সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে দেশের নারী সমাজ। পুরুষের পাশাপাশি দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে এগিয়ে নিচ্ছে এদেশের নারীরা। কিন্তু খুব সহজেই সব নারীদের জীবনে সফলতা আসেনি। এজন্য করতে হয়েছে সংগ্রাম আর প্রাণপণ চেষ্টা। অনেকের রয়েছে অনেক করুন ইতিহাস। সব বাঁধা আর সমাজের নানা প্রতিবন্ধকতাকে পিছনে ফেলে যারা সফল হয়েছে তারাই তো জয়িতা। সমাজে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে অথবা ব্যক্তি জীবনে সফলতা পেয়েছেন এমন নারীদের মধ্যে সরকার ৫টি ক্যাটাগরীতে জয়িতা সম্মাননা প্রদান করে থাকে। সংগ্রামী নারীদের জন্য এটি বিরল একটি সম্মাননা। সরকার এ সম্মাননা উপজেলা পর্যায় থেকে জেলা, বিভাগ ও জাতীয় পর্যায়ে প্রদান করে থাকে।
প্রতিবছরের ন্যায় এবছর ও ঠাকুরগাঁও জেলার ৫জন নারী ৫ ক্যাটাগরীতে এবং সদর উপজেলা পর্যায়ে ৫জন পেলেন জয়িতা সম্মাননা। শুক্রবার বিকেলে বেগম রোকেয়া দিবস ও জয়িতা সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসন ও মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর থেকে নিবার্চিত ১০ নারীকে সম্মাননা ক্রেস্ট ও সনদ পত্র প্রদান করা হয়। এর মধ্যে সদর উপজেলার ২ জন জেলা পর্যায়েও নির্বাচিত হন।
এ বছর জেলা পর্যায়ে যে ৫জন জয়িতা সম্মাননাপ্রাপ্ত হলেন :- “অর্থনৈতিক ভাবে সাফল্য অর্জনকারী” ক্যাটাগরীতে মহসিনা আক্তার। তিনি সদর উপজেলার বিষ্ণুপুর গ্রামের সাহেবান আলীর স্ত্রী। স্বামীর সংসারে অভাব অনটন থাকায় দিনমজুরের কাজ করতেন। প্রতিবন্ধি ও অসহায় নারীদের নিয়ে কাজ শুরু করেন। মিষ্টির কার্টুন, ঠোঙ্গা তৈরীর মাধ্যমে সংসারের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটান। তাঁকে দেখে এলাকার আরও অনেক নারী এ কাজের প্রতি উৎসাহিত হয়ে অর্থনৈতিক ভাবে সফল্য পাচ্ছেন।
“শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী” ক্যাটাগরীতে তানজিনা খাতুন। তিনি পীরগঞ্জ পৌরসভার রঘুনাথপুর গ্রামের তসলিম উদ্দিন ও রেহেনা বেগম এর মেয়ে। তার পিতা চায়ের দোকান করে সংসার চালাতেন। সংসারে আর্থিক অনটন লেগেই থাকতো। পড়ালেখার শুরুটা হয়েছিলো ব্র্যাক স্কুল থেকে। প ম ও অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি এবং এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পান। ব্যাংক থেকে শিক্ষাবৃত্তি পেয়ে লেখাপড়ার খরচ চালাতেন। পরবর্তীতে ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়ার সুযোগ পান। বর্তমানে চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিসিএস করে জেলার পীরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কম্পেøক্সে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কাজ করছেন।
“সফল জননী” ক্যাটাগরীতে শেফালী বেগম। তিনি রানীশংকৈল পৌরসভার সোহারাব আলীর স্ত্রী। তিনি আর্থিক অভাব অনটনের মধ্যে ৩ মেয়েকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলেন। বড় মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করেন। দুই মেয়ে জয়পুরহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে পাশ করার পর বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় হতে পাশ করেন। এক মেয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সহকারী পরিচালক ও ছোট মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে আইন বিষয়ে এমএ পাশ করেন। বর্তমানে তিনি ৪০তম বিসিএস-এ সুপারিশপ্রাপ্ত জজ।
“নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করেছেন যে নারী” ক্যাটাগরীতে জয়গুন নেছা। তিনি ঠাকুরগাঁও পৌরসভার ইসলাম নগর গ্রামের মোতালেব মিয়া ও রহিমা বেগমের মেয়ে। বর্তমানে তিনি পৌরসভার গোয়াল পাড়ায় বসবাস করছেন। মায়ের পেটে থাকতে পিতা মারা যায়। জন্মের পর থেকে নানার বাড়ীতে থাকতেন। পরে এতিমখানা থেকে বড় হন। সেখান থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাশ করেন। বিএ পাশ করে এনজিওতে চাকুরির পাশাপাশি পড়ালেখা চালিয়ে যান। চাকুরি করাকালীন বিয়ে করেন। বিয়ের পর স্বামী ও শশুরবাড়ীর লোক জনের কাছে শিকার হন। পরবর্তীতে সন্তানদের নিয়ে নিজ এলাকায় ফিরে আসেন। নতুন করে শুরু করেন চাকুরি পথচলা।
“সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন যে নারী” ক্যাটাগরীতে বানী রাণী। তিনি বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার নাউরিয়া পাড়ার বিনয় চন্দ্র রায় এর স্ত্রী। তিনি সমাজের সকল বাধা কুসংস্কার ভেদ করে নারীর ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণে দরিদ্র মানুষকে সহায়তা করেন। তিনি বাল্যবিবাহ, যৌতুক, নারী নির্যাতন প্রতিরোধে অগ্রণী ভুমিকা পালনসহ কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিষয়ে বিশেষ ভূমিকা রাখছেরন। নারীর ক্ষমতায়নে এলাকার মহিলাদের নিয়ে বিভিন্ন উঠান বৈঠকের মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছেন।
সদর উপজেলায় ৫জন সম্মাননাপ্রাপ্ত জয়িতা হলেন:- “শিক্ষা ও চাকুরীর ক্ষেত্রে” ক্যটাগরীতে বিজলী বেগম। তিনি সদর উপজেলার ফকদনপুর গ্রামের আ: বারেক মিয়ার স্ত্রী। দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। অর্থিক অনটনের জন্য বাবা এসএসসি পাশের পর বিয়ে দিয়ে দেন। আর্থিক অনটনের মদ্যদিয়ে সংসার শুরু করলেও নিজ চেষ্টায় ও স্বামীর সহযোগিতায় বিএ পাশ করেন। ২০০১ সালে দাখিল মাদ্রাসায় সহকারি শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করেন।
“সফল জননী” ক্যটাগরীতে মনোয়ারা বেগম। তিনি সদর উপজেলার রহিমানপুর গ্রামের তহিদুল ইসলামের স্ত্রী। আর্থিক অভাব অনটনের মধ্যেও ৩ ছেলেকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলেন। বর্তমানে তিন ছেলেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে চাকুরী করছেন।
“ সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন যে নারী” ক্যাটাগরীতে রিনা বেগম। তিনি সদর উপজেলার রহিমানপুর গ্রামের সেলিম মিয়ার স্ত্রী। রিনা বেগম সমাজের সকল বাধা কুসংস্কার ভেদ করে নারীর ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি বাল্য বিবাহ, যৌতুকসহ নারী নির্যাতন প্রতিরোধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছেন।
জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দ্বায়িত্ব) মোছাঃ জিন্নাতারা ইয়াসমিন বলেন, বেগম রোকেয়া দিবস ও জয়িতা সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে জেলা ও সদর উপজেলার জয়িতাদের সম্মাননা প্রদান করা হয়। এ ধরনের জয়িতা সম্মাননা প্রদান নারীদের জন্য সরকারের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। নারীদের জন্য এটি জাতীয় সম্মাননা এবং আর্তমযার্দার বিষয়। তাদের সকলের প্রতি শুভকামনা।