আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সারিতে থাকা সর্বাপেক্ষা বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ছিলেন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। মহীয়সী এ নারীর রাজনীতিতে নাম লেখানোর ইতিবৃত্তটা অনেকটা রূপকথার গল্পের মতো। সাংবাদিকতার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকায় তাঁকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। দীর্ঘদিন অসুস্থতার বিরুদ্ধে লড়েছেন। ৮৭ বছর বয়স জয় করেছেন। পৃথিবীর মায়াত্যাগ করে প্রস্থান হলেও আওয়ামী লীগের ভেতরে তথা জাতীয় রাজনীতির ইতিহাসে সুনিপুণভাবে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রেখে গেছেন নিজের নামটি । পৌনে এক শতাব্দীকাল ধরে প্রদীপ্তমান যে আওয়ামী লীগের শৌর্যবীর্যে পরিচালিত বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি, সেই দলটির একমাত্র নারী সাধারণ সম্পাদক তিনি- সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। মৃত্যুবরণ করেছেনও সংসদ উপনেতার আর দলীয় সভাপতিমণ্ডলীর এক নম্বর সদস্য পদবীর ভূষণ গায়ে জড়িয়ে। মহান স্রষ্টা তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসীব করুন। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা সাজেদা চৌধুরীর রাজনৈতিক জীবনের শুরুর গল্পটা এখন তুলে ধরছি।
১৯৫৪। পাকিস্তানে আইন পরিষদগুলোতে প্রথম সাধারণ নির্বাচন। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচনী বৈতরণি পার পেতে শেরেবাংলা-সোহরাওয়ার্দী- ভাসানীর নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ করেছে যুক্তফ্রন্ট। শেখ মুজিব যার মুখপাত্র হিসাবে মধ্যমনি। (প্রসঙ্গত ওই নির্বাচনে সোহরাওয়ার্দীর ভবিষ্যতবানী সত্যে পরিণত করে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ মোটে ৯টি আসন পেয়েছিলো।)
যাহোক কুষ্টিয়ায় হয়েছিলো, যুক্তফ্রন্টের প্রথম নির্বাচনী জনসভা। বক্তৃতা করে খোশমেজাজে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন নেতারা। সেই মানুষকে সময়ে গোয়ালন্দঘাট থেকে স্টিমারে করে নারায়ণগঞ্জ আসতে হতো। স্টিমার ছাড়ার কিছু সময় পার হওয়ার পর একটি মেয়ে মমিনুল হক নামে এক জনৈক ব্যক্তির দৃষ্টি আকর্ষণ করে জিজ্ঞেস করলো, "ঐ যে ব্যক্তিটি তিনি তো শেখ মুজিবুর রহমান তাই না? উনার ছবি ও বক্তব্য দেখি পত্রপত্রিকায়। উনি কী আপনার আত্মীয়?"
মমিনুল হক প্রতিত্তোরে মেয়েটিকে জানালেন যে, হ্যাঁ, তিনি শেখ মুজিব,আমার ফুফাতো ভাই, পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সেক্রেটারী। সহাস্যমুখী মেয়েটি পরম আগ্রহভরে বললেন, " মেহেরবানি করে উনার (শেখ মুজিব) সঙ্গে আমাকে একটু পরিচয় করিয়ে দিন, আমি উনার জেলারই মেয়ে।"
মমিনুল হক তার আবদার পূরণ করতে শেখ মুজিবের কাছে গিয়ে বললেন, "মিয়াভাই আপনার সঙ্গে এই মেয়েটি পরিচয় হতে চায়।"
শেখ মুজিব হাসিমুখে মেয়েটির নাম ও বাড়ী কই জানতে চাইলেন?
মেয়েটি বললেন, "নাম আমার সাজেদা, বাড়ী আমার ফরিদপুরের নগরকান্দা।"
শেখ মুজিব এবার বললেন, "আরে নগরকান্দা তো ভাঙ্গার পাশেই তো, ওইখানে আমার ফুফুর বাড়ি।"
মেয়েটিকে শেখ মুজিব বললেন, "তো বিয়েসাদী হয়েছে নাকি পড়াশোনা শেষ করে ঘরে বসে আছো?"
মেয়েটি কিছুটা লজ্জাবোধে এবার বললো, "আমার স্বামী গোলাম আকবর চৌধুরী, থাকেন চাঁটগায়, সেখানের উদ্দেশ্যেই রওনা হয়েছি।
মেয়েটিকে উচ্চশিক্ষা আর চটপটে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মনে হওয়ায় শেখ মুজিব শেষমেশ বলে বসলেন, " তো ঘরে বসে থেকে কী হবে? আওয়ামী লীগ করো, মানুষের জন্য সংগ্রাম করো, আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের সংগ্রাম আমরা শুরু করে দিয়েছি। আমার আওয়ামী লীগে এখন তোমাদের মতো মেয়েদেরই দরকার।" নেতার কথা শুনে মেয়েটি এবার সম্মতিসূচক মাথা নাড়িয়ে বললেন, হ্যাঁ তাই হবে। স্টিমার চাঁদপুর ঘাটে পৌঁছলে মেয়েটি নেতাকে সালাম করে আশীর্বাদ মাথায় চাপিয়ে বিদায় নিলেন। সত্যিই সেদিনকারের মেয়েটি সাজেদা শেখ মুজিবের পরম স্নেহে ক্রমে বিকশিত হতে লাগলেন। তেজস্বী মনোভাব, দেশপ্রেম, নিষ্ঠা, ত্যাগ আর শ্রম, নেতার প্রতি অকুন্ঠ আস্থা, আনুগত্য আর অদম্য নেতৃত্বগুণ সাজেদা থেকে হয়ে ওঠেন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। নামের সঙ্গে পদপদবী তাঁকে অসাধারণ ও অপূর্ব করে রেখেছে, তৃর্ণমূল হতে শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিতে, সশস্ত্র হাতে মুক্তিয়ুদ্ধের ইতিহাসে। তাঁর নেতৃত্বাধীন মুক্তিযুদ্ধের মহিলা ফ্রন্টই স্বাধীনতাত্তোর আত্মপ্রকাশ করে "বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগ" রূপে। যার প্রতিষ্ঠাতা সভানেত্রী স্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রিসভার প্রথম সদস্য বদরুন্নেসা আহমেদ ও প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। পাকিস্তান গণপরিষদের সংরক্ষিত মহিলা আসনের এবং পরবর্তীতে প্রথম জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনের সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ১৯৭২ ও ১৯৭৪ সালের আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে মহিলা সম্পাদিকা নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ - বাকশাল প্রবর্তন হলে এর অন্যতম অঙ্গ জাতীয় মহিলা লীগেরও সাধারণ সম্পাদিকা নিযুক্ত হন।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়লেও অচিরেই দলকে সংগঠিত করতে মাঠে-ময়দানে নেমে পড়েন। ১৯৭৬ সালে ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলে প্রকাশ্য জনসভায় সর্বপ্রথম সাজেদা চৌধুরীই বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চারনেতা হত্যার বিচার দাবি করে তৎকালীন সামরিক সরকারের বিধিনিষেধের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেন। ওই সমাবেশ শেষ করে ঢাকায় পৌঁছতেই সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা ধরে নিয়ে যায় সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ও তার সফরসঙ্গী মোজাফফর হোসেন পল্টুকে। কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে আবারও সক্রিয় হন সাজেদা চৌধুরী। রাষ্ট্রপতি এএসএম সায়েমের নেতৃত্বাধীন সামরিক সরকার "রাজনৈতিক দলবিধি আইন" জারী করলে। আওয়ামী লীগের পুনর্গঠনের প্রশ্ন সামনে চলে আসে। তখন অধিকাংশ নেতা কারাবন্দী নয়তো বিতর্কিত হয়ে পড়েছেন খুনী মোশতাকের মন্ত্রীত্বগ্রহণের কারণে। বঙ্গবন্ধু হত্যার দুই সপ্তাহের ব্যবধানে পহেলা সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতি খুনী মোশতাক আহমেদ "রাষ্ট্রপতির বাকশাল আদেশ" বাতিল ঘোষণা করে।
ফলে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারী পূর্ব অধুনালুপ্ত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বকে পুনর্বহাল করে। ওই কমিটির সভাপতি এএইচএম কামরুজ্জামান অপর তিন জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ ও এম মনসুর আলীর সঙ্গে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর কারাগারে হত্যার শিকার হন। যে কারণে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন সিনিয়র সহসভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ। সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক, প্রচার সম্পাদক সরদার আমজাদ হোসেনসহ সম্পাদক মণ্ডলীর অধিকাংশ সদস্য কারাবন্দী থাকায় ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বলাভ করেন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। সামরিক দলবিধি আইন অনুযায়ী সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সাজেদা চৌধুরী সরকারের আইন মন্ত্রণালয় বরাবরে রাজনৈতিক দল হিসাবে আওয়ামী লীগ অনুমোদন চেয়ে আবেদন করে। কিন্তু মেনিফেস্টোতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম থাকায় তা ফিরিয়ে দেয় আইন মন্ত্রণালয়। বলা হয় আবেদনটি দলবিধি আইনের দশ নম্বর ধারা পরিপন্থী। উল্লেখ্য দশ নম্বর ধারায় বলা হয়েছিলো যে, কোন দল ব্যক্তিপুজা করতে পারবে না। মানে বঙ্গবন্ধুর নাম রাষ্ট্রীয়ভাবে যেমন নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো তদ্রূপ দলীয়ভাবে নিষিদ্ধকরণ প্রক্রিয়ার অংশ ছিলো এটি। কৌশলগত কারণে আওয়ামী লীগকে নতুন মেনিফেস্টো ছাপিয়ে আবার আইন মন্ত্রণালয় বরাবরে আবেদন করতে হয়েছিল। ১৯৭৬ সালের ৪ নভেম্বর আওয়ামী লীগ সরকারী অনুমোদনলাভ করে।
পরবর্তীতে আহবায়ক জোহরা তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল হলে আব্দুর রাজ্জাক সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৮১ সালে আব্দুল মালেক উকিলকে সরিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে সভাপতি ও আব্দুর রাজ্জাক সাধারণ সম্পাদক হন। কিন্তু ১৯৮৩ সালের ৮ আগস্ট আব্দুর রাজ্জাক বহিষ্কার হলে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন আবারও সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। ১৯৮৭ সালে কাউন্সিলে সাজেদা চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং ১৯৯২ সাল থেকে গত সর্বশেষ কাউন্সিল পর্যন্ত সবগুলো কাউন্সিলে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত হন। সামরিক জান্তা জেনারেল জিয়ার বিশেষ করে স্বৈরাচারী জেনারেল এরশাদ বিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর ভুমিকা অবিস্মরণীয়। তাইতো ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের ন্যায় ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনেও বিজয়ী হতে না পারলেও সংরক্ষিত মহিলা আসনে বিজয়ী করে তাকে বন ও পরিবেশ মন্ত্রী করা হয়।
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার একচ্ছত্র নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে বিশিষ্ট ভুমিকা রাখেন তিনি। নিজেকে কখনও উপদলীয় কোন্দলে জড়াননি। বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বের প্রতি আস্থা ও আনুগত্যে অনন্য সাধারণ এক ব্যতিক্রমী এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। পৌনে এক শতাব্দীর যে আওয়ামী লীগ তার একমাত্র নারী সাধারণ সম্পাদক সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। তাঁর স্বামী গোলাম আকবর চৌধুরীও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাত্তোর তাঁর ভুমিকাও অসাধারণ। সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে ফুফু সম্মোধন করতেন। জাতীয় সংসদ উপনেতা নির্বাচিত হওয়ার পরপরই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছুটে যান সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আপন ফুফু হয়েই যেন ভাতিজি শেখ হাসিনাকে বুকের ভেতরে আগলে রেখেছিলেন। তা হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতেন বলেই শেখ হাসিনা শয্যাশায়ী সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে দেখতে হাসপাতালে ছুটে গিয়েছিলেন। আবেগাপ্লুত হয়ে শেখ হাসিনা প্রিয় ফুফুর কপালে- গালে মুহুর্মুহু চুমোয় ভালোবাসার পরশ মেখে দিয়েছিলেন।
তখন ফুফু-ভাতিজির দুজনার চোখেই বয়ে যাচ্ছিলো অশ্রু জলপ্রপাত। সুস্থ হয়ে বাসভবনে ফিরে গিয়েছিলেন সংসদ উপনেতা সৈয়দ সাজেদা চৌধুরী। নিয়তি তাঁকে বাড়ি বন্দী করে রেখেছিলো বহুদিন ধরে। উপনেতার আসন শূন্য পড়ে থাকলেও হয়তো "নেতা" শেখ হাসিনা আসনটিতে প্রিয় সহযোদ্ধা ফুফুর ছায়া দেখতে পেতেন। তাইতো অসুস্থতাজনিত কারণ দেখিয়ে 'উপনেতার' আসনটি অন্য কাউকে অলংকৃত করার সুযোগ দেননি। শেখ হাসিনার বিকল্প বুঝি এজন্যই শেখ হাসিনা।
লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ইতিহাস গবেষক।