বাংলাদেশ থেকে নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনের বাবার ক্রয়কৃত ময়মনসিংহ নগরীর টিএন রায় সড়কে অবস্থিত অবকাশ ভবন নামে বাড়িটি ভেঙ্গে নির্মাণ করা হচ্ছে বহুতল ভবন।
তসলিমা নাসরিনের জন্ম, শৈশব,কৈশোর আর যৈবনের অধিকাংশ সময় কাটানো স্মৃতিবিজড়িত ময়মনসিংহের বহুল আলোচিত অবকাশ ভবন ভেঙ্গে ফেলার খবরে বেশ চটেছেন বিতর্কিত এই লেখিকা। বিতর্কিত এই লেখিকা ১৯৯৪সালে দেশ ত্যাগের তার কারনেই এই বাড়িটি বহুল আলোচিত ও পরিচিত হয়।
সম্প্রতি তসলিমা নাসরিনের স্মৃতিময় সেই বাড়িটি ভেঙে টাঙানো হয়েছে ডেভেলপার কোম্পানির সাইনবোর্ড। বৃহস্প্রতিবার দুপুরে সরজমিনে গিয়ে দেখা যায় টিএন রায় সড়কে অবস্থিত অবকাশ ভবনের দেয়াল থেকে ইট খুলছে শ্রমিকরা। বাড়ি ভাঙ্গার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে হয়ত দু’একদিনের মধ্যে বাড়িটি শতভাগ ভাঙ্গা হয়ে যাবে।
এদিকে গত কয়েকদিন আগে বাড়িটি ভেঙ্গে ফেলা নিয়ে ফেসবুক পোস্টে ৬১ বছর বয়েসী বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা লিখেছেন: ‘কেউ কেউ ফেসবুকে ‘অবকাশ’ ভাঙার ছবি পোস্ট করছে, দুঃখ করছে, স্মৃতিচারণ করছে। আমার শৈশব, কৈশোর, যৌবনের সেই ‘অবকাশ’। ময়মনসিংহ শহরের টিএন রায় রোডে আমার বাবার কেনা সুন্দর বাড়িটি অবকাশ। এই অবকাশ ভেঙে গুঁড়ো করার সিদ্ধান্ত যারা নিয়েছে তাদের সঙ্গে আমার কোনও যোগাযোগ নেই, আমার কোনও সম্পর্ক নেই। শুধু এইটুকু জানি, তাদের মধ্যে কেউ কেউ খুব লোভী, স্বার্থপর, ধুরন্ধর, কেউ কেউ কট্টর মৌলবাদী। সকলেরই আমি চক্ষুশূল। এককালে শহরের সাহিত্য সংস্কৃতি, জ্ঞান বিজ্ঞান আর প্রগতিশীলতার একটি কেন্দ্র ছিল যে বাড়িটি, আজ সেটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত। ধন দৌলতের কাঙালদের কাছে প্রগতিশীলতা, উদারতা, সহমর্মিতা, স্মৃতি ও সৌন্দর্যের কোনও মূল্য নেই। শুনেছি বাড়িটিতে আমার মায়ের হাতের লাগানো সব ফল ফুল গাছ শেকড়সুদ্ধ উপড়ে ফেলে একটি আধুনিক বহুতল বিল্ডিং বানানো হচ্ছে। আমার কর্মঠ বাবার অকর্মণ্য উত্তরসুরিরা সেই বিল্ডিং-এ পায়ের ওপর পা তুলে বংশ পরম্পরায় খাবে। ও বাড়ির এখন আমি কেউ নই। আমি তো তিরিশ বছর ব্রাত্যই।
ইট পাথরে, চুন সুরকিতে, কাঠে কংক্রিটে স্মৃতি থাকে না, স্মৃতি থাকে মনে। অবকাশ রইলো আমার মনে। যে বাড়িটিতে বসে আমি প্রথম কবিতা লিখেছি, প্রথম কবিতা-পত্রিকা ছাপিয়েছি, প্রথম কবিতার বই লিখেছি, নির্বাচিত কলাম লিখেছি, যে বাড়িটির মাঠে প্রথম গোল্লাছুট খেলেছি, যে বাড়িটির ছাদে প্রথম পুতুল খেলেছি, যে বাড়িটির ভেতর প্রথম রবীন্দ্রনাথ আওড়েছি, উঠোন জুড়ে নেচে চিত্রাঙ্গদা ম স্থ করেছি, যে বাড়িটিতে দাদা বেহালা বাজাতো, ছোটদা গিটার বাজাতো, বোন গান গাইতো, মা আবৃত্তি করতো, বাবা মানুষের মতো মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখাতো, যে বাড়িটিতে বসে প্রথম প্রেমের চিঠি লিখেছি, যে বাড়িটিতে আমি একই সঙ্গে সংবেদনশীল এবং সচেতন মানুষ হয়ে উঠেছি, সে বাড়িটি রইলো আমার মনে। কোনও হাতুড়ি শাবল কুড়োলের শক্তি নেই সে বাড়িটি ভাঙে।
তবে তাসলিমা নাসরিনের সহোদর ভাতিজা নগরীর আল-হিদায়াহ লাইব্রেরীর মালিক ডা, সাফায়েতুল কবীর জানান বাড়িটি ছিল আমার দাদা প্রয়াত ডা. রজব আলী সাহেবের। দাদা প্রয়াত হয়েছেন ২০২১৮সালে। দাদার রেখে যাওয়া বাড়িটি উত্তরাধিকারদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা হয়েছে। সামনের অংশে আমার বাবা ও চাচার জায়গা। আর পেছনে ফুফুদের জন্য রেখে দেয়া হয়েছে। বন্টনে কোন অনিয়ম করা হয়নি।নিয়ম মেনেই অংশ ভাগ করে পুরোনো বাড়ি ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে।