শুক্রবার ২২ নভেম্বর ২০২৪ ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

শিরোনাম: বিএনপির বড় বিশৃঙ্খলার চেষ্টা আ.লীগের সতর্কতায় বিফল: তথ্যমন্ত্রী   সংকটকে সম্ভাবনায় রূপ দিতে কাজ করছে সরকার: কাদের   নাটোরে ট্রেনে কাটা পড়ে ৩ জনের মৃত্যু   ‘কিছুই করি নাই শ্রেণিটা’ চোখ থাকতেও দেখে না: প্রধানমন্ত্রী   রাজকে আমার জীবন থেকে ছুটি দিয়ে দিলাম: পরীমনি   সৌদি আরবের ক্লাবে যোগ দিলেন রোনালদো   বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী   
https://www.dailyvorerpata.com/ad/Inner Body.gif
বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়গাঁথা
মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২২, ১০:০০ পিএম | অনলাইন সংস্করণ

ভারতবর্ষ ভাগ হওয়ার প্রাক্কালে ১৯৪৬ সালে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে মুসলিম লীগের আহবানে বাঙলা প্রদেশের জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে মুসলিম লীগের পক্ষে রায় দেয়। নির্বাচনে ১১৯ টি আসনের মধ্যে ১১৪ টি লাভ করে মুসলিম লীগ। এ নির্বাচনের ফলাফলকে পাকিস্তানের পক্ষে বঙ্গীয় মুসলমানদের ঐতিহাসিক রায় হিসেবে ধরা হয়।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে পূর্ব বাংলার জনগণের অবদান বেশি থাকা সত্ত্বেও ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর শাসন ক্ষমতা চলে যায় প্রতিক্রিয়াশীল পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে। পূর্ব পাকিস্তান থেকেও যারা রাষ্ট্র ক্ষমতার অংশীদার ছিলেন তারাও বাঙ্গালির স্বার্থ রক্ষায় মনোযোগী ছিলেন না। মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমানসহ প্রগতিশীল যুব ও ছাত্র নেতৃবৃন্দ আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলার মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার ও ন্যায্য হিস্যা আদায়ে ১৯৪৮ সাল থেকেই তৎপর ছিলেন।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন তথা মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার লড়াই ছিল প্রকৃতপক্ষে বাঙালি জাতির মুক্তি ও স্বাধীনতার প্রথম সোপান। বায়ান্নর পথ ধরে ৫৪'র যুক্ত ফ্রন্টের নির্বাচন, ৫৮'র সামরিক শাসন, ৬২'র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯'র গণঅভ্যুত্থানে বাঙালি ঐক্যবদ্ধভাবে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের একচ্ছত্র শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। এসব আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। তাঁরই আহবানে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ছয় দফা ভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে পূর্ব পাকিস্তানের তথা বাংলার জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে রায় দেয়। বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দকৃত ১৬৯ টি আসনের মধ্যে ১৬৭ টিতে বিজয়ী হয়। পাকিস্তানের ৩১৫ আসনের জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে সরকার গঠনের দাবিদার হয়।

কিন্তু কতিপয় পাকিস্তানি প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতিবিদের প্ররোচনায় সামরিক সরকার আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন করতে দেয়নি। এর প্রতিবাদে বাঙালি আন্দোলনে নামলে পাকিস্তানি শাসকগণ বল প্রয়োগে তা দমনের চেষ্টা করে। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে ২৫ শে মার্চ পর্যন্ত রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে বহু বাঙালির রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে স্মরণকালের বৃহত্তম জনসভায় ঘোষণা করেন, "এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।"

২৫ শে মার্চ মধ্যরাত থেকে পাকিস্তানি সামরিক সরকার 'অপারেশন সার্চলাইটে'র মাধ্যমে ঢাকা সহ বিভিন্ন বড় বড় শহরে গণহত্যা শুরু করে। এরই প্রেক্ষাপটে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ইপিআর এর ওয়ারলেসের মাধ্যমে দেশের সর্বত্র প্রচারিত হয়। তাঁরই আহবানে শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ।

পাকিস্তানি সামরিক সরকার বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রমুখের নেতৃত্বে ১০ এপ্রিল ভারতের কলকাতায় বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার গঠিত হয়। ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার ভবের পাড়ায় (বৈদ্যনাথ তলা) আম বাগানে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার শপথ গ্রহণ করে। শপথ গ্রহণের ওই স্থানটির নাম রাখা হয় মুজিবনগর। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ঘোষণা দেন যে, অস্থায়ী রাজধানী মুজিবনগর থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনা করা হবে। রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হন। মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও এএইচএম কামরুজ্জামান। কর্নেল (অব:) এমএজি ওসমানী কে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সরকার সর্বতোভাবে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়। ভারতের নিয়মিত সেনাবাহিনীর মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে আগত ছাত্র-যুবক-জনতাকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর অত্যাচার ও হত্যাযজ্ঞের কারণে ভীত হয়ে প্রায় এক কোটি বাঙালি ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করে।

২৬ শে মার্চ থেকেই সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানকারী বাঙালি সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী অফিসার ও জাওয়ান, ইপিআরের সদস্যগণ এবং প্রতিরক্ষা বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কর্মচারীগণ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তারা প্রাথমিক অবস্থায় দেশের অভ্যন্তরে বিদ্রোহ করে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করলেও সংঘটিত ও সশস্ত্র পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে পেরে ওঠা সম্ভব ছিল না। সেজন্য এপ্রিল মাসের মধ্যে তারা ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং ভারত থেকে মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যান। উপরন্ত দলে দলে বাঙালি ছাত্র যুবক ও জনতা ভারতে গিয়ে মুক্তিবাহিনীতে অংশগ্রহণ করেন। শুধু তা-ই নয় সর্বস্তরের আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ এবং (মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামী ব্যতীত) অন্যান্য দল যেমন মওলানা ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), মস্কোপন্থী ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টিও ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিভিন্ন সাংগঠনিক কাজে অংশগ্রহণ করে।

অস্থায়ী সরকার গঠনের পর কর্নেল (অবঃ) আতাউল গনি ওসমানী কে জেনারেল পদে উন্নীত করে সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিয়োগ করা হয় এবং তাঁর অধীনে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী এবং ইপিআর, পুলিশ, আনসার ও মুজাহিদ বাহিনীর সদস্যদের ন্যস্ত করা হয়। সুষ্ঠুভাবে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য সমগ্র বাংলাদেশের রণাঙ্গনকে ১১ টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। সেক্টর কমান্ডারদের এলাকা ভাগ করে দেওয়া ছাড়াও তিনজন সেক্টর কমান্ডারের নেতৃত্বে তিনটি বাহিনী গঠন করা হয়। যেমন - মেজর সফিউল্লাহ’র নেতৃত্বে এস-ফোর্স (৩নং সেক্টর), মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে জেড-ফোর্স (১নং সেক্টর),  এবং মেজর খালেদ মোশাররফ এর নেতৃত্বে কে-ফোর্স (২নং সেক্টর)। অন্যান্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সেক্টর কমান্ডরগণ ছিলেন - মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত (সিলেট, হবিগঞ্জ, ৪নং সেক্টর), মেজর মীর শওকত আলী (৫নং সেক্টর), উইং কমান্ডার এমকে বাসার (রংপুর ও দিনাজপুরের একাংশ, ৬নং সেক্টর), কর্নেল নুরুজ্জামান (দিনাজপুরের একাংশ, রাজশাহী, পাবনা ও বগুড়া, ৭নং সেক্টর), মেজর উসমান চৌধুরী ও পরে মেজর মঞ্জুর (কুষ্টিয়া, যশোর ও খুলনার একাংশ, ৮নং সেক্টর), মেজর এম এ জলিল (খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী ও ফরিদপুরের একাংশ, ৯নং সেক্টর), নৌবাহিনীর নৌ-কমান্ডো সমগ্র বাংলাদেশের নদী ও সমুদ্র মেজর আবু তাহের (১১নং সেক্টর), উইং কমান্ডার হামিদুল্লাহ (ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, ১১নং সেক্টর)।

এসব সেক্টর কমান্ডারদের অধীনে নিয়মিত প্রতিরক্ষা বাহিনী, পুলিশ, আনসার সহ ছাত্র, তরুণ, কৃষক, শ্রমিক সকলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করে। তাদের বলা হতো মুক্তিবাহিনী। কখনো কখনো মুক্তিবাহিনী দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পাক সেনাদের ঘাঁটি, পাহারারত স্থান বা রনাঙ্গনে নিয়োজিত পাকিস্তানি সৈন্যদের গেরিলা কায়দায় আক্রমণ ও হতাহত করে নিরাপদ স্থানে পালিয়ে যেতেন। মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সৈন্যদের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সেতু, স্থাপনা ইত্যাদি বোমা মেরে ধ্বংস করে দিতেন। সরকারি নেতৃবৃন্দের ভাষণ, যুদ্ধের খবর প্রচার এবং গণসংগীতের মাধ্যমে মুক্তিবাহিনী ও দেশবাসীকে উজ্জীবিত রাখার জন্য ছিল 'স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র'। বাংলাদেশের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা যারা মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেনি তারা মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়, আহার ও অর্থ দিয়ে সহায়তা করতেন। গ্রামের পর গ্রামে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা সকলের সহায়তায় যুদ্ধ করতেন। পাকিস্তানি সরকার বা বাহিনীকে সহায়তাকারীরা 'দালাল'রূপে চিহ্নিত হয়। তারা 'শান্তি কমিটি' ও 'রাজাকার' বাহিনী গঠন করে। তবে এদের সংখ্যা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের জনগণের তুলনায় অতি নগণ্য। তাদের সহায়তায় পাক সেনারা কখনো কখনো বিভিন্ন গ্রামে গমন করে মুক্তি সেনাদের পিতা-মাতা ও আত্মীয়দের এবং নিরীহ গ্রামবাসীদের হত্যা ও ক্ষতি করত এবং বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিত। যাকে সন্দেহ করতো, তাকেই হত্যা করতো। পাক সেনারা নির্বিচারে গণহত্যার পাশাপাশি বাঙালি মা-বোনদের ধর্ষণ ও নির্যাতন করতো। 

বিদেশে অবস্থিত পাকিস্তানি দূতাবাসের অনেক বাঙালি অফিসার বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে পাকিস্তানের চাকরি ত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে কূটনৈতিক কার্য চালিয়ে যান। তাছাড়া ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এবং আমেরিকা ও কানাডায় অবস্থানরত বহু বাঙালি ছাত্র, শিক্ষক, চাকরীজীবী, গবেষক ও অন্যান্য পেশাজীবী মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে প্রচার-প্রচারণায় অংশগ্রহণ করেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত সরাসরি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র ও অন্যান্য সহায়তা দিলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও গণচীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বহু সাংসদ ও সিনেটর, বুদ্ধিজীবী ও জনগণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষাবলম্বন করে। এ যুদ্ধ ছিল প্রকৃতই একটি জনযুদ্ধ। 

সেপ্টেম্বর অক্টোবর মাসের মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনীর উপর মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ আরো জোরদার হয় এবং বিপর্যস্ত হতে থাকে পাকবাহিনী ও তাঁদের দোসররা। নিয়মিত বাহিনীর কর্মকর্তা ও জওয়ানদের নিয়ে ২১ নভেম্বর বাংলাদেশের স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনী গঠিত হয়। মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানী ২২ শে নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনের বিষয়ে একটি বিস্তারিত নির্দেশনাবলী জারি করেন। ২৩ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ যুদ্ধ পরিস্থিতি বর্ণনা করে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে মুক্তি বাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ কমান্ড সৃষ্টি হয়। লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং আরোরাকে যৌথ বাহিনীর কমান্ডার নিয়োগ করা হয়।

২১ নভেম্বর ১৯৭১ থেকে ২ ডিসেম্বরের মধ্যে মুক্তিবাহিনী ভারতীয় মিত্রবাহিনী ও বিএসএফের সহায়তায় সীমান্ত অঞ্চলে পাকিস্তান বাহিনীর বেশ কটি শক্ত ঘাঁটি দখল করে নেয়। নভেম্বরের শেষার্ধে মুক্তিবাহিনী সীমান্ত ও দেশের অভ্যন্তরে তাদের আক্রমণ জোরদার করে। এখানে উল্লেখ্য যে, মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক অবস্থা থেকেই কাদেরিয়া বাহিনী, হেমায়েত বাহিনী, বাতেন বাহিনী প্রমুখ বাহিনী দেশের অভ্যন্তরে গেরিলা ও সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। 

মুক্তিবাহিনীর সাথে মিত্র বাহিনী সক্রিয় হলে উপায়ান্তর না দেখে ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। পাকিস্তানের বিমান বাহিনী ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি শহরে বোমা বর্ষণ করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধের ঘোষণা দেন। ঐদিনই ভারতীয় মিত্র বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। যুদ্ধের দ্বিতীয় দিনেই ভারতীয় বিমানবাহিনীর আক্রমণে বাংলাদেশে অবস্থিত পাকিস্তান বিমান বাহিনীর বিমান ও ঘাঁটি অকার্যকর হয়ে যায়। মিত্র বাহিনী দেশের চতুর্দিক থেকে ঢাকা অভিমুখে অভিযান শুরু করে। বাংলাদেশ ও ভারত সরকার বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য বিশ্ববাসীর কাছে আবেদন জানায়। ৪ ডিসেম্বর ভুটান এবং ৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে।

বাংলাদেশের মানুষ বুঝতে পারে যে, যুদ্ধ শেষ হতে আর বেশি দেরি নাই। মিত্রবাহিনীর অগ্রযাত্রায় পাকিস্তান বাহিনী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কোনঠাসা হয়ে পড়ে। তারা সর্বত্র পিছু হটতে থাকে। ৫ ডিসেম্বরের পর থেকে প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকা মুক্ত হতে থাকে। বিভিন্ন এলাকায় পরাজিত পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে থাকে। ১২ ডিসেম্বর থেকে বেতারে ও টিভিতে ভারতের প্রধান সেনাপতি জেনারেল মানেকশ’ পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণ করার ঘোষণা দিতে থাকে। ভারতীয় বিমানবাহিনীর উপর্যুপরি আক্রমণে বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তান আর্মি ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জেনারেল নিয়াজীকে পাকিস্তানিদের প্রাণ রক্ষার্থে আত্মসমর্পণ করতে বলেন। ঐদিনই ভারতীয় বিমান বাহিনী ঢাকার গভর্নর হাউজে বোমাবর্ষণ করে। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আব্দুল মালেক পদত্যাগ করে রেড ক্রসের নির্ধারিত এলাকায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। ১৪ ও ১৫ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানি বেমসামরিক সরকার ও সামরিক কর্তৃপক্ষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতির উদ্যোগ নেয়। ভারতীয় বাহিনীর প্রধান জেনারেল মনেকশ আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া সহজ করার জন্য ১৫ ডিসেম্বর বিকেল পাঁচটা থেকে পরের দিন বিকেল তিনটা পর্যন্ত ভারতের পক্ষ থেকে যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করেন। মিত্র বাহিনী ১২ থেকে ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে ঢাকার চারদিকে উপস্থিত হয়ে ঢাকা অবরোধ করে। পূর্ব থেকে ঢাকায় ও আশেপাশে অবস্থানরত গেরিলারা মিত্রবাহিনীর সাথে যোগ দেন। ১৬ ডিসেম্বর সকালে জেনারেল নিয়াজি তার অধীনস্থদের যুদ্ধ বিরতির নির্দেশ দেন।

১৪ ডিসেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে স্মরণকালের এক নৃশংসতম ঘটনা ঘটে। পাক সেনাদের মদদপুষ্ট রাজাকার, আলবদর, আলশামস প্রভৃতি বাহিনী দেশের বুদ্ধিজীবী তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথিতযশা শিক্ষক, সাহিত্যিক, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তারদের ধরে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে জাতিকে মেধাশূন্য করার প্রয়াস নেয়। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে হায়ানাদের এরূপ অপকর্ম তাদের প্রতিহিংসা ও হীনমন্যতার চূড়ান্ত প্রকাশ বলে মনে করা হয়।

মিত্রবাহিনী ও পাকসেনাদের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ও আত্মসমর্পণের সমঝোতার পর ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের চীফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জ্যাকব ১৬  ডিসেম্বর দুপুরের মধ্যে ঢাকা পৌঁছেন। লেফটেন্যান্ট জেনারেল এএকে নিয়াজীকে বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে তেজগাঁও বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়। বিকেল ৪ টায় হেলিকপ্টারে করে মিত্রবাহিনীর অধিনায়ক এবং ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা ঢাকায় পৌঁছলে জেনারেল নিয়াজী ও জেনারেল জ্যাকব তাকে স্বাগত জানান। এস-ফোর্সের অধিনায়ক ও ৩ নং সেক্টর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল শফিউল্লাহও বিমানবন্দরে জেনারেল আরোরাকে অভ্যর্থনায় উপস্থিত ছিলেন।

১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে চারটায় রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানী সমরাধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল এএকে নিয়াজী কয়েক সহস্র সেনা অফিসার ও সৈনিক সহ বাংলাদেশে নিয়োজিত সকল পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর (প্রায় ৯৩ হাজার) পক্ষে আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন। মিত্রবাহিনীর পক্ষে স্বাক্ষর করেন ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান ও ভারত বাংলাদেশ যৌথ কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর ডেপুটি চীফ অফ স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন আব্দুল করিম খন্দকার, বাংলাদেশ নিয়মিত বাহিনীর দুটি ইউনিটসহ চার ব্যাটালিয়ন সৈন্য, কয়েক সহস্র মুক্তিযোদ্ধা এবং এক বিশাল হর্সোৎফুল্ল জনতার উপস্থিতিতে ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ ‘আমার দেশ, তোমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ প্রভৃতি স্লোগানের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে।

জেনারেল নিয়াজীকে আত্মসমর্পণ স্থলে নিয়ে যাওয়ার সময় তার ডান ও বাম পাশে ছিলেন যথাক্রমে জেনারেল আরোরা এবং মুক্তিবাহিনীর ২ নং সেক্টরের উপ- কমান্ডার মেজর এটিএম হায়দার। ১৬ ডিসেম্বর দুপুরের মধ্যেই কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান কাদের সিদ্দিকী ঢাকায় পৌঁছেন। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে ছিলেন কিনা তা নিশ্চিত নয়। তবে সেক্টর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল শফিউল্লাহ রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত ছিলেন বলে অনেকের মত, যদিও আত্মসমর্পণের ছবিতে তাঁকে দেখা যায় না। জেনারেল ওসমানী ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াউর রহমান সিলেটে অবস্থান করছিলেন। ১৬ ডিসেম্বরের পর থেকে সর্বশেষ  ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন সেনানিবাসে অবস্থানরত পাকিস্তানি সৈন্যরা বিভিন্ন সময়ে যৌথ বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে। ঢাকা সেনানিবাসের সৈন্য ও অফিসারগণ আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ করেন ১৯ ডিসেম্বর।

মুক্তিযুদ্ধের পরিসমাপ্তি এবং বাংলাদেশ শত্রু মুক্ত হলেও তখনো বাঙালি বিজয়ের আনন্দ পূর্ণরূপে উদযাপন করতে পারছিল না। বঙ্গবন্ধু পশ্চিম পাকিস্তানে কেমন আছেন, কবে ফিরবেন এই নিয়ে সকলের মধ্যেই ছিল উৎকণ্ঠা। অবশেষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলে সেদিন বাঙালি উদযাপন করে প্রকৃত বিজয়ের আনন্দ। সারা দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ ঢাকায় এসে বিজয়োল্লাস করে বঙ্গবন্ধুকে বরণ করে নেয়।

লেখক: সাবেক সিনিয়র সচিব ও এনবিআর এর সাবেক চেয়ারম্যান। বর্তমানে জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
http://www.dailyvorerpata.com/ad/Vorer-pata-23-12-23.gif
http://www.dailyvorerpata.com/ad/bb.jpg
http://www.dailyvorerpata.com/ad/Screenshot_1.jpg
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ


সম্পাদক ও প্রকাশক: ড. কাজী এরতেজা হাসান
সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
সাউথ ওয়েস্টার্ন মিডিয়া গ্রুপ


©ডেইলি ভোরের পাতা ডটকম


©ডেইলি ভোরের পাতা ডটকম

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : ৯৩ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫।
ফোন:৮৮-০২-৪১০১০০৮৭, ৪১০১০০৮৬, বিজ্ঞাপন বিভাগ: ৪১০১০০৮৪, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৪১০১০০৮৫
অনলাইন ইমেইল: [email protected] বার্তা ইমেইল:[email protected] বিজ্ঞাপন ইমেইল:[email protected]