নতুন প্রযুক্তির আবির্ভাবের সাথে সাথে অপরাধের ধরণ পরিবর্তিত হওয়ার প্রেক্ষিতে জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রথাগত ও অপ্রথাগত হুমকি মোকাবেলার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ‘ট্রাডিশনাল সিকিউরিটি থ্রেট’ এর পাশাপাশি ‘নন ট্রেডিশনাল সিকিউরিটি থ্রেট’ সমূহ প্রতিহত করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এখন নিরাপত্তার বিষয়টি অনেক বদলে গেছে। ডিজিটাল ডিভাইস যেমন আমাদের অনেক সুযোগ করে দিয়েছে। তেমনি সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ কিংবা অপরাধের ধারাটাও পাল্টে গেছে।
মঙ্গলবার (১৩ ডিসেম্বর) মিরপুর সেনানিবাসের ডিফেন্স সার্ভিস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজের (ডিএসসিএসসি) ‘ডিএসসিএসসি কোর্স ২০২২’ এর গ্রাজুয়েশন সেরিমনিতে শেখ হাসিনা কমপ্লেক্সে গ্রাজুয়েটদের মধ্যে সনদ বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা চাই একটা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ দেশে থাকুক, সেভাবেই আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি এবং আমাদের লক্ষ্য স্মার্ট বাংলাদেশ অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষই এই ডিজিটাল ডিভাইস সম্পর্কে জানবে, ব্যবহার করবে।
বিশ্ব সম্প্রদায়ের কল্যাণে অবিলম্বে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করতে বিশ্ব নেতাদের প্রতি তার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেন তিনি।
তিনি বলেন, আমরা যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই। আমরা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সকল বিরোধ ও মতভেদ দূর করতে চাই।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার সশস্ত্র বাহিনীকে উন্নত ও শক্তিশালী করে চলেছে কিন্তু সেটা কারো সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য নয়।
তিনি আরও বলেন, আমাদের পররাষ্ট্র নীতি, ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’ খুব স্পষ্ট। আমরা জাতির পিতার গৃহীত পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে সকলের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে রাষ্ট্র পরিচালনা করছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমিতে প্রত্যাবাসন নিয়ে তারা মিয়ানমারের সঙ্গে কোনো বিবাদে জড়াননি।
তিনি বলেন, আমরা আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি।
প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে আইনি লড়াইয়ে জয়ী হয়ে আলোচনার মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে স্থল সীমানা সমস্যা সমাধান এবং বিশাল সমুদ্র এলাকা ও এর সম্পদের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি আবারও দেশবাসীকে ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং তারল্য নিয়ে গুজবের বিরুদ্ধে সতর্ক করে বলেন, একটি স্বার্থান্বেষী মহল ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং তারল্য নিয়ে গুজব ছড়ানোর চেষ্টা করছে, গুজবে কান দেবেন না।
তিনি ব্যাংকে পর্যাপ্ত বৈদেশিক রিজার্ভ এবং তারল্য থাকার বিষয়ে জনগণকে আশ্বস্ত করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লিখিত রূপকল্প-২০২১ অনুযায়ী বাংলাদেশকে একটি ডিজিটাল ও উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তর করতে সক্ষম হয়েছে।
তিনি বলেন, জাতি যখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করেছে তখন বাংলাদেশকে একটি উন্নয়নশীল দেশে পরিণত করা আমাদের জন্য একটি বড় অর্জন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁরা এখন রূপকল্প-২০৪১ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ এবং ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’কে একটি ‘স্মার্ট বাংলাদেশে’ রূপান্তর করতে প্রস্তুত।
তিনি বলেন, দয়াকরে কেউ যাচাই না করে গুজবে কান দেবেন না বা বিভ্রান্ত হবেন না।
তিনি আরও বলেন, করোনা পরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং একে কেন্দ্র করে স্যাংশনের প্রেক্ষাপটে বৃটেন নিজেদেরকে অর্থনৈতিক মন্দার দেশ ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু আমরা এখনো সে দুরবস্থায় পড়ি নাই। অন্তত আমি এটুকু আপনাদেরকে বলতে পারি। আমাদের সেই প্রচেষ্টা আছে।
তিনি এ প্রসঙ্গে যার যতটুকু জায়গা আছে তাতে কিছু না কিছু উৎপাদন করার জন্য তাঁর আহবান পুনর্ব্যক্ত করেন যাতে নিজেদের খাবারটা আমরা নিজেরা উৎপাদন করতে পারি, কারো কাছে হাত পেতে চলতে না হয়।
নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণ, কর্ণফুলী টানেল, মেট্রো রেলসহ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে তাঁর সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, আমরা এমনভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করেছি যাতে বাংলাদেশের যেকোন অঞ্চল থেকে ৬/৭ ঘন্টার মধ্যে রাজধানীতে এসে পৌঁছানো যায়। সেই ব্যবস্থাটা আমরা করে দিয়েছি এবং কাজ চলমান আছে, চলমান থাকবে।
তিনি বলেন, সেইদিক থেকে আমি বলবো আমাদের বাংলাদেশটাকে আমরা অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। বাঙালি জাতি যেন সারাবিশ্বের কাছে মাথা উঁচু করে চলতে পারে অন্তত সেটুকু করেছি। বাংলাদেশকে আর কেউ অবহেলার চোখে দেখেনা বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবেই স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছে।
তিনি একটানা সরকারে থাকার ফলেই দেশের উন্নয়নের যে কাজগুলো করতে পেরেছেন বিশ্বে বাংলাদেশ ও দেশের মানুষের ভাবমূতি উজ্জ্বল করতে পেরেছেন সেজন্য সহকর্মীদের ধন্যবাদ জানান। কেননা কারো একার পক্ষে এ বিশাল কর্মযজ্ঞ সাধন সম্ভব ছিলনা।
প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন, ৪০ হাজার মেট্রিক টন খাদ্য ঘাটতি থাকা অবস্থায় ’৯৬ সালে দেশের শাসনভার গ্রহণ করে দেশে প্রথমবারের মত শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরকালে ২৬ লাখ মেট্রিক টন উদ্বৃত্ত রেখে গিয়েছিলেন। তিনি দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ১৬ শ’ মেগাওয়াট থেকে বাড়িয়ে ৪ হাজার ৩শ’ মেগাওয়াট করা এবং পরবর্তীতে বিএনপি সরকারের সময়ে তা আবার ৩ হাজার ২শ’ মেগাওয়াটে নামিয়ে ফেলাসহ বর্তমানে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ হাজার মেগাওয়াট এবং স্বাক্ষরতার হার, গড় আয়ু বৃদ্ধি প্রভৃতি সাফল্যের বিবরণ তুলে করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করে। সে সময় আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়নে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।
তিনি বলেন, আমরা ১৯৯৮ সালে ‘ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ’ এবং ‘মিলিটারি ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’, ১৯৯৯ সালে ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস সাপোর্ট অপারেশন ট্রেনিং’ এবং ‘আর্মড ফোর্সেস মেডিক্যাল কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করি। আমরাই সর্বপ্রথম ২০০০ সালে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীতে নারী অফিসার নিয়োগ করি।
তিনি আরও বলেন, ২০০৮ সাল থেকে টানা তিনবার নির্বাচনে জয়লাভের পর আমরা অত্যাধুনিক ও যুগোপযোগী সামরিক বাহিনী গঠনের লক্ষ্যে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি। আমরা ১৯৭৪ সালে জাতির পিতার প্রণীত প্রতিরক্ষা নীতিমালার আওতায় ‘ফোর্সেস গোল-২০৩০’ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়ন, সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন করছি। ২০১৬ সালে ‘বাংলাদেশ পিস বিল্ডিং সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা করেছি। জাতির পিতা প্রণীত প্রতিরক্ষা নীতি যুগোপযোগী করে ‘জাতীয় প্রতিরক্ষানীতি, ২০১৮’ প্রণয়ন করেছি। আমরা সন্ত্রাসবাদ ও সহিংস উগ্রবাদের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করেছি।
‘সামরিক বাহিনী কমান্ড ও স্টাফ কলেজ’ থেকে এ পর্যন্ত ৫ হাজার ৯ শত ৭৯ জন অফিসার সাফল্যের সঙ্গে কোর্স সম্পন্ন করেছেন, এর মধ্যে ৪৪টি বন্ধুপ্রতিম দেশের ১ হাজার ৩ শত ১ জন অফিসারও এ কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেছেন। বর্তমান কোর্সেও ২১টি বন্ধুপ্রতীম দেশের ৪৬ জন বিদেশি কর্মকর্তা এবং বাংলাদেশ পুলিশের ৩ জন কর্মকর্তাসহ আজ মোট ২৫০ জন কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ শেষ করে পিএসসি ডিগ্রী লাভ করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী গ্রাজুয়েশন প্রাপ্তদের অভিনন্দন জানিয়ে মাতৃভূমির ওপর সম্পূর্ণ নিবেদিতপ্রাণ হয়ে যার যার ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের আহবান জানান।
শেখ হাসিনা বলেন, আমি আশা করি, সামরিক বাহিনী কমান্ড ও স্টাফ কলেজ তার শিক্ষা-প্রশিক্ষণের উচ্চমানের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখবে। এ প্রতিষ্ঠানের গ্র্যাজুয়েটগণ তাঁদের অর্জিত জ্ঞান, ইচ্ছাশক্তি ও অঙ্গিকার সামনে রেখে দেশকে গৌরবময় অবস্থানের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
পেশাদারিত্বের সঙ্গে ‘সামরিক বাহিনী কমান্ড ও স্টাফ কলেজ ২০২২’ কোর্স সফলভাবে সম্পন্ন ও পরিচালনা করার জন্য তিনি কমান্ড্যান্ট, ডিএসসিএসসিকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান।
তিনি বিদেশ থেকে আগতদের ধন্যবাদ জানিয়ে তাদের দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব যেন অটুট থাকে সেজন্য আমাদের দেশের এক একজন দূত হিসেবে তাদেরকে নিজ নিজ দেশে কাজ করে যাবারও আহবান জানান। খবর: বাসস