মো. সাখাওয়াত হোসেন
গণতন্ত্রের সৌন্দর্য হচ্ছে জনগণ ও নির্বাচন প্রক্রিয়া। প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মালিক হচ্ছে জনগণ এবং নির্বাচন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই নেতৃত্ব নির্বাচিত হয়ে থাকে অর্থাৎ ক্ষমতার পালাবদল হয়ে থাকে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়েই সরকার গঠিত হয়, জনগণের ভোটাধিকারের মাধ্যমে সরকার নির্বাচিত হয়। তাই জনমুখী রাজনৈতিক দলগুলোও জনগণের কথা বিবেচনায় নিয়েই দলীয় কর্মসূচি প্রণয়ন করে থাকে। সাধারণত যে সকল কর্মসূচি প্রণয়নের মাধ্যমে সহজেই সর্বসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করা তথা সমর্থন পাওয়া যেতে পারে সে ধরনের কর্মসূচি দলগুলো উদ্যোগ নিয়ে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করে থাকে। রাজনৈতিক দলের নেতাদের দূরদর্শী ও জনবান্ধব সিদ্ধান্ত নিয়ে জনগণকে আকৃষ্ট করার প্রয়াস সবসময় আমরা দেখে থাকি। মূলত রাজনৈতিকভাবে স্বচ্ছ ধ্যান ধারণার অধিকারী নেতৃবৃন্দ, কল্যাণকর রাজনীতির স্বার্থে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়নের তাগিদে জনবান্ধব কর্মসূচি প্রদান করে। অবশ্য রাজনৈতিক দলের কর্মী সমর্থকদের পাশাপাশি আপামর জনসাধারণের অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশগ্রহণ ব্যতীত কোন রাজনৈতিক দল রাজনীতির মাঠে সফল হতে পারেনা।
সাম্প্রতিক সময়ে কূটনৈতিক পাড়ায় বিএনপির নেতৃত্বের আনাগোনা দেখে আপাতদৃষ্টিতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে চলে আসে। অনেকের মনে প্রশ্ন উঠেছে, রাজনৈতিক দল হিসেবে আদৌ কি বিএনপি তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে সক্ষম? প্রথমত- দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে কূটনৈতিকদের অযাথিত হস্তক্ষেপ কামনা করা কোনভাবেই সমীচীন নয়। যদিও স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার অধিকার কারোর নেই। তথাপি বন্ধু রাষ্ট্র, উন্নয়ন সহযোগী কিংবা বিভিন্ন সংগঠনের প্রধানগণ (যে সব সংগঠনের সদস্য বাংলাদেশ) বিভিন্ন জন-গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাদের পরামর্শ ও মতামত প্রদান করতে পারে কিন্তু কোনরূপ হস্তক্ষেপ করার অধিকার তাদের নেই।
দ্বিতীয়ত- জনগণকে পাশ কাটিয়ে ভিন্নপন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলে নেওয়ার একটি অপচেষ্টার মিশন হিসেবে আলোচ্য বিষয়টিকে দেখা হচ্ছে। গণমাধ্যমের বরাতে জানা যায়, কূটনৈতিকদের সাথে সাক্ষাত পর্ব শেষে বের হওয়ার পথে সাংবাদিকদের প্রশ্নের বিপরীতে জিজ্ঞেস করলে কি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে সে বিষয়ে বিএনপি নেতৃবৃন্দ মুখ খুলতে নারাজ। তাহলে যে বিষয়টি প্রকাশ করার মত নয়, জনগণের সামনে প্রকাশ্যে নিয়ে আসা যায় না সেসব বিষয়ে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
তৃতীয়ত-সাংগঠনিকভাবে বিএনপির শক্তিমত্তা ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে পড়ায় দলীয়ভাবে তেমন ভূমিকা রাখতে পারছে না, তাই তারা কূটনৈতিকদের দ্বারস্থ হচ্ছে। এর পিছনে অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপি জোটবদ্ধ হয়ে রাজনীতি করায় বিএনপির ত্যাগী নেতাকর্মীরা প্রতিবাদস্বরূপ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছে। এ বিষয়টি বিএনপির সাংগঠনিক ভিতকে দুর্বল করে ফেলছে, কালক্রমে দলটি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। সে কারণেই দল হিসেবে বিএনপি জনবান্ধব কর্মসূচি প্রণয়ন করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
চতুর্থত: চারদলীয় জোট সরকারের সময় বাংলাদেশের জনগণ দেখেছে, আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ পুলিশের টর্চার, টিয়ার শেল, মামলা হামলার ভয়কে উপেক্ষা করে রাজনীতির মাঠে সক্রিয় ছিলেন। সে জন্য তাদেরকে যথেষ্ট ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে, জীবনও দিতে হয়েছে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় অনেক নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন এবং আহতদের অনেকেই এখনো কাতরাচ্ছেন। শত বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও নেতৃবৃন্দ কর্মীদের পাশে ছিলেন, খোঁজখবর নিয়েছেন এবং দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। এ রকম ত্যাগী ও প্রতিশ্রুতিশীল নেতৃত্ব বিএনপিতে তেমন নেই বিধায় সাংগঠনিকভাবে বিএনপি সক্রিয় হতে পারছে না। উল্লেখ্য, ২১ জুন ২০০৮ সালে সুনামগঞ্জে আওয়ামী লীগের র্যালিতে বোমা হামলায় ১ জন নিহত ও আহত হয় ৫১ জন। ১৭ জানুয়ারি ২০০৫ সালে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলায় সাবেক অর্থমন্ত্রী এসএএমএস কিবরিয়াসহ ৫ জন নিহত হয় ও আহত হয় ১৫০ জন। এ ধরনের অসংখ্য ঘটনার উদাহরণ রয়েছে বিএনপি জামায়াত জোট সরকারের সময়ে, আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে অপশক্তিরা নিকৃষ্ট পথ বেছে নেয় তথাপি রাজপথ থেকে কখনোই পিছু হটেনি আওয়ামী লীগ। এ ধরনের বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় বিএনপিকে মোটামুটি রকমের নেতৃত্বশূন্য বলা চলে।
অন্যদিকে, বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে পারস্পারিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ও সহযোগিতার বিষয়ে মুন্সিয়ানা দেখিয়ে চলেছেন। সম্প্রতি দিল্লী সফরের পূর্বে চীনের ৬৯ কোটি ডলারের সহযোগিতায় কচা নদীর উপর নির্মিতব্য সেতু উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। এছাড়াও বাংলাদেশের নানাবিধ উন্নয়ন প্রকল্পে চীনের সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত হচ্ছে দিনদিন। সে কারণে বিএনপির পক্ষ থেকে বর্তমান সরকারকে ভারতপন্থী বলার যেমন সুযোগ নেই, ঠিক তেমনি চীন বিদ্বেষী বলারও সুযোগ নেই। যদিও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিএনপি ও তাদের জোটসঙ্গীদের এমন অভিযোগ ছিল দীর্ঘদিনের। কাজেই কূটনীতিকদের দ্বারস্থ হয়ে দলীয়ভাবে লাভবান হওয়ার তেমন একটা সুযোগ দেখা যাচ্ছে না।
২০১৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর বিবিসি বাংলায়, ‘কেন ঘনঘন বিদেশীদের শরণাপন্ন হচ্ছে বিএনপি’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায় বিশ্লেষকরা বলেছেন, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য বিএনপি ঘনঘন কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হয়। তারা মনে করেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রভাব রয়েছে। প্রকৃতঅর্থে কি বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার সক্ষমতা রয়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের? যদি একটু পিছনে ফিরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রেক্ষাপট আলোচনায় নিয়ে আসি, দণ্ডিতদের ফাঁসির আদেশ বাতিল করা জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লবিষ্ট নিয়োগ করেছিল দুষ্কৃতিকারীরা। শুধু তাই নয়, গণমাধ্যমের কল্যাণে দেখেছি নামীদামী প্রতিষ্ঠান ও দেশের কর্তাব্যক্তিগণ বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে টেলিফোনে মানবাধিকারের দোহাই দিয়ে ফাঁসির আদেশ বন্ধ করার অনুরোধ করেছিল। কিন্তু বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দৃঢ়চিত্তে তাদের প্রস্তাব নাকচ করে দেশীয় বিচারে বিচারকাজ সমাপ্ত করার দৃঢ় প্রত্যয় । পদ্মা সেতুতে বিশ^ব্যাংক চুক্তি বাতিল করায় দেশ বিদেশে হইহই রইরই পড়ে গেল, পদ্মা সেতু বিদেশী সাহায্য ছাড়া কোনভাবেই হবে না মর্মে দেশীয় বুদ্ধিজীবীরা (কথিত) বিবৃতি দিয়েছেন। কিন্তু সবাইকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজ দেশীয় অর্থায়নে নির্মিত পদ্মা সেতু বিশে^র বিস্ময়। সুতরাং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে সক্ষমতা, দৃঢ়তা ও গ্রহণযোগ্যতাকে ফুটিয়ে তুলতে সমর্থ হয়েছে এবং এসব কারণেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কূটনীতিকদের সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে পরামর্শ প্রদান ধৃষ্টতা ব্যতিরেকে অন্য কিছু নয় এবং এ কাজটি কূটনীতিকরা করবেন বলে মনে হয় না।
এদিকে, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে বিভিন্ন দলের সঙ্গে বৈঠক শুরুর পর থেকেই কূটনীতিকদের সাথে বিএনপির নেতৃবৃন্দের পুনরায় ঘনঘন বৈঠক রাজনৈতিক মহলে মোটামুটিভাবে সাড়া ফেলেছে। ১২ জুলাই জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপি নেতৃবৃন্দ। তাদের ভাষ্যমতে, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবিতে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করতে তারা তৎপরতা চালাচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বিএনপির বৈঠক হয়েছে। প্রতিনিধিদল অবশ্য নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন। উভয় পক্ষই সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে কথা বলেছেন। অবশ্য বিএনপির নেতৃবৃন্দ বৈঠকের আলোচিত বিষয় নিয়ে মুখ খুলতে নারাজ, তারা মুখে কুলুপ দিয়েছে। তবে সূত্র উল্লেখ করেছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে মাঠের রাজনীতির চেয়ে কূটনীতির রাজনীতিতে বিএনপি বেশি জোর দিচ্ছে। তারা বুঝতে পেরেছে, মাঠের রাজনীতির আন্দোলন নিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তাই তারা বিকল্প পথ হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাহায্য প্রার্থনা করছেন। সুতরাং বিএনপির জনমুখী না হয়ে কূটনীতিকদের দ্বারস্থ হওয়াকে জনগণ কিভাবে মূল্যায়ন করছে সময়ই তা বলে দিবে।
লেখক-সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।