অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া
১৬ই ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সবচেয়ে গৌরবের দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাঙ্গালী জাতি চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে এবং দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বিজয় দিবস এসেছে অধিক তাৎপর্য ও মহিমা নিয়ে। আজ আমাদের উচিত গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সঙ্গে স্মরণ করা সেসব শহীদের আত্মদানকে এবং বাংলার অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, যাঁর ডাকে সর্বস্তরের মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশকে স্বাধীন করেছে। ১৬ই ডিসেম্বর বিজয়ের মধ্য দিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে জায়গা করে নিয়েছে। গত পাঁচ দশকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে আমাদের অনেক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। দারিদ্র্য কমেছে উল্লেখযোগ্য মাত্রায়; কমেছে শিশুমৃত্যু, মাতৃমৃত্যুর হার। গড় আয়ু বেড়েছে, পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে, স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে, শিক্ষার বিস্তার ঘটেছে।এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্যও আমাদের হৃদয় ও মননে ধারণ করতে হবে। স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণে দলমতনির্বিশেষ সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের যা কিছু অর্জন তা আওয়ামী লীগের হাত ধরেই। মহান বিজয় দিবসের ৫০ বছরের মধ্যে স্বাধীনতা অর্জনে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ দেশ পরিচালনা করে সাড়ে ২১ বছর। দেশের বাজেটের আকার, রাজস্ব আয়, রেমিট্যান্স, দারিদ্র্য নিরসন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো তৈরি ও উন্নয়ন, মানবসম্পদ উন্নয়নে সাফল্য এসেছে। সব কৃতিত্ব জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্বের মধ্যে ৩৯ তম এবং ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে (পিপিপি) ২৯ তম যা দক্ষিণ এশিয়ায় ২য়। বাংলাদেশ গত এক দশক ধরে গড়ে ৬.৩ শতাংশ হার ধরে রেখে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে এবং বর্তমানে বিশ্বের ৭ম দ্রুত উন্নয়নশীল অর্থনীতি। ক্রয়ক্ষমতার সমতা অনুসারে (পিপিপি) বর্তমানে বাংলাদেশে মাথাপিছু জিডিপি ৪,৬০০ মার্কিন ডলার। বিশ্বব্যাংকের ২০১৯ সালের তথ্যানুসারে বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তি ৭,০০,০৯,৩৫৩ জন।
ভাষা আন্দোলন, গণআন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন, স্বাধীনতা যুদ্ধ- স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসের পাতার পরতে পরতে একটিই নাম আওয়ামী লীগ। সব পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর গড়া আওয়ামী লীগ ছিল হার না মানা নেতৃত্বে। এই দলের নেতাকর্মীদের ত্যাগ তিতিক্ষা ও অঙ্গীকারদীপ্ত সংগ্রামী ভূমিকা ইতিহাসবিদিত। স্বভাবতই বাংলাদেশ নামক জাতিরাষ্ট্রের নির্মাতা আওয়ামী লীগের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছেন। আর এখন তার সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হসিনা অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। অনেকে অর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। সেটাও আওয়ামী লীগের হাত ধরে বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বে। উন্নয়নের এই মহাসড়কে রয়েছে পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মহেশখালী মাতারবাড়ী, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর, ঢাকা মেট্রোরেল, এলিভেটর এক্প্রেস ওয়ে, কর্নফুলী টানেলসহ দেশের মেগা প্রকল্পসমূহ।
প্রধানমন্ত্রীর বিচক্ষণ নেতৃত্ব, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা, এমডিজি অর্জন, এসডিজি বাস্তবায়নসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, লিঙ্গ সমতা, কৃষি, দারিদ্র্যসীমা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, রপ্তানীমূখী শিল্পায়ন, ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অ ল, পোশাক শিল্প, ওষুধ শিল্প, রপ্তানী আয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি যা বদলে দিয়েছে দেশের অর্থনীতি। এগুলো সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধু কন্যার হার না মানা মানসিকতা এবং ম্যাজিক্যাল নেতৃত্বের কারণে। যেহেতু ডিসেম্বর বিজয়ের মাস, ১০ ডিসেম্বর সমাবেশ ডাকার মধ্য দিয়ে বিরোধী দল বিএনপি কী নিজেদের রাজনীতির ইতিবাচক তাঁবুতে জায়গা করে নিতে পেরেছে । সাংস্কৃতিক দিক বিবেচনা করলে, তাদের বোধদয়ের ঘাটতি আছে। বিশ্বকাপ ফুটবলের মতো আসর চলছে। সেদিকটা নিয়ে চিন্তা করলেও বোঝা যায়, এরা মানুষের সাংস্কৃতিক মন সম্পর্কে অবগত নন। তারা বন্দুকের নলের ওপর ভর করে পেছনের রাস্তা দিয়েই ক্ষমতা দখল করে কথিত জাতীয়তাবাদী দল একদিন গঠন করেছিল। তাদের মনে আবেগ, দেশপ্রেম স্থান নেয় না, কৃষ্টি জায়গা পায় না। এই ১০ ডিসেম্বর থেকেই ১৯৭১ সালে একটি শ্রেণি দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যার মিশনে নেমেছিল।এছাড়া ১৪ ডিসেম্বর আমাদের বুদ্ধিজীবী দিবস।
১০ ডিসেম্বর বিএনপির একটি রক্তাক্ত সহিংসতা ঘটাতে চায়-স্বাধীনতাবিরোধী ও জনবিচ্ছিন্ন দল বিএনপি তাদের সমাবেশের তারিখ ১৬ ডিসেম্বর অর্থাৎ বাংলাদেশের বিজয় দিবসের পর না দিয়ে কেন ১০ ডিসেম্বর বেছে নিয়েছে, এই প্রশ্ন এখন জনমনে। তারা বলছেন, বিএনপি কি জানে না বাংলাদেশের ইতিহাস?সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নয়, বরং নয়াপল্টনে তাদের সমাবেশ করার জন্য মরিয়া বিএনপি যার অন্যতম কারণগুলো হল-বাংলাদেশের বিজয়ের বিপক্ষে কাজ করেছে জিয়াউর রহমান, তাই তাদের দোসররা ১০ ডিসেম্বর সমাবেশের নামে অগ্নিসন্ত্রাস ঘটাতে চায়।
আন্দোলন ও সমাবেশের নামে বিএনপি নানা অপকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। তারা ভয়াবহ নাশকতা করতে পারে। তারা কৌশলে খালেদা জিয়াকে জনসভায় নিয়ে বিশৃঙ্খলা করবে। তাদের অতীত বিবেচনায় এসব বিষয় নাকচ করা যায় না।আন্দোলনের নামে সারাদেশে এখন বিএনপির সন্ত্রাসীরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। তারা একের পর এক সংঘাত, সহিংসতায় অরাজকতা সৃষ্টি করে চলেছে। এ যাবত যত রাজনৈতিক হত্যাকা- হয়েছে তার প্রত্যেকটির জন্য বিএনপি দায়ী। বিএনপি বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতায় এসে অবৈধভাবে তা দখল করে রাখতে দেশের জনগণের ওপর সীমাহীন অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়েছে। ২০০১-০৬ সালে তারা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২১ হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে। একুশে আগস্টের মতো নারকীয় গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে গণহত্যা সংঘটিত করেছে। অথচ আজ তারা মিথ্যা তথ্য-উপাত্ত দিয়ে গুমের বানোয়াট ও মনগড়া পরিসংখ্যান উপস্থাপন করছে।এই মানবিক সঙ্কটে যখন বিশ্বব্যাপী সকল রাজনৈতিক-সামাজিক সংগঠন সমন্বিত প্রয়াস চালাচ্ছে, তখন বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি ধ্বংসাত্মক রাজনীতির পথ বেছে নিয়েছে। তাদের নেতৃবৃন্দ নৈরাজ্য সৃষ্টির জন্য উসকানি দিচ্ছে। এতেও তারা জনগণের কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে দিগভ্রান্ত হয়ে বিভ্রান্তিকর মন্তব্য করছে।অন্যদিকে কোন ধরনের নাশকতায় তারা জড়ালে বাংলাদেশের মানুষ বসে থাকবে না। এমনিতেই করোনা প্রভাবের পর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার মধ্য দিয়ে সারাবিশ্বমোটেই ভালো নেই। বিএনপি যদি সত্যিই রাজনৈতিক দল হতো, তারা সরকার দলকে অর্থনৈতিক পরামর্শ প্রদান করে নিজেদের প্রমাণ করতে পারত। তারা আসলে ফলত রাজনৈতিক অপশক্তি।
বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার ভঙ্গুর অবস্থান থেকে বাংলাদেশকে একটা শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছেন। করোনা মহামারী ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি আকস্মিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কিছুটা সঙ্কট সৃষ্টি করলেও এগুলো সামাল দেওয়া কঠিন নয় বলেই বিশেষজ্ঞগণ মনে করছেন।বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য হলো আমরা দেশের স্বার্থে সবাই ঐক্যবদ্ধ হতে পারি না। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তি পাগল একদল লোক দেশের জন্য যুদ্ধ করেছে, আরেক দল লোক সাহায্য-সহযোগিতা করেছে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীকে। সেই ধারা এখনো অব্যাহত আছে। সুযোগ পেলেই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি আবার জেগে উঠবে। বাংলাদেশকে বিধ্বংস্ত, বিপর্যস্ত করলে কারা লাভবান হয় এটা এদেশের মানুষ এখন বুঝতে শিখেছে। সাধারণ মানুষের কথাচিন্তা করে বর্তমান সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছেন সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।
লেখক: কোষাধ্যক্ষ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়; সাবেক চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।