প্রতিবছর ১০ অক্টোবর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস পালিত হয়। এই দিবসের সামগ্রিক উদ্দেশ্য হল বিশ্বজুড়ে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং মানসিক স্বাস্থ্যের সমর্থনে সকলের প্রচেষ্টাকে ঐক্যবদ্ধ করা। আমাদের দেশেও বেশ কয়েক বছর ধরে দিবসটি বিভিন্ন পর্যয়ে পালন করা হচ্ছে। এবছরও সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ে দিবসটি পালিত হবে। আমরা মনেকরি দিবস পালন শুধু আনুষ্ঠানিকতা তা নয় বরং এই দিবস পালনকে কেন্দ্র করে আগামীর ভাবনা শুরু হতে পারে। এবছরের প্রতিপাদ্য বিষয়ে সকলের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য ও সুস্থতাকে বিশ্বব্যাপী অগ্রাধিকার দেওয়ার আহবান জানানো হয়েছে। তাই মানসিক স্বাস্থ্যের অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এই দিবসের তাৎপর্য আছে। এই দিবস পালনের মধ্য দিয়ে শারীরিক অনেক অসুস্থতার মত মানসিক অসুস্থতাও যে ব্যাধি বা রোগ এটি স্বীকার করাও গুরুত্বপূর্ণ, কারন শারীরিক বা মানসিক স্বাস্থ্য আলাদা নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মনে করে মানসিক, শারীরিক এবং সামাজিক কার্যকারিতা পরস্পর নির্ভরশীল। ক্রমবর্ধমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য, দীর্ঘস্থায়ী দ্বন্ধ, সহিংসতা এবং জনস্বাস্থ্যের জরুরী অবস্থা সমগ্রীক ভাবে মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে। এজন্য অন্য অসুস্থতার মত মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে ধারনা রাখতে হবে এবং সচেতন হতে হবে। প্রচলিত মানসিক অসুস্থতার মধ্যে এডিএইচডি (শৈশবের নিউরোডেভেলপমেন্টাল ব্যাধিগুলির মধ্যে একটি), দুশ্চিন্তা, উদ্বিগ্নতা, অটিজম, মাদক ব্যবহার, বাইপোলার ডিসঅর্ডার, কন্ডাক্ট ডিসঅর্ডার, হতাশা, বিষন্নতা, খাওয়ার ব্যাধি বা ইটিং ডিসঅর্ডার, বুদ্ধিবৃত্তিক অক্ষমতা, আচরণ নিয়ন্ত্রণে সমস্যা এবং সিজোফ্রেনিয়াসহ মানসিক ব্যাধিগুলো জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এর বাইরেও নানা রকমের মানসিক রোগের অস্তিত্ব আছে। শিশু, বৃদ্ধ, নারী ও পুরুষ যেকোনো বয়সের মানুষই মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
নানা কুসংস্কার, অসচেতনতা ও অপচিকিৎসা মানসিক স্বাস্থ্য সেবার বিষয়টিকে আরো জটিল করে তুলেছে। সামাজিক স্টিগমার কারণে মানসিক অসুস্থতা গোপন করা হয়। ফলে এই রোগীরা চিকিৎসাসেবা থেকে বি ত হচ্ছে ও অপচিকিৎসার স্বীকার হচ্ছে। মানসিক অসুস্থতার প্রথম ধাপ সচেতনতা এবং রোগ সম্পর্কে জানা, যা প্রতিরোধ ও প্রতিকার উভয় ক্ষেত্রেই ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। এছাড়া একেকটা মানসিক রোগের ধরন ও লক্ষণ একেক রকম হয়। তবে এগুলোর সবই ব্যক্তিগত, সামাজিক ও পেশাগত জীবনে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ হিসাবে আমরা যেন মানসিক স্বাস্থ্যে বিষয়ে গুরুত্ব দেই এবং এবিষয় নিয়ে আমাদেরকে আরও গভীর ভাবে বা নতুন করে ভাবতে হবে। এ বিষয়ে কাজের ক্ষেত্র আমাদের আরও বেশি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে, সমস্ত অংশিদারদের সাথে, সমস্ত সেক্টরের সম্পৃক্ততার প্রয়োজন আছে। ব্যক্তি পর্যায়েও আমাদের অবশ্যই মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে আরো যতœ শক্তিশালী হতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্যের চাহিদা ও সেবা সামঞ্জস্যপূর্ন করতে হবে।
শৈশব মানসিক বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ সময়, যেমন যৌক্তিকভাবে, আবেগগতভাবে, সৃজনশীলভাবে, বুদ্ধিগতভাবে এবং আধ্যাত্মিকভাবে শিশুর মানসিক বিকাশের সূচনা হয় শৈশবে। তাই মানসিক স্বাস্থ্যের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে আছে শিশু-কিশোর। ইউনিসেফের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, বৈশ্বিকভাবে ১০-১৯ বছর বয়সী প্রতি ৭ জন কিশোর-কিশোরীর মধ্যে ১ জনেরও বেশি মানসিক ব্যাধি নিয়ে জীবনযাপন করছে। প্রতিবছর প্রায় ৪৬ হাজার কিশোর-কিশোরী আত্মহত্যা করে, যা এই বয়সীদের মৃত্যুর শীর্ষ পাঁচটি কারণের একটি। বাংলাদেশসহ ২১টি দেশের শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের মাঝে ইউনিসেফ ও গ্যালাপ পরিচালিত আন্তর্জাতিক এক জরিপের প্রাথমিক ফলের কিছু অংশ 'দ্য স্টেট অব দ্য ওয়ার্ল্ড চিলড্রেন ২০২১' এ উঠে এসেছে। এতে দেখা গেছে, জরিপে অংশগ্রহণকারী ১৫-২৪ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে যে অংশ হতাশা বোধ করে বা কিছু করতে তেমন আগ্রহ পায় না, ২১টি দেশের মধ্যে ১৯ শতাংশ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা ১৪ শতাংশ। অর্থাৎ বাংলাদেশে লাখ লাখ তরুণ জনগোষ্ঠী রয়েছে, যারা নিয়মিত হতাশায় ভোগে বা উৎসাহহীন বোধ করে। অধিকন্তু, বয়ঃসন্ধিকালের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা এবং অসুস্থতার বিষয়েও ভাবনার অবকাশ আছে।
কোভিড ১৯ মহামারি আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর ব্যপক প্রভাব ফেলেছে এবং বিশ্বব্যাপী সঙ্কট তৈরি করেছে, যা এখনো চলমান আছে। ২০১৯ সালে মহামারীর আগে বিশ্বব্যাপী আটজনের মধ্যে একজন আনুমানিক মানসিক সমস্য নিয়ে বসবাস করছিল। একই সময়ে, মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য আমাদের উদ্যোগ, সেবা, সক্ষমতা এবং প্রয়োজনের চেয়ে তহবিল স্বল্পতা ছিল। বিশেষ করে নি¤œ এবং মধ্যম আয়ের দেশগুলিতে। অন্যদিকে, মানসিক সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতে প্রয়োজন ও বরাদ্দ দেওয়া তহবিলের মধ্যে বিস্তর ফাঁক রয়ে গেছে। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বৈশ্বিকভাবে সরকারগুলো স্বাস্থ্যখাতে যে বাজেট বরাদ্দ দেয় তার ২ শতাংশ ব্যয় করা হয় মানসিক স্বাস্থ্যের পেছনে। আমাদের দেশেও হয়তো এর ব্যতিক্রম নয়।
মানসিক স্বাস্থ্য সেবার সবচেয়ে বড় বাঁধা হিসেবে দেখা হয় স্টিগমা এবং বৈষম্যকে। স্টিগমা ও বৈষম্য সামাজিক অন্তর্ভুক্তি এবং সঠিক সেবার ক্ষেত্রে একটি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই গুরুত্বপূর্ণভাবে, আমরা সকলেই সচেতনতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা পালন করতে পারি যা প্রতিরোধমূলক মানসিক স্বাস্থ্য কার্যক্রম সমূহ আরো কার্যকর হবে। আর তার জন্য বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস ২০২২ এর মাধ্যমে পুনরায় মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং উন্নত করার বিষয়টি সামনে নিয়ে আসার সুযোগ আছে। বাংলাদেশে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ধিরে ধিরে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি মনোযোগ পাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য কৌশল পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। বিভিন্ন পর্যায়ে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সরকারী ও বেসরকারী পর্যয়ের সম্মিলিত উদ্যেগের মাধ্যমে আমাদের এই ব্যবস্থাকে এগিয়ে নিতে এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা সঙ্গে একীভূত করা প্রয়োজন। তাছাড়া, সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে থাকা শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের দিকে মনোযোগী হওয়া ও যতœ নেওয়ার প্রয়োজন যাতে তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা যায়। কারন প্রতিটি মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার আছে। সর্বপরি আমরা এমন একটি বিশ্বের কল্পনা করি যেখানে বৈষম্যহীন ভাবে মর্যাদার সাথে মানসিক স্বাস্থ্য সেবাকে নিশ্চিত ও অসুস্থদের সুরক্ষা প্রদান করা হয়।
https://www.who.int/campaigns/world-mental-health-day/2022
https://www.unicef.org/bangladesh/en/topics/mental-health
লেখক: পরিচালক, স্বাস্থ্য ও ওয়াশ সেক্টর, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন