মো. সাখাওয়াত হোসেন
পত্রিকার খবরে জানা যায়, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও তার স্ত্রী ডা. জোবায়দা রহমানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। মঙ্গলবার (১ নভেম্বর) ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আছাদুজ্জামান এ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। মামলা সূত্রে জানা যায়, বৈধ আয়ের বাইরে ৪ কোটি ৮১ লাখ ৫৩ হাজার ৫৬১ টাকার মালিক হওয়া এবং সম্পদের তথ্য গোপন ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০০৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর কাফরুল থানায় মামলা করে দুদক। মামলায় তারেক রহমান, জোবায়দা রহমান এবং তারেক রহমানের শাশুড়ি ইকবাল মান্দ বানুকে আসামি করা হয়। ২০০৮ সালে তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। এরপরই মামলা বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেন জোবায়দা। ওই বছরই এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মামলার কার্যক্রম স্থগিত করে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। এর বিরুদ্ধে আপিল করলে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের আদেশ বহাল রাখেন।
সন্দেহাতীতভাবে উল্লেখ করা যায়, এ রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপিকে বিভিন্ন রকমের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। উল্লেখ করার মত বিষয় হচ্ছে, এ রায়ের প্রেক্ষিতে বিএনপিকে আন্তর্জাতিকভাবেও অনেক প্রতিবন্ধকতাকে মোকাবেলা করতে হবে। আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশের দূতাবাস ও কূটনৈতিকদের সন্মুখেও এ ব্যাপারে বিএনপিকে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। এমনিতেই বিএনপিকে দলের ভেতর ও বাইরে বিভিন্ন বিষয়ে নিয়ে প্রশ্নের সন্মুখীন হতে হচ্ছে। সে হিসেবে এ সময়ে এমন একটি মামলার গ্রেফতারি পরোয়ানা বিএনপির জন্য শাপেবর। তৃণমূলের সাথে বিএনপির সিনিয়র নেতৃবৃন্দের দূরত্বের কথা বিভিন্ন মাধ্যমে ভেসে আসছে এবং খবরগুলো অধিকাংশই সত্য। তাছাড়া বিভিন্ন ইউনিটে কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করেও বিএনপির মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও আক্রোশের সৃষ্টি হয়েছে। সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বিএনপির অনেক সিনিয়র নেতৃবৃন্দ দল থেকে পদত্যাগ করেছে, আবার কেউ কেউ পদত্যাগে বাধ্য হয়েছে। সে কারণেই দলের মধ্যে গৃহবিবাদ সৃষ্টি হয়েছে এবং চরম পর্যায় ধারণ করেছে। দলের শৃঙ্খলার স্বার্থে অনেকেই সেটি প্রকাশ্যে নিয়ে আসছে না কিন্তু বিশৃঙ্খলা চলমান দলটিতে। তথাপি, ইদানিং বিভিন্ন সভা সমাবেশে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের অতিকথন সাধারণ মানুষের মধ্যেও বিএনপিকে নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। সে সকল কারণেই দল হিসেবে বিএনপি কিছুটা হলেও চাপের মধ্যে রয়েছে। তাছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানার সংবাদটি দল হিসেবে বিএনপিকে খুব বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে।
প্রথমত: এ রায়ের ফলে বিএনপির নেতাদের মনোবল ভেঙ্গে পড়বে। আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশব্যাপী যখন দলটি দল গোছানোর কাজে ব্যতিব্যস্ত সময় পার করছে ঠিক এ সময়ে এ ধরনের একটি রায় দলের নেতাকর্মীদের মনে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করবে। দ্বিতীয়ত: এ রায়ের ফলে দলের ভেতর সুযোগসন্ধানীরা সুবিধা গ্রহণের পায়তারা করবে। ১/১১ এর সময়ে বিএনপির সংস্কারপন্থীদের দাপট দেখেছে দেশবাসী। তাছাড়া দলের চেয়ারপার্সন একপ্রকার কারান্তরীন, জামিন নিয়ে বাড়িতে অবস্থান করছেন। দলটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান দেশের বাইরে অবস্থান করছে। নেতৃত্ব সংকটের এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সুযোগসন্ধানীরা দল ভাঙ্গা কিংবা দলের দায়িত্ব গ্রহণের পায়তারা করবে না এটা হলফ করে বলা যায় না। এ কারণেই দলটি দোদুল্যমান পর্যায়ে থেকে ভবিষ্যৎ রাজনীতির গতি প্রকৃতি নির্ধারণে কঠিন সংকটে পতিত হবে।
তৃতীয়ত: নেতাকর্মীদের মধ্যে দ্বিধা বিভক্তির সৃষ্টি হবে। পদ-পদবীর বিভক্তিতে দলে বেশকিছু মেরুকরণ রয়েছে। তাছাড়া বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্তদের সঙ্গে সাধারণ কর্মী সমর্থকদের একটি অঘোষিত দূরত্ব রয়েছে। অবিশ্বাস, আস্থাহীনতা ইত্যাদির পাশাপাশি এ রায়ের ফলে নেতাকর্মীদের সঙ্গে তৃণমূলের দূরত্ব ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাবে। তৃণমূল মনে করে সিনিয়র নেতৃবৃন্দ বিএনপির চেয়ারপার্সন ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানকে আইনগত দিক মোকাবেলায় সর্বোচ্চ প্রায়োরিটি না প্রদান করায় দলের এ পরিণতি ভরণ করতে হচ্ছে। সুতরাং তাদের মধ্যকার দূরত্ব ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে অর্থাৎ বিএনপির সিনিয়র নেতৃবৃন্দ ও তৃণমূলের বিরোধ দিন দিন আরও প্রকাশ্যে চলে আসছে।
চতুর্থত: বিএনপি বাদে বাকি দলগুলো এ বিষয়টি থেকে সাধারণ জনগণের কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ পাবে। নির্বাচনী প্রচারণায় বাকি দলগুলো বিএনপির সিনিয়র নেতৃবৃন্দের ব্যর্থতাকে পুঁজি করে ভোটারদের কাছে সহজেই এক্সেস পাবে। সুতরাং বর্তমান সময়ে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা বিএনপিকে বিভিন্নভাবে বেকায়দায় ফেলেছে। তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় সাধারণ জনগণও প্রত্যেকটি বিষয় সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল, এ বিষয়টিও বিএনপির বিরোধী পক্ষকে বিএনপি বিরোধী প্রচারণায় রসদ যোগাবে।
প মত: নেতৃত্ব সংকটের আশঙ্কা প্রবলভাবে আবির্ভূত হবে। ক্ষমতায় এলে বিএনপির নেতৃত্ব দিবে কে, সে বিষয়ে প্রশ্ন রেখে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য দল আলোচনার খোরাক জন্মায়। এ প্রশ্নটি পর্যায়ক্রমে বিএনপির তৃণমূল ও সাধারণ ভোটারদের মনে নির্বাচনী বাস্তবতায় বেশ জোরালো প্রভাব ফেলবে। কেননা বিএনপির সিনিয়র নেতৃবৃন্দ গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ সাপেক্ষে নির্বাচনে জয়লাভ প্রায় অসম্ভব। সে জন্যই এ রায়টি বিএনপির নেতৃত্ব সংকটকে প্রবলভাবে ঘনীভূত করবে।
ষষ্ঠত: বিএনপি নির্বাচনে হস্তক্ষেপের জন্য যে সকল কূটনৈতিকদের দ্বারস্থ হয়েছে বা ভবিষ্যতে হবে তাদের নিকট তারেক রহমানের গ্রেফতারি পরোয়ানার বিষয়টি ব্যাপকভাবে গুরুত্ব পাবে। এ বিষয়টি বিএনপির ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব সংকটের অচলাবস্থা নিয়ে কূটনীতিকদের বিএনপির রাজনীতি ও ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার জন্য খোরাক জোগাবে। সে সূত্র মোতাবেক বিএনপির দাবি দাওয়া ও অভিযোগকে কূটনীতিকরা তেমন পাত্তা দিবে বলে মনে হয় না। পাশাপাশি বিএনপির শাসনামলে বাংলাদেশ বিশ্বে দুর্নীতির যে চিত্র এঁকেছিল সে বিষয়টি কূটনীতিকগণ সামনে নিয়ে আসতে পারেন বিশেষ করে তারেক রহমানের গ্রেফতারি পরোয়ানার ভিত্তিতে।
শেষত: সাধারণ জনগণের নিকট দল হিসেবে বিএনপির গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে চলে আসবে। এ কারণেই অভিযোগ তোলার সুযোগ পাবে, যে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয় সে দলের জনমত স্বাভাবিকভাবে তলানিতে নেমে যাবে। পাশাপাশি অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়টিকে সামনে নিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে তারা যুদ্ধ ঘোষণা দিয়ে তাদের নির্বাচনী ইশতেহার প্রদান করে মানুষের ভোট আকর্ষণের প্রচেষ্টা চালাবে।
সুতরাং বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা কার্যত বিএনপিকে একটা সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এ রায়ের ফলে দলের মধ্যে বিশ্বাস-অবিশ্বাস, আস্থা-অনাস্থার সংকট সৃষ্টি হবে। সে কারণেই প্রতিকূলতা ও পারিপ¦ার্শিকতাকে মোকাবেলা করেই বিএনপিকে জনগণের সঙ্গে একাতœ হয়ে ভোটের মাঠে ভূমিকা রাখতে হবে। এ ধরনের কর্মক্ষম ভূমিকা দল হিসেবে বিএনপি রাখতে পারবে কিনা সময়ই তা বলে দিবে। তার জন্য বিএনপির সিনিয়র নেতৃবৃন্দকে জনগণমুখী হয়ে জনবান্ধব কর্মসূচি প্রণয়ন করতে হবে, জ্বালাও পোড়াও এর রাজনীতি পরিহার করতে হবে।
লেখক-সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।