহাবুদ্দিনের সঙ্গে শাহীনের দ্বন্দ্ব ছিল জানিয়ে ইতি বলেন, ‘দ্বন্দ্ব থাকার পরও সেদিন শাহাবুদ্দিনের ডাকে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন শাহীন। তাকে হত্যার কয়েকদিন পর শাহাবুদ্দিন ও শফিকুলের লোকজন দলবেঁধে আমার বাড়ির গেটে এসেছিলেন। গেটে তালা থাকায় ভেতরে ঢুকতে পারেননি। ওই রাতে থানায় ফোন করে পুলিশকে পাইনি। পরে রূপগঞ্জ থানা পুলিশকে জানিয়েছি। সেদিন শাহাবুদ্দিন ও শফিকুলের লোকজন আমার পরিচিত লোকজনের সামনে হুমকি দিয়ে গেছেন, বাড়াবাড়ি করলে আমাকেও মাদক দিয়ে চালান দেবে বলেছেন। এখন তাদের ভয়ে ঘরের বাইরে যেতে পারি না।’
ইতি বলেন, ‘শাহীনকে হত্যার পাঁচ দিন পর শফিকুল আমাকে মারধর করতে এসেছিলেন। এ ঘটনায় থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। এখনও কোনও ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ।’
ফারদিন হত্যার ঘটনায় শাহীনের অনুসারীদের আটকের কথা উল্লেখ করে ইতি আরও বলেন, ‘ফারদিন ইস্যুতে রায়হান, শাওন ও রবিনকে ধরে নিয়ে যায় র্যাব-১। ২০ দিন ধরে তাদের কোনও খবর ছিল না। দুদিন আগে তাদেরকে রূপগঞ্জ থানায় চালান দিয়েছে র্যাব। তাদের অপরাধ ছিল শাহীনের সঙ্গে চলাফেরা করতো। তখন র্যাব বলেছিল, শাহীন ও তার এসব অনুসারী নাকি ফারদিনকে মারধর করেছে। কিন্তু এখন র্যাব বলছে, ফারদিন আত্মহত্যা করেছে। তাহলে আমার স্বামীকে কেন হত্যা করলো? তার অনুসারীদের কেন নিয়ে গেলো?’
মাদকের সঙ্গে শাহীনের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করে ইতি বলেন, ‘অনেকে বলে শাহীন মাদকের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু মাদক ব্যবসা করলে অর্থ-সম্পদ কোথায়? এই বাড়িটা আমার বাবা-মা কিনে দিয়েছেন। তার কোনও সম্পদ নেই। শাহীন চনপাড়া মাদক নির্মূল কমিটির সদস্য সচিব ছিলেন।’
শাহীনের বিরুদ্ধে মামলা প্রসঙ্গে ইতি বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ে স্বামীর বিরুদ্ধে সাতটি মামলা করেছে পুলিশ। চনপাড়ায় মারামারির ঘটনা ঘটলে, কেউ মারা গেলে শাহীনের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হতো। মূলত তাকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে এসব মামলা দেওয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে মাদকের কোনও মামলা ছিল না। অথচ হত্যার পর র্যাব বললো, তার বিরুদ্ধে নাকি ২৩টি মামলা।’
আমার সন্তানকে কী কারণে মারলো প্রশ্ন রেখে শাহীনের মা শামসুন নাহার বলেন, ‘ছেলেটাকে এভাবে না মেরে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিতো। অন্তত ছেলের মুখ দেখতে পারতাম। আমার ছেলে এমন কোনও অন্যায় করে নাই যে, তাকে গুলি করে মেরে ফেলতে হবে। আমার সন্তানকে কী কারণে মারলো তারা? এখন তার দুই সন্তান কাকে বাবা বলে ডাকবে?’
চনপাড়া এলাকার কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চনপাড়ায় প্রকাশ্যে মাদক বেচাকেনা হতো। মাদক বেচাকেনা ঘিরে একটি সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে উঠেছে। এই বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করতেন প্যানেল চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য বজলুর রহমান। বজলুর অনুসারী ছিলেন শাহীন, জয়নাল আবেদীন ও রাজু আহমেদ ওরফে রাজা বাহিনী। এর মধ্যে শাহীন ও রাজা একসঙ্গে চলাফেরা করতেন। গত কয়েক বছর বজলুর নেতৃত্বে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ করেছেন তারা। এর ধারাবাহিকতায় শাহীনকে স্বেচ্ছাসেবক লীগের পদ পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেন বজলুর রহমান। তখন চনপাড়া শেখ রাসেল নগর ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি হতে চান রাজু আহমেদ ওরফে রাজা এবং ওই কমিটির সাধারণ সম্পাদক হতে চান শাহীন।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে রূপগঞ্জ থানা ছাত্রলীগের এক শীর্ষ নেতা বলেছেন, ‘শাহীন হত্যাকাণ্ডের কয়েক মাস আগে চনপাড়া শেখ রাসেল নগর ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের কমিটি গঠন হয়েছে। ওই কমিটির সভাপতি হন এস এম শফিকুল ইসলাম জাহিদ এবং সাধারণ সম্পাদক হন আবুবকর সিদ্দিক। শাহীন ওই কমিটির সাধারণ সম্পাদক পদ চেয়েছিলেন। এ নিয়ে শাহীন ও শফিকুলের মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়। শাহীন সরাসরি মাদকের সঙ্গে জড়িত না থাকলেও মাসোয়ারা পেতেন।’
ফারদিনের মৃত্যুর ঘটনায় গত ১৮ নভেম্বর প্যানেল চেয়ারম্যান বজলুর রহমান ও এরপর রাজু আহমেদ ওরফে রাজাকে গ্রেফতার করে র্যাব। তারা কারাগারে থাকায় এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। এমনকি এ বিষয়ে কোনও কথা বলতে রাজি হননি বজলুর রহমানের স্ত্রী।
তবে শাহীনের সঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন চনপাড়া শেখ রাসেল নগর ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি এস এম শফিকুল ইসলাম জাহিদ। তিনি বলেন, ‘শাহীন সন্ত্রাসী ছিল। আরেক সন্ত্রাসী আনোয়ার মাঝির শিষ্য ছিল। পরবর্তীতে চনপাড়া এলাকার নানা অপকর্মের গডফাদার বজলুর রহমানের নেতৃত্বে চলতো শাহীন। শাহীন ছিল বজলুর অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহযোগী। তবে স্বেচ্ছাসেবক লীগের কর্মী ছিল না। তার সঙ্গে রাজনৈতিক পদ নিয়ে বিরোধের প্রশ্নই আসে না। বজলুর মেম্বারের নির্দেশে নানা অপকর্ম করতো। বজলুর মাদক ব্যবসা আমরা বন্ধ করেছি। শাহীনের অনুসারী শাওন এলাকার চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী। কয়েকবার র্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছে। আরেক অনুসারী রায়হানের মাদক স্পট রয়েছে চনপাড়ায়।’
শাহীনের স্ত্রীকে হুমকি দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘শাহীনের স্ত্রী মিথ্যা অভিযোগে থানায় জিডি করেছেন। নিহত হওয়ার কিছুদিন আগে র্যাবের সঙ্গে শাহীনের লোকজনের সংঘর্ষ হয়েছিল। এরপর থেকে ওই এলাকায় অপরিচিত কেউ প্রবেশ করলে তাকে মারধর করতেন শাহীনের লোকজন। ফলে ফারদিন হত্যাকাণ্ড তারাই ঘটাতে পারে আমরা ধারণা করেছিলাম। যদিও পরে র্যাব-ডিবি জানিয়েছে এটি আত্মহত্যা।’
তবে শাহীন আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতেন বলে জানিয়েছেন কায়েতপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জাহেদ আলী। তিনি বলেন, ‘শাহীন আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতেন। তবে কোনও পদে ছিলেন না। বজলুর মেম্বারের অনুসারী ছিলেন। তবে মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকার বিষয়টি আমার জানা নেই।’
প্রসঙ্গত, গত ১০ নভেম্বর দুপুরে র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন রাশেদুল ইসলাম শাহীন। এ ঘটনার পর র্যাব-১-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আব্দুল্লাহ আল মোমেন বলেছিলেন, ‘মুগদা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শাহীনের মৃত্যু হয়। হত্যা, ডাকাতি ও মাদকসহ ২৩ মামলার আসামি ছিলেন শাহীন। তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। এর আগেও তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা করা হয়েছিল।’ তবে সম্প্রতি ফারদিন হত্যার বিষয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে ডিবি পুলিশ ও র্যাব। হতাশার কারণে ফারদিন আত্মহত্যা করেছেন বলে জানায় তারা।
গত ৪ নভেম্বর থেকে নিখোঁজ ছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী ফারদিন নূর পরশ (২৪)। ৫ নভেম্বর রাজধানীর রামপুরা থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন তার বাবা কাজী নূর উদ্দিন। নিখোঁজের দুদিন পর গত ৭ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টার দিকে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ফারদিনের মরদেহ উদ্ধার করে নৌ-পুলিশ।