অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া
সভা সমাবেশ রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনৈতিক কর্মসূচির অংশ। সময়ে সময়ে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের সংগঠনকে চাঙ্গা রাখার জন্য সভা সমাবেশের আয়োজন করে থাকে। তবে একটি রাজনৈতিক দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবলম্বন হচ্ছে সাধারণ জনগণের সমর্থন যা জনকল্যাণমুখী রাজনৈতিক দলের পক্ষেই অর্জন করা সম্ভব। দীর্ঘদিন জনবিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা রাজনৈতিক দলগুলো যখন সভা সমাবেশ করার মতো উদ্যোগ গ্রহণ করে তখন তাদের অবলম্বন হয়ে উঠে টাকা, যার মাধ্যমে তারা লোক ভাড়া করে সমাবেশের কাটতি বাড়িয়ে থাকে। বর্তমানে বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূচি গুলোতে এই বিষয়গুলো প্রতীয়মান হচ্ছে। তাদের কর্মসূচি গুলোতে জনকল্যাণমূলক কোনো দাবির বালাই পাওয়া যাচ্ছেনা। যেখানে বৈশ্বিক
অর্থনৈতিক সংকটের কারণে দেশের জনগণ তাদের প্রাত্যহিক জীবন চালাতে হিমশিম খাচ্ছে, সরকার জনগণের দুর্ভোগ লাভে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে, সেখানে একটি দলের রাজনৈতিক কর্মসূচি শুধু ক্ষমতায় যাওয়া কেন্দ্রীকই মনে হচ্ছে। তাদের ভাষ্যমতে বিএনপি ক্ষমতায় আসলে একরাতের মধ্যে দেশের ভাগ্য পরিবর্তন হয়ে যাবে। এমন আকাশ কুসুম অলীক কল্পনার মাধ্যমে কিছুটা উদ্দীপনা সৃষ্টি করা গেলেও জনগণের সমর্থন অর্জন করা সম্ভব হবেনা। সমাবেশে মানুষের উপস্থিতি কীভাবে বাড়ানো যায় সেই সম্পর্কে রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ সকলেই অবগত আছেন। প্রশ্ন হলো যারা সমাবেশে আসছেন তারা সবাই কী ঐ দলকে সমর্থন করেন? কিংবা ওই দলের প্রতিকে ভোট দিয়ে তাদের জয়যুক্ত করবেন? আজকাল সমাবেশে লোকজন কিভাবে বাড়াতে হয় সে সক্ষমতা সব দলেরই আছে বোধ করি। কেন্দ্রীয় নেতারা নির্দেশ দেন- ‘সমাবেশে এত লোকের সমাগম চাই’।
মাঠ পর্যায়ের নেতাদের নিদৃষ্ট হারে লোক আনার নির্দেশনা থাকে। নেতারাও নেতৃত্ব টিকিয়ে রাখতে সভা সমাবেশে ভাড়ায় লোকজন আনে। পত্র-পত্রিকা, টিভি মিডিয়ায় সেসব হাস্যকর সংবাদ পরিবেশনও করা হয় দেখি। একটু ষ্পষ্ট করে বলি- এদেশের বহু মানুষ এখন সমাবেশে ভাড়া খাটেন। তাদের কাছে দল কোন বিষয় না। সেটা বিএনপি কিংবা আওয়ামী লীগ তা যাই হোক। কটা টাকা হলে দু-এক বেলা খাবার মিললেই হলো। তারা আজ এ দলের সমাবেশে যাচ্ছেন তো কাল যাচ্ছেন তাদেরই বিরোধী দলের সমাবেশে। দল বুঝে শ্লোগানও দিচ্ছেন বেশ। শুধু সমাবেশে লোকসমারহ দিয়েই প্রকৃত জনসমর্থন পরিমাপ করা সম্ভব নয়। জনকল্যাণে অবদান রাখার মাধ্যমেই জনগণের হৃদয়ে স্থান করে নেওয়া সম্ভব। দীর্ঘদিন বিএনপি মূলধারার রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে নিজেদেরকে বিরত রেখেছিল। এ পর্যন্ত তাদের যুব, ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক যত সংগঠন আছে সবার মুখেই দাবি দুইটা খালেদা জিয়ার মুক্তি চাই, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চাই। এই দুইটি দাবির সাথে জনগণের বিন্দুমাত্র স্বার্থ জড়িত নেই। তার কারণে তাদের সভা সমাবেশ গুলো ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছিল। ইদানীং তাদের বিভাগীয় সমাবেশ গুলোতে দ্রব্যমূল্য তেলের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে প্রতিবাদের কথা বলে লোক আনিয়ে পূর্বের ন্যায় একই কথার পুনরাবৃত্তি করা হচ্ছে। যার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে তাদের উদ্দেশ্য একটাই, যেকোনো উপায়ে ক্ষমতার্জন।
বাংলাদেশে ক্ষমতার্জনের একমাত্র হাতিয়ার হচ্ছে জনগণ। জনগণের প্রকৃত কল্যাণে যারা ভূমিকা রাখে তাদেরকেই প্রকৃত জনবান্ধন দল হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। অতীতে বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন এদেশকে জঙ্গিবাদের আস্তনা বললেও অত্যুক্তি হবেনা। শিক্ষাগণে সন্ত্রাস, মাদক ব্যবসা, টেন্ডারবাজি, খুন, রাহাজানি, সন্ত্রাসী গংদের আধিপত্য, বিদ্যুৎ বিভ্রাট, বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিদের নির্মূল, রাজাকারদের পৃষ্ঠপোষকতা সহ বিভিন্ন জনবিরোধী কর্মকান্ডে পুরো দেশ হয়ে পড়েছিল অশান্ত। তাদের সীমাহীন দুর্নীতি দেশকে দুর্নীতিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার মতো লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে ফেলেছিল। সেই অবস্থাকে অতিক্রম করে বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব ১৯ ক্রিকেট দল এখন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়, বাংলাদেশের নারী ফুটবল দল সাফচ্যাম্পিয়ন হয়। এদেশের শিক্ষাঙ্গন এখন পুরোপুরি সন্ত্রাসমুক্ত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে সেশনজট বিষয়টি এখন হয়ে উঠেছে অপরিচত। করোনার পূর্ববর্তী সময়ে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৮.১৫%। বৈশ্বিক মহামারী করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বাংলাদেশের অপ্রতিরোধ্য অগ্রগতিতে সবচেয়ে বড় আঘাত হানে। এর মধ্যেও এদেশের অর্থনীতি শীর্ষ পাঁচ স্থিতিশীল অর্থনৈতিক দেশগুলোর তালিকায় স্থান করে নেয়। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই উন্নয়নশীল দেশগুলোর তালিকায় স্থান করে নিয়েছে, এখন শুধু আনুষ্ঠানিকতাই বাকি। স্বপ্নের পদ্মাসেতু বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। দেশের মানুষ এখম সাময়িক অসুবিধার মধ্যে পড়লেও তারা মোটেও আশাহত নয়, কেননা বর্তমান এই দুর্যোগ বৈশ্বিক। এই বৈশ্বিক বিপর্যয়ের মোকাবেলায় দরকার ঐক্য। সেখানে শুধু ক্ষমতা লাভের জন্য সভা সমাবেশ কখনোই জনকল্যাণমূলক হতে পারেনা। অতীতে আমরা অগ্নিসন্ত্রাস দেখেছি, পেট্রোল বোমার তান্ডব দেখেছি, মানুষ আর সেই দিকে ফিরে যেতে চায়না।
জনগণ চায়না বর্তমান সময়ের এই উন্মাদনা সহিংসতায় রূপ নিক। জনগণ চায় তাদের জীবনের নিরাপত্তা, জনগণ চায় বিশৃঙ্খলামুক্ত রাজনৈতিক পরিবেশ, জনগণ চায় উন্নত রাষ্ট্রের সদস্য হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাড়াতে। জনগণের এই চাওয়া পাওয়াকে বৃদ্ধাআঙ্গুলী দেখিয়ে শুধু ক্ষমতা যাওয়াকে একমাত্র লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে যতই সভা সমাবেশের আয়োজন করা হোক না কেন, তার দ্বারা আর যাই হোক জনসম্পৃক্ততা আশা করা যায়না। যেকোন দেশের রাজনৈতিক দলের শান্তিপূর্ণ সভাসমাবেশ করা গণতান্ত্রিক অধিকার। এর মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের কর্মসূচি ও পরিকল্পনার কথা দেশবাসীকে জানাতে পারে। সেসব সমাবেশে সরাসরি কিংবা ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে বাঁধা সৃষ্টি শান্তিকামী মানুষকে উদ্বিগ্ন না করে পারে না।
যেকোন দলের রাজপথে ফয়সালা কিংবা রাজপথ দখল করার হুমকি-ধমকি কোনোভাবে কাম্য নয়। এমনিতেই দেশে অর্থনৈতিক সংকট চলছে। বাজার অস্থির। মানুষের পণ্য কেনার ক্ষমতা কমছে। এ অবস্থায় বিএনপি কিংবা অন্য কোন দলের অস্থির পরিস্থিতি তৈরি করা মোটেও ঠিক হবে না। অন্য দিকে সরকারও যেন কোনভাবে সংঘাতের পথে পা না বাড়ায় তা দেশের জন্য মঙ্গলকর।
পরিশেষে বলতে চাই, দলে দলে সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হয় এমন কাজ থেকে সবাইকে দূরে থাকতে হবে। প্রতিপক্ষকে রাজপথে মোকাবিলা কিংবা ফয়সালার পরিণাম; সেসঙ্গে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলে দেশের অভ্যন্তরেও কিংবা বহিবিশ্বে সংঘাত তৈরি করার চেষ্টা কখনো মঙ্গলজনক হবে না। বঙ্গবন্ধুর কন্যা যতদিন নেতৃত্বে থাকবেন, ততদিন পথ হারাবে না বাংলাদেশ।
লেখক: কোষাধ্যক্ষ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়; সাবেক চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।