কারাগার বর্তমান সময়ে আলোচিত এক স্থানের নাম। যেখানে অপরাধীরা আত্নশুদ্ধির পথে চলার কথা, সেখানে বসেই চলছে শীর্ষ সন্ত্রাসী, জঙ্গি, দাগী অপরাধীদের নানা ধরণের অপরামূলক কর্মকাণ্ড। এমনকি লন্ডনে পলাতক বিএনপির নেতা দন্ডপ্রাপ্ত আসামি তারেক রহমানের সাথেও দলটির অনেক বন্দী নেতা নিয়মিত যোগাযোগ করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। আর এসব কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত খোদ কারাগারের দায়িত্বশীল থেকে কারা অধিদপ্তরের কর্তা ব্যক্তিরা। এমনকি, আওয়ামী লীগপন্থী অনেক কারা কর্মকর্তা তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু গিয়াস উদ্দিন আল মামুনকে বিশেষ সুবিধা দেয়ার পাশাপাশি লন্ডনভিত্তিক যোগাযোগের ব্যবস্থাও করে দিয়েছেন বলে জানিয়েছে কারাগারের একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র।
এমনকি বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার পরও কারাগারগুলোতে সক্রিয় রয়েছে বিএনপি-জামায়াতপন্থীরাই। কারাগারে রহস্যজনকভাবে কয়েদী এবং হাজতিদের মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়া, কারাগারের ভিতরেই বিএনপির বন্দীদের বিদ্রোহ করার অপচেষ্টা, বিএনপিপন্থীদের গুরুত্বপূর্ণ কারাগারে পদায়নসহ নানা অনিময়ন সহ কারাগারে গোপন অস্থিতরতার বিষয়ে ভোরের পাতার ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে প্রথম পর্ব।
কারা অধিদপ্তরের প্রিজন ইন্টিলিজেন্স (জেল গোয়েন্দা)’র নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র এবং একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভোরের পাতাকে বলেন, কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার (পার্ট - ২) তে সরকার বিরোধী মামলায় গ্রেফতার হওয়া আসামিরা গত দুই মাস আগে বিদ্রোহ করেছিল। এ বিষয়ে কারা অধিদপ্তরে প্রতিদেনও জমা দেয়া হয়েছিল। সেখানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, কাশিমপুর-২ এর বর্তমান জেলার এনায়েত উল্লাহ এবং ডেপুটি জেলার আফজাল হোসেন বিদ্রোহী বিএনপি-জামায়াতের বন্দীদের, ‘‘এই মর্মে স্বান্তনা দেন যে, আমরা আপনাদের লোক, আপনারা কোনো চিন্তা করবেন। সকল সুবিধা আপনারা পাবেন।’’
জেল গোয়েন্দা শাখার দায়িত্বশীল সূত্র ভোরের পাতা আরো জানান, তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু গিয়াস উদ্দিন আল মামুনকে কতিপয় কারা কর্মকর্তা বিশেষ সুবিধা দিয়ে আসছেন। তারা কারাগারের মধ্যে বিদেশি নম্বর ব্যবহার করে তারেক রহমানের সাথে কথা বলার সুযোগ করে দিচ্ছেন। মামুনকে বদলি করিয়েছেন ঢাকায় এনেছেন। বর্তমানে মামুন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন।
এছাড়া ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের শীর্ষ দুই কর্মকর্তা ও বিএনপি নেতা বিশেষ করে তারেক রহমানের বন্ধু গিয়াস উদ্দিন আল মামুনকে (রাজহাঁস, গরুর পায়া) থেকে শুরু করে বাইরের অভিজাত হোটেলের খাবারও সরবরাহ করেন নিয়মিত। মূলত লন্ডনভিত্তিক যোগাযোগের সুযোগ করে দিচ্ছেন তারাই। কথিত রয়েছে, ‘ঢাকা জেলখানা চলে মামুনের কথায়।’
সূত্র আরো জানিয়েছে, বগুড়া জেলা কারাগারে বিএনপি জামায়াতপন্থী জেল সুপার মনির আহমেদ এবং জেলার মহিউদ্দিন হায়দার এই দুইজন মিলে সন্ত্রাস বিরোধী মামলার আসামি এবং জঙ্গি আসামিদেরকে টাকার বিনিময়ে অবহিত মোবাইল চালানো সুযোগ দিয়ে থাকেন। তারা কারাগারে যা চায় তাই পায়। গত ২৬ মার্চ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জেএমবি বন্দী (১০২৭/এ) মোঃ মোসাদ্দেক আলী বিজয়,(পিতা- মোঃ মজিবুর রহমান,গ্রাম- কামারপাড়া, থানা- শাজাহানপুর,জেলা- বগুড়া) কাছ থেকে মোবাইল উদ্ধার করা হয়েছে। সেটা কারা কতৃপক্ষ গোপন করে গেছে।
এছাড়া, কারাগারকে অস্থিতিশীল করার নেপথ্যে কারাগারের যেসব বিএনপি ও জামায়াতপন্থী কর্মকর্তারা কাজ করে যাচ্ছেন এবং জঙ্গি, বিএনপি-জামায়াতের বন্দীদের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন, তাদেরও একটি তালিকা ভোরের পাতার হাতে এসেছে। তাদের ইতিমধ্যেই গোয়েন্দা নজরদারিতে নেয়ার পরিকল্পনা হয়েছে বলে জানা গেছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন, কাশিমপুর ২ সিনিয়র জেল সুপার আমিরুল ইসলাম যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবেক শিবির নেতা ছিলেন, ময়মনসিংহ ফুলবাড়িয়াতে তার পুরো পরিবার বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ), কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি সিনিয়র জেল সুপার আব্দুল জলিল (বিএনপি-জামায়াতের পৃষ্ঠপোষক, দীর্ঘদিন ধরেই কাশিমপুরে আছেন)। এছাড়া এ তালিকায় রয়েছে, মোঃ মনির আহমেদ, জেল সুপার বগুড়া জেলা কারাগার , আবদুল্লাহ আল মামুন জেল সুপার টাংগাইল জেলা কারাগার, মোঃ জান্নাতুল ফরহাদ, জেল সুপার বান্দরবান জেলা কারাগার, মোঃ আবুল বাসার জেলার মুন্সিগঞ্জ জেলা কারাগার, মোঃ ফোরকান ওয়াহিদ, জেলার যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার, মোঃ এনায়েত, জেলার, কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে -২,
মোঃ আবদুল জলিল, জেল সুপার হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগার, মোসাঃ সুরাইয়া জেল সুপার কারা- অধিদপ্তর, মোঃ টিপু সুলতান, ডি,আই,জি, প্রিজন্স বরিশাল বিভাগ, মোঃ আসাদুর রহমান জেলার, কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কারা অধিদপ্তরের সহকারী কারা মহাপরিদর্শক (অর্থ ও আইন) সুরাইয়া আক্তার, কারা অধিদপ্তরে বসে বিএনপি-জামায়তপন্থী কর্মকর্তাদের গডমাদার হিসাবে সব তদবির করেন। কারা অধিদপ্তর অতি গোপনীয় নথি ফাঁস করারও সুনির্দিষ্ট অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এসময় তদন্ত শুরু হলেও সাবেক কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ মোমিনুর রহমান মামুন সেটি থামিয়ে দিয়েছিল।
এ বিষয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং ইনস্টিটিউট অব কনফ্লিক্ট, ল এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক মেজর জেনা. (অব.) আব্দুর রশিদ ভোরের পাতাকে বলেন, কারাগার নিয়ে আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা ভালো নয়। জাতীয় চার নেতাকে কারাগারেই হত্যা করা হয়েছিল। সরকারের একটি স্পর্শকাতর বিভাগ হচ্ছে কারাগার। এই কারাগার নিয়ে নানা সময়ে কর্মকর্তাদের দুর্নীতির খবর এসেছে। আর দুর্নীতিগ্রস্তদের দিয়ে অপকর্ম বা ষড়যন্ত্র করানো সম্ভব। টাকার কাছে বিক্রি হয়েই তারা জঙ্গি থেকে শুরু করে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলার আসামিদেরও বিশেষ সুবিধা দিয়ে থাকে। তাই সরকারের উচিত এখনই কারাগার নিয়ে আরো কঠোর অবস্থান নেয়া এবং দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা।
এসব অভিযোগের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, এর আগেও এ ধরণের অভিযোগ এসেছে। আমরা চেষ্টা করছি, কারাগার নিয়ে কোনো ধরণের ষড়যন্ত্র যেন কেউ করতে না পারে, সেদিকে খেয়াল রাখা হচ্ছে। তবে যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব (কারা অণু বিভাগ)কে দায়িত্বও দেয়া রয়েছে।
তবে কারা অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ এস এম আনিসুল হককে ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। এমনকি বিষয়গুলো সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করে মন্তব্য চেয়ে তার সরকারি ফোন নম্বরে ক্ষুদেবার্তা পাঠালেও তিনি সেটির প্রতি উত্তর করেননি।