গত ১৭ এপ্রিল বিএনপি'র সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের নতুন কমিটি ঘোষণা হওয়ার পর থেকে একের পর এক বিতর্কে আবর্তিত হচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। বিএনপি যখন আন্দোলনের রূপরেখা নিয়ে রাজনীতির মাঠ গরম করার চেষ্টা করছে সেখানে ঠিক উল্টো পথে হাঁটছে বিএনপির ভ্যানগার্ড খ্যাত সংগঠন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। নতুন কমিটি ঘোষণা হওয়ার এক সপ্তাহের মাথায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক সহাবস্থান হারায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল।
গত ২৪ মে ছাত্রদল মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলন করার ঘোষণা দিয়ে সংগঠনটির সিনিয়র সহ-সভাপতি রাশেদ ইকবাল খান, সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাকিবুল ইসলাম রাকিব, সাংগঠনিক সম্পাদক আবু আফসান ইয়াহিয়ার নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে গেলে শহীদ মিনার এলাকায় ছাত্রলীগের প্রতিরোধের মুখে পরে তখন শুরু হয় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ আহত হন রাশেদ ইকবাল, রাকিব, ইয়াহিয়া সহ-শতাধিক ছাত্রদল কর্মী।
ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের ছাত্রলীগের সাথে সংঘর্ষে ঠেলে দিয়ে সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ ও সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েল থাকেন নিরাপদ দুরত্বে।
আওয়ামী পরিবারের সন্তান ছাত্রদল সভাপতিকে শ্রাবনকে হেলমেট পরিহিত অবস্থায় মৎস ভবন এলাকায় ঝটিকা মিছিল এবং সাধারণ সম্পাদক জুয়েলকে দেখা যায় লাঠি হাতে হাইকোর্ট মোড় এলাকায়।সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে যেখানে মিছিলে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেবার কথা সেখানে কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে যাননি। ছাত্রলীগের হামলায় আহত ছাত্রদল কর্মীদের চিকিৎসার বিষয়েও তাদের ভেতর উদাসীনতা লক্ষ করা যায় যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল নেতাকর্মীদের মনোবল দূর্বল করে ফেলে। উক্ত ঘটনা প্রবাহে ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার রাজনৈতিক সহবস্থান হারায়।
পরবর্তী সময়ে ছাত্রদল সভাপতি এবং সাধারন সম্পাদক তাদের পকেটের লোক দিয়ে ঢাকার সুপার ইউনিট খ্যাত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, কবি নজরুল সরকারি, ঢাকা কলেজ তেজগাঁও কলেজ, সরকারি বাংলা কলেজ, তিতুমীর কলেজ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রল ঢাকা মহানগর পশ্চিম ছাত্রদল কমিটি গঠন করেন। এখানে মোট ৯ টি ইউনিট কমিটির সভাপতি/সাধারণ সম্পাদকের ১৮টি পদের বিপরীতে ১৩ টিতে বরিশাল অঞ্চলের ছাত্রনেতাদের পদায়ন করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ছাত্রদল কর্মী বলেন, 'ওয়ান-ইলেভেনের সংস্কারপন্থী ছাত্রদল নেতা জুয়েল ছাত্রদলকে "বরিশাল ছাত্রকল্যাণ সমিতিতে "পরিণত করেছেন। সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ প্রতিটি কমিটিতে শতকরা ৭০ ভাগ পদ দেয়া হয়েছে বরিশাল অঞ্চলের ছাত্রনেতাদেরকে।
পরবর্তী সময়ে গত আগস্ট মাসে ছাত্রদল সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণের একটি অশ্লীল ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে সংগঠনটি ছাত্র সমাজের কাছে ব্যাপকভাবে নিন্দিত হয়। ঢাকা মহানগর উত্তর ও পশ্চিম ছাত্রদল, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের কমিটি এস এস সি ২০০১ সালকে মানদন্ড ধরা হলেও কেন্দ্রীয় কমিটি করা হয় এস এস সি ২০০৩ সালকে মানদন্ড ধরে। কেন্দ্রীয় সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকের ঘনিষ্ঠ জনরা বিবাহিত ও সন্তানের জনক হয়েও ঢাকার বিভিন্ন ইউনিটে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
গত ১১ সেপ্টম্বর কেন্দ্রীয় কমিটি পূর্নাঙ্গ হলে দেখা দেয় নতুন বিপত্তি। সদ্য সাবেক সভাপতি খোকন এবং সাধারণ সম্পাদক শ্যামলের অনুসারীরা অধিকাংশ বাদ পড়েন এই কমিটিতে। সদ্য ঘোষিত পূর্নাঙ্গ কমিটিতে ৪৩ জন বিবাহিত, ৫ জন এসএসি ২০০০ সালের পূর্বে (ক্রাইটেরিয়া বর্হিভূত)পাওয়া যায়। সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছাত্রদল কেন্দ্রীয় কমিটিতে ৬ জন পাওয়া যায় যারা এস এসসি পাশ করেননি অর্থাৎ আন্ডার মেট্রিক।১ জন প্রবাসীকেও স্থান দেয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় কমিটিতে।
পূর্নাঙ্গ কমিটি ঘোষণা হওয়ার পর সংগঠনটির পদবঞ্চিত নেতাকর্মীরা কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তালা লাগান এবং বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিতর্কিত নেতাকর্মীদের তালিকা ভাইরাল হয় এবং সমালোচনার মুখে পড়ে সংগঠনটি। পদবঞ্চিত নেতাকর্মীরা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে স্মারকলিপি প্রদান করেন। যার প্রেক্ষিতে ১৬ সেপ্টেম্বর ৩৩ জনের পদ স্থগিতের প্রেসরিলিজ আসে।এখানেও সভাপতি এবং সাধারন সম্পাদক নতুন বিতর্কের জন্ম দেয়। তারা তাদের অতি ঘনিষ্ঠ ৭জনকে পদ স্থগিতের তালিকা থেকে বাদ দেন এবং তাদের পদ বহাল রাখেন। এছাড়া জেলার সভাপতি/ সাধারণ সম্পাদক যাদের বিভাগীয় পদ (বিভাগীয় সহ-সভাপতি, বিভাগীয় সহসাংগঠনিক) দেওয়া হয় এই কমিটিতে তা মানা হয়নি। উপরুন্তু উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের অনৈতিক সুবিধার বিনিময়ে স্থান দেওয়া হয় পূর্নাঙ্গ কমিটিতে।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ভালো ইতিহাস থাকলেও বর্তমান সময়ে নাজুক পরিস্থিতিতে পরেছে সংগঠনটি। গত ২০২০-২০২১ সালে সংগঠনটি সারা বাংলাদেশে প্রায় ১৬০০ থানা, পৌরসভা, কলেজ কমিটি সম্পন্ন করে। ৪৫ টি জেলা ও জেলা পদমর্যাদার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ইউনিট কমিটি গঠন করে। সারা বাংলাদেশে শতকরা ৮০ ভাগ ইউনিয়ন কমিটি গঠন করে সরকার বিরোধী আন্দোলনের প্রস্তুতি চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে এসেছিল তখন বর্তমান নেতৃত্বের একের পর এক বিতর্কিত কর্মকান্ড সংগঠনটিকে জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। সদ্য ঘোষিত কেন্দ্রীয় পূর্নাঙ্গ কমিটিতে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ সবার মুখে মুখে। পূর্নাঙ্গ কমিটির পাশাপাশি ছাত্রদলের ১নং ইউনিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটি ঘোষণা করা হয় যা ছাত্রদলের ইতিহাসে সবচেয়ে দূর্বল কমিটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল কমিটি নিয়েও নেতাকর্মীদের ভেতর চরম হতাশা দেখা দিয়েছে।সবমিলিয়ে বর্তমান সময়ে বিতর্ক যেন গলার মালায় পরিনত হয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের।