পটিয়া স্বাস্থ্য সহকারী প্রবীর মিত্র। তাকে (নিজবেতনে) স্যানিটারি ইন্সপেক্টর পদে পদায়ন করে দায়িত্ব দেওয়া হয় কক্সবাজার সদর হেল্থ এডুকেটর এর। এ পদায়নের কিছুদিন পরই সংযুক্ত করা হয় চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়ে। প্রবীর মিত্র বর্তমানে চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন এর পিএ। একইভাবে রাঙ্গুুনিয়ার স্বাস্থ্য সহকারী টিটু পালকে (নিজবেতনে) স্যানটারী ইন্সপেক্টর পদে পদায়ন করে পাঠানো হয়েছে লক্ষীপুর জেলায়। টিটু পাল পরে সেখান থেকে সন্দ্বীপ-লক্ষীপুর ঘুরে চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়ে টিকাদান করছেন।
শুধু প্রবীর মিত্র বা টিটুপাল নয়! এভাবে এসআইটি কোর্স পাস করা স্বাস্থ্য সহকারীদের গোপনে একের পর এক স্যানিটারি ইন্সপেক্টর পদে পদায়ন করছেন চট্টগ্রামের বিভাগীয় পরিচালক স্বাস্থ্য। একইভাবে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী জুনিয়র এসআইটি কোর্স পাস করা স্বাস্থ্য সহকারীদের স্যানিটারি ইন্সপেক্টর পদে পদায়ন, বদলী ও সংযুক্তির অফিস আদেশ জারী করছেন। গত কয়েক মাসে অন্তত ১০জনকে এভাবে পদায়নে বদলী ও সংযুক্তির আদেশ দিয়েছেন বলে জানাগেছে।
যদিও এই বিষয়ে কড়া নিষেধ রয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের। দুর্নীতি দমন কমিশন থেকেও রয়েছে এমন আদেশ না দেওয়ার সুপারিশ। বলা হয় পূর্বের সকল পদায়ন, পদোন্নতি, বদলী, নিয়মিত করণ ও সংযুক্তির আদেশ বাতিল করার জন্য। সতর্ক করে দেওয়া হয় ভবিষ্যতে এ ধরণের আদেশ আর না দেওয়ার। তবে এর কিছুই মানছে না চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক স্বাস্থ্য এর দপ্তর।
অভিযোগ উঠেছে, দীর্ঘদিন ধরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিষেধ উপেক্ষা করে এসআইটি কোর্স পাসকরা জুনিয়র স্বাস্থ্য সহকারীদের (নিজবেতনে) পদায়ন, পদোন্নতি, বদলী ও নিয়মিতকরণ আদেশ দিয়ে আসছে চট্টগ্রামের বিভাগীয় পরিচালক স্বাস্থ্য। দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারিদের সুবিধাজনক স্থানে সংযুক্তি বা বদলীর আদেশ দিয়েছে খেয়াল খুশিমতো। যদিও এসআইটি কোর্স উত্তীর্ণ স্বাস্থ্য সহকারীদের জ্যেষ্ঠতা (ব্যাচ) ও দক্ষতার ভিত্তিতে স্যানিটারি ইন্সপেক্টর পদে পদোন্নতি দেওয়ার নিয়ম রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে এক সভায় নির্দেশ দেন স্বাস্থ্য বিভাগের অতীতের সকল সংযুক্তির আদেশ বাতিল করার জন্য। একইভাবে এসআইটি কোর্স উত্তীর্ণ স্বাস্থ্য সহকারীসহ সকল কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বিধি উপেক্ষা করে দেওয়া পদায়ন, পদোন্নতি, নিয়মিতকরণ এবং সংযুক্তির আদেশ বন্ধ রাখার করার নির্দেশ দেওয়া। এই বিষয়ে দুদক থেকে বেশকিছু সুপারিশসহ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে একটি পত্র পাঠানো হয়। এ পত্র পাওয়ার পরই ২০২০ সালে ১৩ মার্চ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা: মো. বেলাল হোসেন চট্টগ্রামের পরিচালক স্বাস্থ্য ও খুলনার পরিচালক স্বাস্থ্যকে পত্র দেন। এতে সংশ্লিষ্ট পরিচালকদের দপ্তর থেকে দেওয়া অতীতের সকল পদায়ন, পদোন্নতি, নিয়মিতকরণ ও সংযুক্তির সকল আদেশ বাতিল করার জন্য বলা হয়।
দুই বিভাগীয় পরিচালককে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাঠানো পত্রে উল্লেখ করা হয়, স্যানিটারি ইন্সপেক্টর পদধারীদের নিয়োগ, বদলী ও পদোন্নতি সংক্রান্ত কার্যক্রম কেন্দ্রীয়ভাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সম্পন্ন করে। এজন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে গ্রেডেশন তালিকা প্রস্তুত করা হয়। বিষয়টি জেনেও এসআইটি কোর্স পাসকরা জুনিয়র স্বাস্থ্য সহকারীদের স্যানিটারি ইন্সপেক্টর পদে (নিজবেতনে) পদায়ন, পদোন্নতি, নিয়মিতকরণ, বদলী ও সংযুক্তির আদেশ দেওয়া সম্পূর্ণ বিধি বহির্ভুত। সংশ্লিষ্ট দুই পরিচালকের দপ্তর থেকে দেওয়া ইতিপূর্বের সকল আদেশ বাতিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, চট্টগ্রামের বিগত পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. মো. শাহরিয়ার কবির চৌধুরী এই পত্র পাওয়ার পরও একের পর এক পদায়ন, পদোন্নতি, বদলী, নিয়মিতকরণ ও সংযুক্তির আদেশ জারী দিয়েছেন। এসব নিয়ে সংক্ষুব্ধ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। যার প্রেক্ষিতে তাকে পদাবনতি (ওএসডি) করে বানানো হয় পুষ্টির মহাপরিচালক।
স্বাস্থ্যের চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালকের দপ্তরের রেকর্ড সূত্রে জানা গেছে, এসআইটি কোর্স পাস করা ফেনীর জুনিয়র স্বাস্থ্য সহকারী কাজী মাসুদকে নিজবেতনে স্যানিটারি ইন্সপেক্টর পদে পদায়ন করে পাঠানো হয়েছে ফেনী সদর হাসপাতালে হেল্থ এডুকেটরে। চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক স্বাস্থ্য ডাঃ হাসান শাহরিয়ার কবির এক অফিস আদেশে তাকে এ পদে পদায়ন করেন। পরে আরেকটি সংযুক্তির আদেশ দিয়ে পাটিয়ে দেন চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়ে। কাজী মাসুদ বর্তমানে চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়ে ডেসপাচের চিঠিপত্র এন্ট্রির দায়িত্বে।
লক্ষীপুরের কমলনগরের স্বাস্থ্য সহকারী রিয়াদ হোসেন (নিজবেতনে) ওই উপজেলার স্যানিটারী ইন্সপেক্টর। কক্সবাজারের উখিয়ার স্বাস্থ্য সহকারী মো. ছৈয়দ আকবর (নিজবেতনে) চট্টগ্রামের বাঁশখালীর স্যানিটারী ইন্সপেক্টর। ফেনীর স্বাস্থ্য সহকারী মো. ফারুককে (নিজবেতনে) সন্দ্বীপের স্যানিটারী ইন্সপেক্টর। গত কয়েকদিন আগে তাকে বদলী করা হয়েছে চট্টগ্রামের হাটহাজারীর স্যানিটারি ইন্সপেক্টরের পদে। হাটহাজারী উপজেলার স্বাস্থ্য সহকারী মনোয়ারা বেগম (নিজবেতনে) চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানার স্যানিটারী ইন্সপেক্টর। বান্দরবান সদর উপজেলা স্যানিটারি ইন্সপেক্টর সুশিলা কর্মকার এখন বান্দরবানের ভারপ্রাপ্ত জেলা স্যানিটারী ইন্সপেক্টর। বান্দরবান সদর উপজেলার স্বাস্থ্য সহকারী মিথুন বড়–য়া (নিজবেতনে) বান্দরবান সদর স্যানিটারী ইন্সপেক্টর। ফেনীর স্বাস্থ্য সহকারী মন্জুর আলম (নিজবেতনে) এখন কুমিল্লার স্যানিটারী ইন্সপেক্টর। সাতকানিয়ার স্বাস্থ্য সহকারী সামশুল হক (নিজবেতনে) কুমিল্লা জেলায় স্যানিটারী ইন্সপেক্টর। উখিয়ার উপজেলার স্বাস্থ্য সহকারী মমতাজ উদ্দিন (নিজবেতনে) রামু উপজেলা স্যানিটারী ইন্সপেক্টর।
রবাঁশখালীর স্বাস্থ্য সহকারী মামুনুর রশিদকে (নিজবেতনে) স্যানিটারী ইন্সপেক্টরের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। নতুনভাবে পদ সৃষ্টিকরে উখিয়ার স্বাস্থ্য সহকারী মোহাম্মদ ইউনুছকে (নিজবেতনে) দেওয়া হয়েছে উখিয়া শরনার্থী ক্যাম্প স্যানিটারি ইন্সপেক্টর পদে। টেকনাফ শরনার্থী ক্যাম্পে দেওয়া হয়েছে আরেকজনকে। এছাড়া বেশ কয়েকজনকে নিজবেতনে স্যানিটারি ইন্সপেক্টর করে বিভিন্ন দপ্তরে সংযুক্তিতে পাঠানো হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন ডা: মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী বলেন, এসব আমাদের ইন্টারনাল বিষয়। আপনারা এসব ইন্টারনাল বিষয় নিয়ে কথা বলছেন, এটাতো ঠিক হচ্ছে না।
চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ডা. সুমন বড়–য়া বলেন, এমনিতে ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে স্বাস্থ্য সহকারী সংকট। যেখানে দুইজন/তিনজন স্বাস্থ্য সহকারী থাকার কথা, সেখানে আছেন একজন। আবার কোথাও নাই। এই অবস্থায় এসআইটি পাস করা স্বাস্থ্য সহকারীদের যদি নিয়ে নেওয়া হয়, টিকাদান কার্যক্রম ও সরকারি কর্মসূচি বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে যাবে।
বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা: মোহাম্মদ শাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, এসআইটি পাস করা স্বাস্থ্য সহকারী, অথচ পদায়নে নিজবেতনে স্যানিটারি ইন্সপেক্টরের দায়িত্ব পালন করছেন। এমন সবার তালিকা করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে। পরিচালক (প্রশাসন) এই বিষয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।