#মৃত শিশুর পিতা মাতার সঙ্গে গোপনে সমঝোতার প্রস্তাব হাসপাতালের চেয়ারম্যান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (অডিও রেকর্ড) #হাইকোর্টে রিট আবেদন, স্বাস্থ্য সচিবসহ ৬ জনকে জবাব দিতে রুল জারি #রোগীদের আস্থা কমে যাওয়ায় বিপাকে বিএসএইচ
বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার সাথে সাথে চিকিৎসা বিজ্ঞানেরও অভূতপূর্ব উন্নতি নিয়ে যখন বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে, তখন বাংলাদেশের একটি বেসরকারি হাসাপাতাল যেন মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে। গত এক বছরেই কমপক্ষে ৪ জন রোগীকে ভুল চিকিৎসায় মরতে হয়েছে এমন অভিযোগ উঠার পর থেকে রাজধানীর শ্যামলীতে অবস্থিত বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতাল যেন এক মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে, এমনটাই দাবি করছেন মারা যাওয়া রোগীর স্বজন থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্টরা।
এছাড়া এই হাসাপাতালের দায়িত্বরত চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, সঠিক সময়ে সেখানে রোগীদের চিকিৎসা না দেয়ার। ভুল চিকিৎসার মৃত্যুর অভিযোগ নিয়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্টে ডিভিশনে ৭ নভেম্বর রিট আবেদনও করেছেন সন্তান হারা মা জোবাইদা আলম। রিট পিটিশন নাম্বার: ১৩২৩৭/২০২২। এই রিটের শুনানির পর গত ১৭ নভেম্বর হাইকোর্ট ভিডিশনের বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের এবং বিচারপতি মোহাম্মদ আলীর বেঞ্চ রুল জারি করেন। সেখানে স্বাস্থ্য সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের রেজিস্ট্রার, বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ ভুল চিকিৎসার অভিযোগে অভিযুক্ত ডা. মো. মাইনুল ইসলাম এবং প্র. ডা.ইসরাত জাহান লাকিকে তিন সপ্তাহের লিখিতভাবে জবাব দিতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
উল্লেখ্য, সর্বশেষ গত ১০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় মরিয়ম জামান আরফিয়া নামে আট বছর বয়সী ফুটফুটে এক শিশু। পরিবারের অভিযোগ, ভুল চিকিৎসায় তার মৃত্যু হয়েছে। যে দুই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে পরিবার অভিযোগ তুলেছে তারা হলেন: ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হেমাটোলোজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মনিরুল ইসলাম ও ডা. ইসরাত জাহান লাকি।
মারা যাওয়া শিশু আরফিয়ার মা জোবাইদা আলম সম্প্রতি ভোরের পাতাকে বলেন, ডা. মো. মনিরুল ইসলামের পরামর্শে আমি মেয়েকে গত ৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে ভর্তি করি। এরপর সেখান থেকে সকাল ১০টার দিকে ১০ নম্বর ওয়ার্ডে পাঠানো হয়। পরদিন ওয়ার্ড থেকে আমাদের না জানিয়ে পিআইসিইউতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং এক ঘণ্টা পর আবারও ওয়ার্ডে আনা হয়।
তিনি বলেন, চিকিৎসক মেয়ের ব্লাড ও ইউরিন স্যাম্পল পরীক্ষার জন্য পাঠান। তাকে স্যালাইন দেওয়া হচ্ছিল। এ সময় ডা. ইসরাত জাহান লাকী এসে তাকে ইনজেকশনের মাধ্যমে হাই পাওয়ারের অ্যান্টিবায়োটিক পুশ করেন। বিকেল ৪টায় ডা. মো. মনিরুল ইসলাম এসে বলেন, মেয়ের টাইফয়েড হয়েছে। এরপর তাকে একের পর এক অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন দিতে থাকেন তারা। জোবাইদা আলম বলেন, তারা আমাকে প্রথমে বলেন, মেয়ের বুকে ইনফেকশন হয়েছে। আমি এক্স-রে করার জন্য বলি। এক্স-রে রিপোর্ট ভালো আসে। এরপর তারা বলেন, মেয়ের টাইফয়েড হয়েছে। এবার টাইফয়েডের জন্য একাধিক অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন পুশ করেন।
তিনি বলেন, তারা শুরু থেকে আমার মেয়ের থ্যালাসেমিয়া রোগের চিকিৎসা করেননি। তার হিমোগ্লোবিন ৭ দশমিক ১- এ এলেও রক্ত না দিয়ে কেবল টাইফয়েডের ইনজেকশন পুশ করতে থাকেন। সব যখন শেষ তখন তারা আমাদের ডেঙ্গুর কারণে মারা গেছে বলে মিথ্যা ডেথ সার্টিফিকেট দেন। হাসপাতালে ভর্তির ২ দিন পর ১০ সেপ্টেম্বর ভোরে মারা যায় শিশু আরফিয়া।
‘ভুল চিকিৎসার সব প্রমাণ’ নিয়ে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরে ফিরছেন জোবাইদা আলম। ডা. মনিরুল ইসলাম ও ডা. ইসরাত জাহান লাকির বিচার চেয়ে মামলাও করবেন তারা। ভুল চিকিৎসার প্রতিকার চেয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছেও অভিযোগ দিয়েছেন। সঙ্গে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের ভুল চিকিৎসার প্রমাণপত্রও দিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
আরফিয়ার বাবা আরিফ উজ জামান কান্না জড়িত কণ্ঠে ভোরের পাতাকে বলেন, ‘ডা. মনিরুল ইসলাম ও ডা. ইসরাত জাহান লাকি কোনো রোগ শনাক্ত না করে চিকিৎসা করতে গেলেন। উনি (ডা. ইসরাত) কেন হাইপাওয়ার অ্যান্টিবায়োটিক ইঞ্জেকশন পুশ করতে গেলেন? উনি ওভার কনফিডেন্ট হয়ে আমার মেয়েকে বার বার ভুল ওষুধ প্রয়োগ কেন করেছেন। আমার সব আশা ভরসা শেষ। শুরুতেই তিনি ভুল করেছেন। উনার গাফিলতির জন্যই আমার কলিজার টুকরাকে হারিয়েছি। আমার স্ত্রী দিনরাত কবরের পাশে পড়ে থাকেন। এ ঘটনার পর থেকে হাসপাতালে যাচ্ছেন না দুই ডাক্তার। ফোনেও পাওয়া যায়নি তাদের। যেহেতু অভিযোগ হাসপাতালের ডাক্তার এবং ম্যানেজমেন্টের বিরুদ্ধেই, তাই সব প্রশ্ন এড়িয়ে গেছেন হাসপাতাল ম্যানেজার।’
এদিকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ দিয়েও কোনো সদুত্তর পায়নি বলে জানিয়েছে ভুক্তভোগী পরিবারটি। মেডিকেল কাউন্সিলেও ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন তারা।
হাসপাতাল থেকে কেউ এই দুর্ঘটনার পর কথা বলতে আসেনি জানিয়ে শিশুটির মা জোবাইদা আলম বলেন, আমরা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তাদের থেকে কোনো উত্তর পাইনি। আমাদের সঙ্গে যা হয়েছে তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। আমার মেয়েটাকে তারা হত্যা করেছে। আমাদের আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার একটাই কারণ, অন্যায় হলে তার প্রতিবাদ অবশ্যই করতে হবে বলে আমরা মনে করি। এই অমানবিক ঘটনার জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রত্যাশা করি এবং এরকম ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না হয়। তার সঙ্গে সঙ্গে দোষী চিকিৎসকের দৃষ্টান্তমূলক সাজা যেন হয়, এটাই আমাদের চাওয়া।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় মরিয়ম জামান আরফিয়া ১০ সেপ্টেম্বর। এরপর ২৩ সেপ্টেম্বর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার এ এম কবির বরাবর সন্তানহারা মা জোবাইদা আলম তিন পৃষ্ঠার একটি অভিযোগ জমা দেন। এছাড়া আদাবর থানায় একই দিন একটি সাধারণ ডায়েরী করেন। এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরে লিখিতভাবে অভিযোগ জমা দিলেও কোনো প্রতিকার না পেয়ে তিনি মাননীয় হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করেন। এরই মধ্যে গত ২ মাসের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের চেয়ারম্যান প্র. ডা. মো. শামসুল আরফিন এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার এ এম কবির জোবাইদা আলম এবং তার স্বামী আরিফ উজ জামানের সঙ্গে গোপনে বসে সমঝোতা করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এমনকি সরাসরি মুঠোফোনে জোবাইদা আলমের সাথে হাসপাতালের চেয়ারম্যান প্র. ডা. মো. শামসুল আরফিনের ২ মিনিট ৩৬ সেকেন্ডের একটি অডিও এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার এ এম কবিরের সাথে জোবাইদা আলমের সাথে ১৬ মিনিট ৪০ সেকেন্ডের একটি অডিও ভোরের পাতার হাতে সংরক্ষিত রয়েছে। এরপরও নানা সময়ে তারা জোবাইদা আলম এবং তার স্বামী আরিফ উজ জামানকে নানামুখী চাপ দিয়ে সমঝোতা (নেগোশিয়েশন) করার কথা বলেছেন।
অভিযুক্ত চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে গোপনে অনেক গণমাধ্যমকেও অনৈতিক সুবিধা দিয়ে নিউজ আটকিয়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে বলে ভোরের পাতা নিশ্চিত হয়েছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পক্ষ থেকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার এম এ কবির গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশ স্পেশালাইজড বিষয়টি নিয়ে কিছুদিন আগে রোগীর মা আমাদের কাছে একটা লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন। আমরা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করি। তদন্ত কমিটির রিপোর্টে আমরা ভুল চিকিৎসার সত্যতা পাইনি। তিনি বলেন, তদন্ত কমিটির রিপোর্ট তাকে পাঠিয়েছি। একইসঙ্গে ওই রিপোর্টের মধ্যে আমরা তাকে আমন্ত্রণও জানিয়েছি। তাকে বলেছি, আপনার যদি কোনো কথা থাকে তাহলে এসে বলতে পারেন। এ ছাড়া ওই ঘটনায় আমরা মর্মাহত হয়েছি, তাও উল্লেখ করেছি।
তদন্ত প্রতিবেদনে মৃত্যুর কী কারণ উঠে এসেছে— জানতে চাইলে তিনি বলেন, রোগী থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত ছিল। এর মধ্যে তীব্র জ্বর নিয়ে সে হাসপাতালে ভর্তি হয়। জ্বরের হিস্ট্রিটা ছিল হাই ফিভার। যেহেতু এখন ডেঙ্গু বেশি হচ্ছে বাচ্চাদের, সেই রোগী আমাদের হাসপাতালে আসার পর ডেঙ্গুসহ বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা আমরা দিই। কিন্তু পরীক্ষায় তার ডেঙ্গু পজিটিভ আসেনি, আসার কথাও না। কারণ, পাঁচদিনের মাথায় পরীক্ষা করলে ডেঙ্গু পজিটিভ আসে, কিন্তু তাকে তিনদিনের মাথায় পরীক্ষা করা হয়েছিল। কিন্তু অন্যান্য টেস্টগুলোর প্যারামিটার দেখে আমাদের মনে হয়েছে, এটি ডেঙ্গুই হবে।
এমডি আরো বলেন, থ্যালাসেমিয়া রোগ হলে সাধারণত রক্তের হিমোগ্লোবিন কমে যায়। তাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম থাকে। আমরা মনে করি, যেহেতু রোগীর থ্যালাসেমিয়া ছিল পাশাপাশি হাই ফিভার ছিল, একইসঙ্গে রোগ প্রতিরোধক্ষমতাও কম ছিল, ফলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এখানে চিকিৎসায় কোনো ভুল ছিল না।
এদিকে, একের পর এক বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় রোগী মৃত্যুর ঘটনায় ব্যাপক ইমেজ সংকটে পরেছে হাসপাতালটি। এমনকি ওই হাসপাতালের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, গত দুই মাস ধরে তাদের রোগী সংখ্যাও কমতে শুরু করেছে।
এসব বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহেদ মালিককে ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। এমনকি এ প্রতিবেদক বিষয়গুলো উল্লেখ করে তাকে মুঠোফোনে ক্ষুদেবার্তা পাঠালেও তিনি তার প্রতিউত্তর করেননি।
তবে বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিএমএ) প্রেসিডেন্ট ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ভোরের পাতাকে বলেন, চিকিৎসকরাও মানুষ, তারা ফেরসতা নন। তাদের ভুল হতেই পারে। ভুল হলে স্বীকার করার মতো সৎ সাহস থাকতে হবে। এরপর যেহেতু বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে, সেটা নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে পারি না। বিষয়টা আদলতই দেখবেন। তবে গোপনে হাসপাতালের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মারা যাওয়া শিশুটির বাবা মাকে যে সমঝোতার কথা বলেছেন, সেটি সত্য হলেও অবশ্যই তারা নৈতিকতা বিবর্জিত কাজ করেছেন। এটা কখেনোই কোনো চিকিৎসকের কাছ থেকে কাম্য নয়।
আগামী পর্বে: মৃত রোগী আটকিয়ে বিল বাড়ায় বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতাল