তাজরীন ট্রাজেডির ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও নিহত ও আহত শ্রমিকরা তাদের ক্ষতিপুরণ পায়নি। এমনকি অসুস্থ শ্রমিকদের ভাগ্যে মেলেনি সুচিকিৎসা। ২০১২ সালের চব্বিশে নভেম্বর এদিনে সাভারের আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন গার্মেন্টেসে ভয়াবহ আগুনে পুড়ে দগ্ধ হয়ে মারা যান ১’শ ১১ জন শ্রমিক। মালিকপক্ষের গাফিলতিতে এসব শ্রমিক নারী-পুরুষের মৃত্যুর পর থেকে আজ অবধি ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেলোয়ার হোসেনের বিচার সম্পন্ন হয়নি। দ্রæত সময়ের মধ্যে তাজরীন হত্যাকান্ডের বিচার সম্পন্ন করে মালিক দেলোয়ার হোসেনের ফাঁসি কার্যকর করতে হবে।
বৃহষ্পতিবার আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ট্রাজেডির ১০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে নিহতদের স্মরণে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে এসে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এসব কথা বলেন।
এই ভয়াবহ দিনটি স্মরণে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন, নিহত শ্রমিকদের পরিবার, আহত শ্রমিসকসহ সর্বস্তরের লোকজন অস্থায়ী বেদীতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পরে সেখানে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন কর্মসুচী পালন করেন তারা। বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন থেকে শ্রমিকরা ন্যায্য ক্ষতিপুরণ দাবী করেন। এছাড়াও তাজরীন গার্মেন্টসের মালিক দেলোয়ার হোসেনের ফাঁসির দাবি জানান সর্বস্তরের লোকজন। এসময় অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। এদিকে নিহত শ্রমিকদের সকলের ছবি তাজরীনের মুল ফটকে টাঙ্গানো হয়েছে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে। যেকোন অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে তাজরীন গার্মেন্টস এর সামনে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
তাজরিন ফ্যাশনের মেশিন অপারেটর ছিলেন মুক্তা বানু (৪০)। ২০১২ সালে এ পোশাক কারখানায় অগ্নিকান্ডের সময় তিনি চার তলায় কাজ করছিলেন। হঠাৎ চারপাশে দাউদাউ করে জ্বলে উঠে আগুন। আগুনের লেলিহান শিখায় আহত হন মুক্তা বানু। যেন মৃত্যু নিশ্চিত তাঁর। এমন সময় পাশের জানালা ভেঙে একটি বাঁশ বেয়ে নিচে নেমে আসছিল শ্রমিকেরা। মুক্তা বানুও এভাবে বাঁশ বেয়ে নিচে নেমে এসে বেঁচে যান ভয়াবহ অগ্নিকান্ড থেকে। কিন্তু, এরই মধ্যে নিভে যায় শতাধিক প্রাণ। সে সময় মুক্তার শরীর আগুনে ঝলসে যায়।
তিনি আরও জানালেন, বিগত ১০ বছরে চিকিৎসার জন্য কোন সহায়তা পাননি তিনি। অতি কষ্টে অসুস্থ শরীর নিয়ে দিনাতিপাত করছেন মুক্তার মত শত শত অসুস্থ শ্রমিকেরা। যাদের দেখার কেউ নেই।
গার্মেন্টস শ্রমিক সংগঠনের নেতারা জানান, তাজরীনের অগ্নিদুর্ঘটনার পরের বছর সিআইডি অভিযোগপত্র দেয়। আসামিরা হলেন- তাজরীনের এমডি মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন, তার স্ত্রী ও প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মাহমুদা আক্তার, প্রকৌশলী এম মাহবুবুল মোর্শেদ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা দুলাল, স্টোর ইনচার্জ হামিদুল ইসলামসহ ১৩ জন। বর্তমানে আসামিরা সবাই জামিনে আছেন। মামলার সাক্ষী ১০৪ জন। তাজরীনের ঘটনায় ২০১৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠানটির এমডিসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করা হয়। তবে সাক্ষী হাজির না করতে পেরে বারবার সময় নেয় রাষ্ট্রপক্ষ।
সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের নেতারা বলেন, তৈরি পোশাকশিল্পে নব্বইয়ের দশক থেকে মালিকদের গাফিলতিতে অগ্নিকান্ড ও ভবনের ধসের ঘটনায় অনেক শ্রমিক মারা গেছেন। তবে একটি ঘটনারও বিচার হয়নি। তবে ন্যায্য দাবিতে শ্রমিকেরা আন্দোলন করলেই কালো তালিকাভুক্ত, চাকরিচ্যুত, মামলা, হামলার মতো ঘটনা ঘটে। মালিকপক্ষ প্রভাবশালী হওয়ার কারণেই তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকান্ডের ঘটনার বিচার হয়নি।
এদিকে বিজিএমইএ-সহ বিভিন্ন এনজিও সংস্থার সহযোগীতায় চাকরি বা ক্ষুদ্র ব্যবসা দিয়ে তাজরীন ফ্যাশনসে ক্ষতিগ্রস্থ অনেকেই নতুন করে জীবন শুরু করেছেন বলে জানা গেছে। তবে, অসহায় দরিদ্র শ্রমিকদের অনেককেই চিকিৎসা ও সংসার খরচ মেটাতে বিক্রি করতে হয়েছে ভিটে-মাটি।
তাজরীন ফ্যাশনের মত আর কোন ট্রাজেডি যাতে না ঘটে এমনটাই প্রত্যাশা করেছেন সর্বস্তরের মানুষ।