সরকারি খাতের অর্থ আত্মসাৎ এবং একাধিক ঘটনায় বিতর্কিত পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাশফাকুর রহমান ‘পুলিশ প্রটোকলে’ বিদায় নিয়েছেন।
শুক্রবার (৩ ডিসেম্বর) দুপুরে রাঙ্গাবালী উপজেলা চত্বর থকে পুলিশ প্রটোকলে তাকে বিদায় নিতে হয়েছে। এমন কিছু ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।
এর আগে ইউএনও মাশফাকুর শরীয়তপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) হিসেবে পদন্নোতি পেলেও নানা কারণে তাকে অবমুক্ত করেনি পটুয়াখালী জেলা প্রশাসন। গত ২৮ সেপ্টেম্বর তাকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এপিডি অনুবিভাগে যুক্ত করা হয়। কিন্তু ইউএনও যথাযথভাবে দায়িত্ব হস্তান্তরে ব্যর্থ হওয়ায় তিনি অবমুক্ত হননি। সর্বশেষ ১ ডিসেম্বর তাকে অবমুক্ত করেন পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামাল হোসেন। এদিকে দীর্ঘদিন রাঙ্গাবালী উপজেলায় ইউএনও ও নির্বাহী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেও পুলিশ প্রটোকলে বিদায় নেওয়ার ঘটনা অস্বাভাবিক মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
পটুয়াখালী জেলা প্রশাসন সূত্রে ও রাঙ্গাবালীর বাসিন্দাদের থেকে জানা গেছে, উপজেলার ৯টি হাট-বাজারের বিপরীতে খাস টোল হিসেবে আদায় করা তিন বছরের অন্তত চার কোটি টাকা কোষাগারে জমা না দিয়ে ইউএনও আত্মসাৎ করেন। এ ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর নির্মাণ না করে অর্থ আত্মসাৎ, নিজ কার্যালয়ের কর্মচারীকে মারধরসহ নানা অভিযোগের ঘটনায় তদন্তে সত্যতা পেয়েছে জেলা প্রশাসন। এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন মন্ত্রী পরিষদ বিভাগে পাঠান জেলা প্রশাসক।
ইউএনও কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে ডিসির পাঠানো ওই সুপারিশ প্রতিবেদনে বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার সুপারিশ করেছেন বলে নিশ্চিত করে জেলা প্রশাসন। ডিসির পাঠানো ওই প্রতিবেদনে আরও একাধিক অভিযোগ উল্লেখ করা হয়েছে। অপরদিকে মুজিববর্ষের ঘর নির্মাণে ইউএনও’র নিয়োগ করা ঠিকাদার মাইদুল ইসলাম শাওনের অভিযোগ সংক্রান্ত ঘটনা নিষ্পত্তি করতে পারেনি জেলা প্রশাসন। ডিসির কাছে শাওনের এক ব্যক্তির দেওয়া অভিযাগের ঘটনায় একাধিকবার সাক্ষ্য নিয়েও জেলা প্রশাসনের ব্যর্থতায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মুজিববর্ষের ঘর নির্মাণের কাজ দিতে রাঙ্গাবালী উপজেলার ছোটবাইশদা ইউনিয়নের ইউপি সদস্য মিন্টুর কাছ থেকে এক গণমাধ্যমকর্মীর মাধ্যমে ১০ লাখ টাকা নেন ইউএনও। যে টাকা ফেরত দেওয়ার কথা বলে দেননি।
বড়বাইশদা ইউনিয়নের সাকুর মৃধা দাবি করেন, ‘মুজিববর্ষের ঘর পেতে এলাকার দুস্থ পরিবারের কাছ থেকে দুই লাখ ২০ হাজার টাকা তুলে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আবু হাসনাত আব্দুল্লাহর মাধ্যমে ইউএনওকে দেন তিনি। ঘর না পেয়ে ভুক্তভোগীরা আমাকে টাকার জন্য চাপ দিলেও ইউএনও-এর কাছ থেকে তিনি ওই টাকা ফেরত নিতে পারিনি।’
বড়বাইশদা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আবু হাসনাত আব্দুল্লাহ দাবি করেন, ‘মুজিববর্ষের ঘর বাবদ ইউএনও-এর কাছে এক লাখ ৯০ হাজার টাকা পাওয়া ছিল। রাঙ্গাবালী থেকে বিদায় নেওয়ার আগ মুহূর্তে তিনি ২০ হাজার টাকা হাতে ধরিয়ে বাকি টাকা পরে শোধ করবেন বললেও করেননি।’
অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য আবুল কালাম আজাদ দাবি করেন, ‘রাঙ্গাবালীর বাহেরচর বাজারে খাস জমিতে তার একটি দোকান ঘর ছিল। ওই জমির ডিসিআর নিতে ইউএনওকে এক লাখ টাকা দেন তিনি। কিন্তু ইউএনও তাকে ডিসিআর দেননি এবং টাকাও ফেরত দেয়নি। টাকা ফেরত দেওয়ার কথা বলে তিনি শুক্রবার পুলিশ প্রটোকলে রাঙ্গাবালী থেকে বিদায়।’
চরমোন্তাজ ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবু হানিফ মিয়ার ছেলে রিপন মিয়া দাবি করেন, ‘মুজিববর্ষের ঘর দেওয়ার কথা বলে আমার বাবার কাছ থেকে ইউএনও দুই লাখ টাকা নেন। পরে ঘর ও টাকা কিছুই দেননি।’
রাঙ্গাবালী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের মোটরসাইকেল চালক হিরন হাওলাদার বলেন, ‘মুজিববর্ষের ঘর নির্মাণ বাবদ ইউএনও-এর কাছে এক লাখ ৫৮ হাজার টাকা পাই। শুক্রবার ইউএনও চলে যাওয়ার সময় ওই টাকা চাইলে অফিসের নাজির মিরাজুল ইসলাম পরিশোধ করবে বলে আশ্বস্ত করেন।’
রাঙ্গাবালী থানার ওসি নুরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, ‘উপজেলা পরিষদের একটিমাত্র গাড়ি, যেটা নিয়ে সহকারী কমিশনার কাজে গেছেন। ইউএনও উপজেলা পরিষদ থেকে মোটরসাইকেল যোগে কোড়ালিয়া লঞ্চঘাটে রওনা দিয়েছেন। তাই আমি তাকে আমার গাড়িতে পৌঁছে দিয়েছি। পুলিশ প্রটোকলে বিদায় নিয়েছেন এটা সত্য নয়।’
রাঙ্গাবালী উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) সালেক মুহিদ বলেন, ‘এখানে একটি মাত্র গাড়ি। সেটা সাময়িকভাবে বিকল থাকায় চালক আমার সঙ্গে রয়েছে। তাই ইউএনও স্যারকে গাড়ি দিতে পারিনি। পুলিশ প্রটোকলে বিদায় নেওয়ার কথা গুজব।’
এদিকে দীর্ঘদিন একই স্থানে চাকরি করলেও ইউএনও মাশফাকুর রহমানকে কোনও বিদায়ী সংবর্ধনা দেওয়া হয়নি। তার বিদায় বেলাতে উপজেলা চত্বরে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিল। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন উপজেলা পরিষদের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী। সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন