নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলায় পৈতৃক ভিটায় সারা দিন সময় কাটালেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ।
মঙ্গলবার (৮ নভেম্বর) সকাল ১০টায় সেনাপ্রধান সড়কপথে মধুমতি আর্মি ক্যাম্পে আসেন। সঙ্গে তার স্ত্রীও ছিলেন। এ সময় তিনি মধুমতি আর্মি ক্যাম্পের বিভিন্ন কার্যক্রম পরিদর্শন করেন। পরে তিনি মধুমতি রেলওয়ে ব্রিজের কাজের অগ্রগতিসহ বিভিন্ন স্থাপনা পরিদর্শন করে কালনা এলাকায় সেনাবাহিনীর বিভিন্ন কল্যাণমূলক সম্ভাব্যতা যাচাই করেন এবং প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেন।
বেলা ১১টায় তিনি লোহাগাড়া উপজেলার মধুমতি তীরবর্তী করফা গ্রামে প্রস্তাবিত বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম অধ্যাপক শেখ মো. রোকনউদ্দিন আহমেদ ১০ শয্যাবিশিষ্ট মা ও শিশু কল্যাণকেন্দ্র নির্মাণকাজ পরিদর্শন করে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।
সেনাপ্রধান বলেন, নিজেকে ভাগ্যবান মনে হচ্ছে এখানে আসতে পেরে। এসেছিলাম মূলত রেলওয়ে প্রকল্পের কাজ, শীতকালীন প্রশিক্ষণের কাজ, সেনাবাহিনীর কিছু উন্নয়নমূলক কাজ দেখতে। আমার পিতৃপুরুষের বাড়ি এখানে। এখানে এসে মানুষের সমাগম দেখে খুবই ভালো লাগলো, মানুষের ভালোবাসা পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে। মহান আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা।
তিনি বলেন, মানুষের উপকারে আসবে এমন যেকোনো ধরনের উন্নয়নমূলক কাজে আমরা আন্তরিকতার সঙ্গে অগ্রসর হব।
রেলওয়ে কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে সেনাপ্রধান বলেন, যতটুকু জানি, কাজের অগ্রগতি দেখে আশা করা যায়, আগামী ২০২৪ সালের জুনের দিকে রেলওয়ের পুরো কাজ সম্পন্ন হবে।
এদিকে সেনাপ্রধান নিজ গ্রামে আসায় আনন্দিত নড়াইলবাসী। তাকে এক নজর দেখার জন্য ভিড় করেন হাজারো মানুষ। দুপুর ১২টায় সেনাপ্রধান তার পিতার প্রতিষ্ঠিত মল্লিকপুর ইউনিয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদ এবং এলাকাবাসী কর্তৃক আয়োজিত গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে বিদ্যালয়ের শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাবের কার্যক্রম এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা এস এস রোকনউদ্দিন আহমেদ ভবন উদ্বোধন করেন তিনি এরপর তিনি বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে একটি এলমন্ড বৃক্ষ রোপণ করেন।
বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে প্রধান শিক্ষিকা সেনাবাহিনীর প্রধানকে মানপত্র দেন৷ এ সময় স্কুল ম্যানেজিং কমিটির পক্ষ থেকে স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক এস এম রোকনউদ্দিন আহমেদের একটি বাঁধাই করা ছবি উপহার হিসেবে সেনাপ্রধানসহ তার তিন ভাইবোনের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজনের সঙ্গে মতবিনিময় করেন সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ। স্থানীয় লোকজন তার কাছে নিজেদের সমস্যা ও প্রত্যাশার কথা তুলে ধরেন।
মতবিনিময় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সেনাপ্রধান বলেন, আমি আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। আমি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ প্রধানমন্ত্রীর প্রতি। তিনি আমার ওপর আস্থা রেখে এই গুরুদায়িত্ব আমাকে দিয়েছেন। তিনি শুধু আমাকে দায়িত্বই দেননি, সেনাবাহিনীকে আধুনিক করার জন্য এবং ভবিষ্যতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উন্নয়ন করার জন্য যুগোপযোগী সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন। সেনাবাহিনীর সব সদস্যের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আমার বিশেষ কৃতজ্ঞতা।
তিনি বলেন, এই বিশেষ মুহূর্তে আমি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে চাই আমাদের স্বাধীনতার মূল রূপকার হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। আমি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে চাই ত্রিশ লাখ শহীদকে, যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি এই স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা, তাদের ত্যাগ আমরা কখনোই ভুলতে পারবো না। যারা আমাদের জন্য নিজের জীবন ত্যাগ করেছেন, যুদ্ধ করেছেন তাদের সম্মান দিতেই হবে।
সেনাপ্রধান বলেন, আজ আমার খুবই খুশি লাগল। আবেগ ধরে রাখা আমার জন্য খুবই কষ্টকর। এই এলাকার মানুষ আমার পিতার অবদান মনে রেখেছেন। তারা তার প্রতিদান দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। আমি আপনাদের সবার কাছে কৃতজ্ঞ। আমার বাবা শিক্ষানুরাগী ছিলেন, শুধু নড়াইলেই নয়, খুলনায় শিক্ষা বিস্তারে আন্তরিক চেষ্টা করছেন। আমাদের পুরো পরিবার শিক্ষাবিস্তারে আন্তরিকতার সঙ্গে চেষ্টা করে যাচ্ছি। খোলা মনে আপনাদের একটা কথা বলতে চাই, আমার সীমিত সাধ্যের মধ্যে শিক্ষাবিস্তার এবং এলাকার উন্নয়নে আপনাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করব।
তিনি আরও বলেন, মনে রাখতে হবে প্রধানমন্ত্রী নিজে এই নড়াইল-২ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী নড়াইলের প্রতি অনেক আন্তরিক। এলাকার উন্নয়নের জন্য নড়াইল-২ আসনের সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মুর্তজা অনেক আন্তরিকতার সাথে চেষ্টা করছেন। তিনি আপনাদের সবার পছন্দের মানুষ, আমিও পছন্দ করি। এলাকার উন্নয়নে আমার সাধ্যের মধ্যে তাকে সার্বিকভাবে সহযোগিতার চেষ্টা করছি। আমি মনে করছি, এলাকাবাসী হিসাবে আপনারা নিজেদের একদিন ভাগ্যবান মনে করবেন।
মতবিনিময় অনুষ্ঠান শেষে সেনাপ্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ লোহাগড়া সরকারী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ১২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা ‘অঙ্কুর’—এর মোড়ক উন্মোচন করেন। সেখানে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন তিনি।
এরপর তিনি নড়াইল সরকারি আদর্শ মহাবিদ্যালয় পরিদর্শন করেন। সেখানে তাকে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর (বিএনসিসি) কর্তৃক গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। তিনি শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে সেখানে মতবিনিময় করেন।
মধুমতি আর্মি ক্যাম্পে এসে সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা, গণমাধ্যমকর্মী, সুধীজনদের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেন সেনাপ্রধান। আসন্ন শীতকালীন প্রশিক্ষণ উপলক্ষে ৫৫ পদাতিক ডিভিশনের প্রস্তাবিত প্রশিক্ষণ অপারেশন ও লজিস্টিকসের প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম পরিদর্শন করেন এবং প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দেন।
পরিদর্শনকালে চিফ কনসালটেন্ট জেনারেল, অ্যাডহক কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন কনসালটেন্ট মেজর জেনারেল এ কে এম রেজাউল মজিদ, জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) ও এরিয়া কমান্ডার যশোর এরিয়া মেজর জেনারেল মোহাম্মদ মাহবুবুর রশীদ, যশোর এরিয়ার ঊর্ধ্বতন সেনাকর্মকর্তা, স্থানীয় গণ্যমান্য বিশিষ্ট ব্যক্তি, স্থানীয় সাংবাদিক, বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন।