সারাদেশে ডেঙ্গু জ¦রের ভয়াবহতা বাড়ছে। সরকারি ভাবে ডেঙ্গু প্রতিরোধে নানান ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।প্রতিদিনই বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। ডেঙ্গুর ভয়াবহতা এখন রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রশাসনিকভাবে ডেঙ্গু মোকাবিলায় হাঁক ডাক থাকলেও বাস্তবে পরিস্থিতি অবনতির দিকে। অথচ স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম সম্প্রতি বলেছেন ডেঙ্গু মোকাবিলায় সর্বত্র কাজ করছে তার মন্ত্রণালয়। কার্যত ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন লোক দেখানো নানান কর্মসূচি নিলেও কোন কাজেই আসছে না।
গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরও দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ১২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল বুধবার সারাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের নিয়মিত ডেঙ্গুবিষয়ক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে গত এক দিনে দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে নতুন করে আরও ৯২৩ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ নিয়ে বর্তমানে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৩৮০ জনে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে নতুন ভর্তি হওয়াদের মধ্যে ৫২০ জন ঢাকার বাসিন্দা। ঢাকার বাইরে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৮০৩ জন। বর্তমানে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছেন দুই হাজার ২০৭ জন। আর ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে ভর্তি আছেন এক হাজার ১৭৩ জন।
চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে গত ২৫ অক্টোবর মঙ্গলবার পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩৩ হাজার ৯২৩ জন। এর মধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন ৩০ হাজার ৪২৩ জন। গত ১৩ অক্টোবর ডেঙ্গুতে ৮ জনের মৃত্যু হয়, যা চলতি বছর একদিনে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা।
এদিকে বিরামহীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় পুলিশ সদস্যদের নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যাও কম নয়। করোনাকালে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষের পাশে থাকা এ বাহিনীর ত্যাগ ছিল উদাহরণতুল্য। সূত্র জানায়, বাংলাদেশ পুলিশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, অপরাধ দমন, অপরাধীদের গ্রেফতার, মামলা নেওয়া, বিচারে সহায়তা, সড়কে শৃঙ্খলা ও ভিআইপি নিরাপত্তা-প্রটোকলসহ অনেক দায়িত্ব পালন করে। এছাড়া গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কাজেও যুক্ত থাকে পুলিশ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে করোনা মহামারির সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অসুস্থ করোনা রোগীদের হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়ার অনন্য নজির স্থাপন করেছেন বাহিনীর সদস্যরা। এমনকি করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তির স্বজনরা যখন সংক্রমণের ভয়ে দূরে সরে গেছেন, তখনো মৃতব্যক্তির দাফন বা সৎকারে পুলিশ সদস্যরাই ছিলেন নির্ভীক। তবে জনসেবায় অগ্রভাগের এ বাহিনীতে সাম্প্রতিক সময়ে মৃত্যু বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে।
এখন সারাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব চলছে। এডিস মশাবাহিত এ ভাইরাসটিতে প্রতিদিন রেকর্ড ভাঙছে সংক্রমণ। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে পুলিশ সদস্যদের মাঝেও। প্রতিদিন জ্বর নিয়ে রাজধানীর রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে আসছেন পুলিশ সদস্যরা। নমুনা পরীক্ষায় ডেঙ্গু শনাক্ত হলেই ভর্তি হচ্ছেন হাসপাতালে।
রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে হাসপাতালটিতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন ৭০ পুলিশ সদস্য। তাদের মধ্যে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ১৫ জন। তবে চলতি বছর ডেঙ্গুতে এখন পর্যন্ত কোনো পুলিশ সদস্য মারা যাননি।
জানা গেছে, হাসপাতালে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তদের বিশেষ যত্ন নিচ্ছেন নার্সরা। রোগীর স্বজনরা ডাকার সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যাচ্ছেন তারা। হাসপাতালটির চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত পুলিশ সদস্যদের অধিকাংশই মাঠ পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩২ হাজার ৭১৬ জন। এরমধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন ২৯ হাজার ৪৬৬ জন। ২০২০ সালে করোনা মহামারিকালে ডেঙ্গুর সংক্রমণ তেমন একটা দেখা যায়নি। তবে ২০২১ সালে সারাদেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। এরমধ্যে মারা যান ১০৫ জন।
রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের পুলিশ সুপার (অপারেসন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) সাইফুল ইসলাম শানতু বলেন, আমাদের চিকিৎসকরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বিশেষায়িত ট্রেনিং নিয়ে রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছেন। গত মাসে (সেপ্টেম্বর) ও চলতি মাসের প্রতিদিনই আউটডোরে অসংখ্য রোগী চিকিৎসা নিতে আসছেন। তাদের অনেককে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বাড়ি পাঠানো হচ্ছে। শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় যাদের জ্বর একটু বেশি তাদের ভর্তি রাখা হচ্ছে। সচেতনতার কারণে অনেকেই আগেভাগে চিকিৎসা নিতে আসছেন। এখনো আমাদের হাসপাতালে ডেঙ্গুতে কারও মৃত্যু হয়নি।
ডেঙ্গু মোকাবিলায় পদক্ষেপ জানতে চাইলে পুলিশ সদরদপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) মো. মনজুর রহমান বলেন, ডেঙ্গুর বিষয়ে আমরা আগে থেকেই বেশি সচেতন। নিজের রুম ও বাসার আশপাশ পরিষ্কার রাখছি, রাস্তাঘাটে কোনো কিছু এদিক-সেদিক যেন ফেলে রাখা না হয়- পুলিশ ও জনগণকে এ ধরনের বার্তা দেওয়া হচ্ছে। যারা ডিউটি করছেন তারা যেন সাবধানতার সঙ্গে ডিউটি করেন।
অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, মশা নিয়ন্ত্রণ করা তাদের কাজ না হলেও ডেঙ্গুরোধে করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞদের দাবি, শুধু হটস্পট নির্ধারণ করে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব। তাদের মতে, ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতির মূল কারণ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না নেওয়া, জনসম্পৃক্ততার অভাব ও জলবায়ু পরিবর্তন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক আহমেদুল কবীর বলেন, এবার ডেঙ্গুর চার ধরনের মধ্যে তিনটিই সক্রিয়। ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার এটি একটি কারণ। জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার পর অনেকে গুরুত্ব দেন না। পরিস্থিতি বেশ খারাপ হওয়ার পরেই হাসপাতালে যান। এ বিলম্বের কারণে হাসপাতালে আসার পরপরই মৃত্যুর হার বেশি।’