টাইব্রেকারে চতুর্থ গোলের সঙ্গে সঙ্গেই লুসাইল স্টেডিয়াম যেন ফেটে পড়ল উল্লাসে। কাতারের লুসাইল স্টেডিয়াম রূপ নিলো আর্জেন্টিনার বুয়েন্স আয়ার্সে। সমর্থকদের কোলাহলে তখন কানে তালা লেগে যাওয়ার যোগাড়। এ চিৎকার যেন আকাশই ছুঁয়ে ফেলতে চাইল। এমন উল্লাস হবেই বা না কেন! এই দিনটির জন্য যে আর্জেন্টাইনদের অপেক্ষা ছিল ৩৬ বছরের! ম্যারাডোনার পর মেসি যে আর্জেন্টিনাকে শিরোপা এনে দিলেন!
ফ্রান্সকে হারিয়ে কাতার বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা। প্রথমবারের মত ট্রফি ছুঁয়ে দেখলেন লিওনেল মেসি। ৩৬ বছর পর বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন আলভিসেলেস্তেরা। দিয়েগো ম্যারাডোনার পর বিশ্বকাপ ট্রফি উঁচু করে ধরলেন আর্জেন্টিনা অধিনায়ক লিওনেল মেসি।আর্জেন্টিনার এই শিরোপা নিশ্চিতভাবেই দেশটির সর্বকালের সেরা ফুটবলার দিয়েগো ম্যারাডোনার জন্যই তোলা থাকবে, আকাশের ওপার থেকে এই একটি মানুষ সবসময়ই মেসিদের পাশে ছিলেন, যার দ্বারা অনুপ্রানীত পুরো দল আজ বিশ্বসেরার আসনে।
রোববার লুইসাইল স্টেডিয়ামে শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচ ২-২ গোলের সমতায় শেষ হয় নির্ধারিত ৯০ মিনিট। এরপর অতিরিক্ত সময়ে মেসির গোলে ৩-২ এ এগিয়ে যায় আর্জেন্টিনা। আবারো পেনাল্টিতে গোল করে ৩-৩ সমতায় ফেরান এমবাপে। এতেই টাব্রেকারে গড়ায় ফাইনাল। এতে ৪-২ শর্টে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হলো আর্জেন্টিনা।
এমন ম্যাচের শুরুতেই আক্রমণত্মক খেলতে থাকে আর্জেন্টিনা। পুরো দলই চায় আর্জেন্টাইন অধিনায়ক লিওনেল মেসির হাতে বিশ্বকাপ তুলে দিতে।
ম্যাচের ৪ মিনিটে ডি পল এবং আলভারেজের দারুণ বোঝাপড়ায় ডি পলের বাড়ানো বলে আলভারেজ শট নিলেও রেফারি অফসাইডের সিদ্ধান্ত দেন।
৬ মিনিটে ম্যাক এলিস্টারের দূরপাল্লার শট সোজা তালুবন্দি করেন ফ্রেঞ্চ গোলরক্ষক লরিস। এর ঠিক ২ মিনিট পর আবারো আক্রমণ করে আর্জেন্টিনা।
এবার ডি পল ডি বক্সের বাইরে থেকে জোড়ালো শট নিলে ফ্রেঞ্চ ডিফেন্ডার ভারানের পায়ে লেগে বল বাইরে চলে গেলে কর্নার পায় আর্জেন্টিনা। অবশ্য সেই কর্নার কাজে লাগাতে পারেনি আলবিসেলেস্তারা।
১৬ মিনিটে আবারো গোলের সুযোগ পেয়েছিল আর্জেন্টিনা। এবার ডি পলের ডান পাশ থেকে বাড়ানো ক্রসে ডি মারিয়ার ডান পায়ের শট চলে যায় গোলবারের অনেক উপর দিয়ে।
ম্যাচের ২১ মিনিটের মাথায় ডি মারিয়াকে ডি বক্সের ভেতর ফাউল করে বসেন ডেম্বেলে। রেফারি সঙ্গে সঙ্গে পেনাল্টির সিদ্ধান্ত দেন।
বরাবরের মত পেনাল্টি পায় আর্জেন্টিনা। পেনাল্টিতে বারবার আর্জেন্টিনাকে গোল এনে দিয়েছেন আর্জেন্টিনার প্রাণ ভোমরা লিওনেল মেসি।
এবারো নিজের অভিজ্ঞতা কাজে লাগালো বিশ্বসেরা এ খেলোয়াড়। ২৩ মিনিটে মেসির শর্ট রুখেত ব্যর্থ হলো লরিস। স্টেডিয়াম কাঁপিয়ে শোনা গেল গোল। ১-০গোলে এগিয়ে গেল আর্জেন্টিনা। বিশ্বকাপে নিজের ৬ষ্ঠ গোল করলেন আর্জেন্টাইন অধিনায়ক।
ফের গোলের দেখা পেল আর্জেন্টিনা। তবে এবার আর মেসি নয়। গোল করলেন ২০১৪ সালে ইনজুরির কারণে বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলতে না পারা ডি মারিয়া।
৩৭ মিনিটে আর্জেন্টিনার দুর্দান্ত কাউন্টার এটাকে খেই হারিয়ে ফেলে ফ্রান্স। মাঝমাঠ থেকে মেসির পাস থেকে আলভারেজ বল পেলে সেটি বাড়ান ম্যাকএলিস্টারের উদ্দেশ্যে, দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে তিনি বল দেন ডি মারিয়াকে।
তিনি আর মিস করলেন না। কোপা আমেরিকার ফাইনাল, ফিনালিসিমার পর আরো একটি ফাইনালে গোল করলেন এই জুভেন্টাস তারকা। এভাবে চলতে থাকে আর্জেন্টিনার আক্রমণ। প্রথমার্ধে ফ্রান্সের গোল বারে ৬ বার বল পাঠায় মেসিবাহিনী। তার মধ্যে ২ টি গোল তুলে নেন তারা। তব একটি বলও আর্জেন্টিনার জালে শর্ট করতে পারেনি দেশমের শিষ্যরা। চেষ্টা যে করেনি তা নয়। তবে স্কালোনের শিষ্যরা তাদের সে সুযোগ দেয়নি।
দুই গোলে পিছিয়ে থেকে প্রথমার্ধেই জিরু ও ডেম্বেলেকে পাল্টে ফেলেন ফ্রান্স কোচ। তবুও তাদের ভাগ্যের চাকা ফিরেনি। ২-০ গোলে এগিয়ে থেকে বিরতিতে যায় আর্জেন্টিনা।
তবে দ্বিতীয়ার্ধে ঘুরে দাঁড়ায় ফ্রান্স। পরপর দুই গোলের দেখা পায় ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নরা। ৪৯ মিনিটে ডান পাশে কাত হয়ে ফ্রান্স বারে শর্ট করেন ডি পল। কিন্তু বলটি লুফে নেন লরিস। ৫২ মিনিটে কর্নার পেয়েও কাজে লাগাতে পারেনি ফ্রান্স।
৫৫ মিনিটে ডি পলকে ফাউল করে হলুদ কার্ড দেখেন আদ্রিয়েন র্যাবিও। ৫৯ মিনিটে একাই বল নিয়ে ফ্রান্স গোল বারের দিকে ছুটে যান আলভারেজ। তবে ব্যর্থ হন তিনি। বল লাগে গোল বারে।
ম্যাচের ৬০ মিনিটে মেসির একটা চেষ্টা ব্যর্থ করে দেন র্যাবিও। ৬৪ মিনিটে ডি মারিয়া কে উঠিয়ে নিয়ে মার্কোস একুনিয়েক নামান স্কালোনি।
একটাও টার্গেটে শর্ট করতে পারেনি ফ্রান্স। ৭১ মিনিটে গ্রিজম্যান ও হার্নান্দেজকে তুলে নেন ফ্রান্স কোচ দেশম। ৭২ মিনিটে আবারো হামলা আর্জেন্টিনার। ফার্নান্দেজের শর্ট গোলবারের সামনে থেকে রুখে দেন কিপার লোরিস।
আর্জেন্টিনার ডিবক্সে ৭৮ মিনিটে কুলো মুয়ানিকে ফাউল করে বসেন ওতামেন্দি। রেফারি সঙ্গে সঙ্গে পেনাল্টির বাঁশি বাজান। ৮০ মিনিটে গোল পান এমবাপে। এরপরের মিনিটেই ফের গোল করেন এমবাপে।
এতে ২-২ সমতায় ফেরে খেলা। তারপর নির্ধারিত সময়েগোল না হওয়ায় অতিরিক্ত সময়ে গড়ায় খেলা। ১০৮ মিনিটে মিনিটে ফ্রান্সের গোলে বারে শর্ট করেন মার্টিনেজ যা ঠেকিয়ে দেন লরিস। কিন্তু এবারে সুযোগ পান মেসি। করেন বিশ্বকাপের ৭ম ও নিজের বিশ্বকাপ ক্যারিয়ারের ১৩ তম গোল।
১১৮ মিনিটে ফের পেনাল্টি পায় ফ্রান্স। এখানেও গোল করেন এমবাপে। আবারো সমতায় ফেরে খেলা। ৩-৩ গোলে শেষ হয় অতিরিক্ত সময়। এতেই টাব্রেকারে গড়ায় খেলা।টাই ব্রেকারে ৪-২ গোলে ফ্রান্সকে উড়িয়ে দিয়ে বিশ্বকাপ নিজেদের করে নিল দিয়েগো ম্যারাডোনার শিষ্যরা। স্নায়ুচাপ কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত মেসির হাতে দেখা গেল স্বপ্নের বিশ্বকাপ। অপক্ষার অবসান হলো ৩৬ বছরের।