অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যাপকভাবে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের মধ্য দিয়ে নতুন যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ইভিএম ব্যবহারে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সংলাপে ইভিএম ব্যবহারের বিষয়টি বেশ গুরুত্ব পেয়েছে। সংলাপে অংশগ্রহণকারী ২৯টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ১৭টি পক্ষে আর ১২টি বিপক্ষে অভিমত দিয়েছে। আসন্ন নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৫০টি আসনে ইভিএম ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। ইভিএম পদ্ধতিতে দেশে ইতোমধ্যে বেশ কিছু নির্বাচন সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন হয়েছে। বাংলাদেশে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে ডিজিটাল এ ভোটগ্রহণ পদ্ধতি ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা করেছে। ডিজিটাল বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের দেশেও ইভিএমে শতভাগ আসনে ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হবে, এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
ইলেকট্রনিক ভোটিং পদ্ধতি একবিংশ শতাব্দীতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করার জন্য ভোটারদের নিজস্ব মতামত প্রতিফলন করার অন্যতম মাধ্যম। ভোট প্রয়োগে মেশিন বা ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হয় তাই সামগ্রিক প্রক্রিয়াটি ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা 'ইভিএম' নামে পরিচিত। এর অন্য নাম ‘ই-ভোটিং’। ইলেকট্রনিক প্রক্রিয়ায় এটি একাধারে সঠিকভাবে ভোট প্রয়োগ ও দ্রুততার সঙ্গে ভোট গণনা করতে সক্ষম। এছাড়াও ভোট গ্রহণে স্বচ্ছতা এবং উপযুক্ত ক্ষেত্র হিসেবে ক্রমশই গোটা বিশ্বে এটি গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছে। ১৯৬৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৭টি অঙ্গরাজ্যের নির্বাচনে সর্বপ্রথম ইভিএম পদ্ধতি অনুসৃত হতে দেখা যায়; ক্রমান্বয়ে পাঞ্চ কার্ডের মাধ্যমে ভোট গ্রহণের বিষয়টি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
ইভিএম ব্যবহার করে ইতোমধ্যেই ভোট নেয়া হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। এর মধ্যে আছে, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, ব্রাজিল, কানাডা, এস্তোনিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ফ্রান্স, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, পেরু, রোমানিয়া, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, ভেনেজুয়েলা, ফিলিপাইন প্রভৃতি । এসব দেশে ভোট গ্রহণের স্থান হিসেবে ভোট কেন্দ্রেই মূলত ইভিএম ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও ইন্টারনেট, ব্যক্তিগত কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, টেলিফোন ব্যবহার করেও ই-ভোটিং প্রয়োগ করা সম্ভব। নতুনতর অপটিক্যাল স্ক্যান ভোটিং পদ্ধতিতে পাঞ্চ কার্ড, অপটিক্যাল স্ক্যানার ব্যবহৃত হয়। এ পদ্ধতিতে একজন ভোটার ব্যালট পেপারকে চিহ্নিত করে ভোট প্রদান করেন। অন্যদিকে ডিআর ইভিএম (ডাইরেক্ট রেকর্ডিং ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) ভোটিং পদ্ধতিতে একটিমাত্র মেশিনের সাহায্যে ভোট সংগ্রহ ও গণনা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ব্রাজিল এবং ভারতে সব ভোটার সব ধরনের নির্বাচনে এটি ব্যবহার করে থাকেন। এছাড়াও ভেনেজুয়েলা এবং যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপকভাবে ডিআরই ভোটিং পদ্ধতির প্রচলন রয়েছে।
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানানোই যায়। বিএনপির অভিযোগ ও নানা শঙ্কা সত্ত্বেও বলতে হয়, ইভিএম পদ্ধতি ব্যবহারে কারচুপির কোনো সুযোগ নেই। কারণ এটি অপারেট করার জন্য প্রিসাইডিং বা সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারের বায়োমেট্রিক্স নেয়া থাকে, তাই তারা ছাড়া কেউ অপারেট করতে পারে না। কোনো কারণে মেশিন নষ্ট হলেও গৃহীত ভোট নষ্ট হয় না। মেশিনের কার্ডে শুধু নির্দিষ্ট কেন্দ্রের ভোটারদের তথ্য থাকে ফলে অন্য কেউ ভোট দিতে পারে না। আবার কেউ কারো ভোট মুছেও দিতে পারে না। কেউ একাধিকবার বাটন চাপলেও প্রথমে যেখানে ভোট দিয়েছেন সেটিই থেকে যায়। আবার মেশিনটিতে ব্যবহারের জন্য স্মার্টকার্ড থাকে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে, ফলে অন্য কেউ বুথ কক্ষ দখল করলেও নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের সমস্যা হয় না।
অন্যদিকে নির্দিষ্ট সময় শেষে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কন্ট্রোল ইউনিট থেকে ক্লোজ সুইচ চাপলে ভোট দেয়ার আর কোনো সুযোগ থাকে না। ইভিএম কোনোভাবেই ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযুক্ত নয়, তাই হ্যাক করা যায় না, যে কেন্দ্রের ইভিএম তা দিয়ে সেই কেন্দ্রেই ভোট দেয়া যায়। ভোটার যখন ভোট দিতে এসেছেন তখন স্মার্টকার্ড বা পরিচয়পত্র নম্বর বা ফিঙ্গার প্রিন্টার দিয়ে যাচাই করে তাকে ভোট দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়। এর কোনো একটি দিয়ে যাচাইয়ের পর ভোটারের ছবি প্রজেক্টরে দেখা গেছে যেটা সব প্রার্থীর এজেন্টরাও দেখতে পেয়েছেন এবং এরপর তিনি ভোটদানের গোপন কক্ষে প্রবেশের সুযোগ পান। কোনো ধরনের কাস্টমাইজেশন ছাড়াই একই মেশিনে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা, পৌরসভা এবং জাতীয় পর্যায়ে নির্বাচন পরিচালনা করা হয়। প্রত্যেক নির্বাচনের আগে ভোটারদের ডেটা, প্রার্থীদের ডেটা, প্রিসাইডিং অফিসারদের আঙুলের ছাপসহ তথ্য এবং নির্বাচন সম্পর্কিত অন্যান্য তথ্য এসডি কার্ড এবং স্মার্ট কার্ডে কাস্টমাইজ করে নির্বাচন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। এসব তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই মেশিন নির্বাচন কার্য সম্পাদন করে।
এসডি কার্ড ও স্মার্ট কার্ডে কোনো প্রোগ্রাম থাকে না। এই কার্ডগুলো কীভাবে কাস্টমাইজেশন করা হবে, প্রার্থীদের এবং প্রতীকগুলোর সিরিয়াল কী হবে, তা মেশিনের জানা থাকে না। নির্বাচন কমিশনের আইন অনুযায়ী এসডি কার্ড ও স্মার্টকার্ড কাস্টমাইজেশনের সময় প্রার্থী অথবা তাদের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকতে পারেন। ইভিএম মেশিন কেবল একটি ক্যাসেট প্লেয়ারের মতো কাজ করে বলে কার্ডগুলোয় দেয়া ডেটা যেভাবে যে সিরিয়ালে দেওয়া হবে, মেশিন ঠিক সেইভাবে একই সিরিয়ালে কাজ করবে। যেহেতু মেশিন ও কাস্টমাইজেশন সম্পূর্ণ আলাদা প্রক্রিয়া এবং নির্বাচনের আগে প্রোগ্রাম কাস্টমাইজেশন করার কোনো সুযোগ নেই, তাই এই মেশিনে এক প্রতীকে প্রদত্ত ভোট অন্য প্রতীকে স্থানান্তর সম্ভব নয়। তার ওপর একই প্রোগ্রাম যেহেতু সব মেশিনে ব্যবহৃত হয়, তাই প্রোগ্রামে কোনো ধরনের সমস্যা থাকলে তা সব মেশিনেই প্রতিফলিত হতো এবং এটি দৃষ্টির অন্তরালে রাখা সম্ভব হতো না। কিন্তু এই ধরনের কোনো সমস্যা কখনও দেখা যায়নি। বৈধ ভোটার শনাক্ত হওয়ার পর ভোটার গোপন কক্ষে উপস্থিত হন যেটি ব্যালট ইউনিট হিসেবে পরিচিত।
সেখানে ঢুকেই তিনি মেশিনে ব্যালট পেপার দেখতে পান এবং প্রতীকের পাশে থাকা বাটন চাপ দিয়ে ভোট দেন। ভোট দেয়ার পর স্ক্রিনে যাকে ভোট দিয়েছেন সেই প্রার্থীর প্রতীকের ছবি ভেসে উঠে। এটিই ভোটারের
জন্য কনফার্মেশন যে তিনি কোন মার্কায় ভোট দিয়েছেন। ভোটার কনফার্ম করার বাটনে চাপ দিলে একটি শব্দ আসে যাতে বোঝা যায় যে তার ভোট দেয়া হয়ে গেছে। ইভিএম-এর পুরো প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ এবং সুবিধাজনক। বর্তমানে উদ্ভাবিত এবং ব্যবহৃত ইভিএম মেশিনটি ২০১৩ সাল পর্যন্ত ব্যবহৃত ইভিএম মেশিন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এগুলো একবার তৈরির পর আর কাস্টমাইজ করতে হয় না, ফলে এই মেশিনে কোনো প্রকার ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বা ভোট কারচুপির সুযোগ নেই। নতুন এই মেশিনে একজনের ভোট আরেকজন দিতে পারে না এবং ভোটের সময় ছাড়া এর আগে বা পরের দিনে বা রাতে কখনই ভোট দেওয়া যায় না। ভোটার আঙুলের ছাপ দিলেই কেবল ইলেকট্রনিক ব্যালট পেপার ভোটদানের জন্য উন্মুক্ত হয়, অন্যথায় নয়। ব্যালট পেপার অন হওয়ার পর ভোটার তার ভোট প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে তা আবারও অকেজো হয়ে যায় এবং অন্য একজন ভোটারের আঙুলের ছাপ না দেওয়া পর্যন্ত আর ভোটদানের জন্য উন্মুক্ত হয় না। একজন ভোটার দ্বিতীয়বার ভোট দিতে চাইলে মেশিন নিজেই তাকে ভর্ৎসনা করে ফিরিয়ে দেয়। মানুষের করা অনিয়মের সব প্রচেষ্টাকে এই মেশিন তার নিজস্ব ক্ষমতাবলে নস্যাৎ করে দেয়। কোনোভাবেই কেন্দ্র দখল করে ভোট দেওয়া যায় না বিধায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা আর রক্তপাতের সূত্রপাতের কোনো সুযোগ থাকে না এই ব্যবস্থায়।
ইভিএম পদ্ধতি যে পূর্ববর্তী নির্বাচন পদ্ধতিগুলোর চেয়ে অধিকতর স্বচ্ছ তার প্রমাণস্বরূপ বিগত কয়েকটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। চট্টগ্রামের সিটি কর্পোরেশনের ১৪টি কেন্দ্রে ও নারায়ণগঞ্জের সিটি কর্পোরেশনের ৫৮টি কেন্দ্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছিল। ৫ জানুয়ারি, ২০১২ সালে অনুষ্ঠিত কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের বেশ কিছু কেন্দ্রে প্রথমবারের মতো ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ করা হয়। তবে ২০১৭ সালের ৩০ মার্চ কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের দ্বিতীয়বারের পুরো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম ব্যবহারের মাধ্যমে। এটি ছিল ভোট গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহারের ইতিহাস।
লক্ষণীয় উল্লিখিত নির্বাচনগুলোতে ইভিএম কেন্দ্রে ভোটারদের দীর্ঘ লাইন বলে দিয়েছিল আধুনিক এ প্রযুক্তিতে ভোট দিতে আগ্রহের কমতি নেই তাদের। তরুণ ও মধ্যবয়স্ক ভোটাররাই বেশি স্বাচ্ছন্দে ভোট দিয়েছেন ইভিএমে। ইভিএমে নিজের উৎসাহ নিয়েই ভোট দিয়েছেন ভোটাররা। ভোটারদের অভিমত হলো, ইভিএম ব্যবহার করে খুব সহজেই অল্প সময়েই অনেকটা নিরাপদেই ভোট দিতে পেরেছেন তারা। কারণ ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল এখন সকলের কাছে দিবালোকের মতো উদ্ভাসিত। এভাবে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারে ভোটারদের অনেকেরই আগ্রহের কথা জানা গেছে এবং এটা ব্যবহারের জন্য প্রশিক্ষিত জনবলও গড়ে তোলা হয়েছে। আসলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও ভোটারদের ইভিএমের ব্যবহার শেখানো এবং জনগণকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে তুললে এটির জনপ্রিয়তা আরো বৃদ্ধি পাবে।
বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার প্রতিশ্রুত ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পদক্ষেপকে কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে নির্বাচন ক্ষেত্রে ইভিএম এর ব্যবহার। এতে করে একদিকে যেমন নির্বাচনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে, সেই সাথে নির্বাচন পদ্ধতির ক্ষেত্রে যে সময় ও অর্থের খরচ হয় তা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। এর সুফল হিসেবে সুশাসন ব্যবস্থা আরও সুসংহত হবে বলে আশা করা যায়।
লেখক: কোষাধ্যক্ষ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়; সাবেক চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।