আরো একটি স্বপ্ন বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে দক্ষিণজনপদের মানুষের। দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমা লের মানুষের বহুল কাক্সিক্ষত পিরোজপুরে কচা নদীর ওপর নির্মিত অষ্টম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী বেকুটিয়া সেতু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ ৪ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টায় গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সেতুটির উদ্বোধন করবেন।
কাউখালীর বেকুটিয়া ও পিরোজপুরের কুমিরমারা পয়েন্টে কঁচা নদীর ওপর নির্মিত অষ্টম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতুর নামকরণ করা হয়েছে বঙ্গমাতা বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব নামে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সেতু নির্মাণ প্রকল্প ব্যবস্থাপক মাসুদ মাহমুদ সুমন।
তিনি আরো জানান, করোনা মহামারীর মধ্যেও ৩০ জুন এই সেতু নির্মাণ কাজ শেষ করে চীনের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ১৭তম ব্যুরো গ্রুপ কোম্পানী লিমিটেড।
গত ৭আগস্ট চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই’র এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের উপস্থিতিতে ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাসের ইকনোমি মিনিস্টার বাংলাদেশর সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে সেতুটি হস্থান্তর দলিলে স্বাক্ষর করেন। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্মতিক্রমে আগামী ৪ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সেতুটি উদ্বোধনের তারিখ নির্ধারণ করেন।
দক্ষিণা লের গুরুত্বপূর্ণ সেতুটি চালু হলে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে খুলনা হয়ে বাংলাদেশের দক্ষিণবঙ্গের বরিশাল, কুয়াকাটা পর্যন্ত ফেরিবিহিন নিরবচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার স্বপ্নের দুয়ার খুলে যাবে। এর ফলে গতি আসবে এ অ লের অর্থনীতিতে।
স্বপ্নের এই বেকুটিয়া সেতু দক্ষিনা লের দুই বিভাগকে এক করে দিয়েছে। সেতুটি চালু হলে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত, পায়রা ও মোংলা সমুদ্র বন্দর এবং বেনাপোল ও বাংলাবান্ধা স্থল বন্দরকে সরাসরি সড়ক পথে সংযুক্ত করবে যার ফলে যাতায়াতে অনেক সময় কমবে। এ অ লের ২১টি জেলার সাথে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ ও যাতায়েতের সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে অষ্টম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু।
পদ্মা সেতু, পায়রা সমুদ্র বন্দর, পায়রা তাঁপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা সেতু এই প্রকল্প পুরো দক্ষিণজনপদ বদলে দিয়েছে। তার মধ্যে আবার এই বেকুটিয়া সেতু উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। যার মাধ্যমে এ অ লের বাণিজ্যিক সুবিধা আরো বৃদ্ধি পাবে। প্রতিদিন দৃষ্টিনন্দন সেতুটি দেখতে কৌতুহল মানুষের ঢল নামে।
সেতুটি নির্মানে কচা নদীতে বেকুটিয়া ফেরিঘাটের দীর্ঘদিনের দুর্ভোগের শিকার থেকে মুক্তি পাবে পরিবহন, পরিবহন শ্রমিক ও সাধারণ যাত্রীরা। খুলনা-বরিশাল রুটের বড় সমস্যা বেকুটিয়া ফেরি। এই রুটের যাতায়াতের অর্ধেকেরও বেশি সময় নষ্ট হতো ফেরি পারাপারে।
এ অ লের ২১ জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থাকে তরান্বিত করতে পিরোজপুর জেলা সদরের কুমিরমারা ও কাউখালী উপজেলা প্রান্তের বেকুটিয়া পয়েন্টে নির্মিত চীন সরকারের সহায়তায় অষ্টম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সেতু।
চিনা প্রেসিডেন্ট-এর বাংলাদেশ সফরকালে ২০১৬ সালের ১ নভেম্বর ৮ম চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী সেতু নির্মাণে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এর দু বছর পরে ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর ‘প্রী-স্ট্রেসড কংক্রীট বক্স গার্ডার’ ধরনের এ সেতুটির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাই এ অ লের মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্না আজ বাস্তবে রুপ নিয়েছে।
কঁচা নদীর ওপর প্রায় এক কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই সেতুটি চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘চায়না রেলওয়ে সেভেনটিন ব্যুরো গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড’ ২০১৭ সালের ১অক্টোবর সেতুটির নির্মাণকাজ শুরু করে। সেতু নির্মাণে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৮৯৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৬৫৪ কোটি টাকা গ্র্যান্ড অনুদান দিয়েছে চীন সরকার। বাকি ২৪৪ কোটি টাকার জোগান দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। মূল সেতুটির উভয় প্রান্তে ৪৯৫ মিটার ভায়াডাক্ট সহ সর্বমোট দৈর্ঘ্য প্রায় দেড় কিলোমিটার। ১৩.৪০ মিটার প্রস্থ সেতুটির পিরোজপুর ও বরিশাল প্রান্তে ১ হাজার ৪৬৭ মিটার সংযোগ সড়কসহ পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নির্বিঘ্ন রাখতে আরো ২টি ছোট সেতু ও বক্স কালভার্ট নির্মিত হয়েছে। ‘চায়না রেলওয়ে ১৭ ব্যুরো গ্রুপ কোম্পানী লিমিটেড’ ১০টি পিলার, ৯টি স্প্যান ও ৮টি পিয়ার বিশিষ্ট এ সেতুটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে এবছর জুন মাসের ৩০ তারিখ।
কঁচা নদীর সর্বোচ্চ জোয়ার থেকে ৬০ ফুট উচ্চতায় নির্মিত সেতুটির তলদেশ দিয়ে চট্টগ্রাম, বরিশাল এবং মোংলা বন্দরসহ খুলনা নদী বন্দরের সাথে পণ্য ও জ¦ালানিবাহী বড় ধরনের নৌযানের চলাচলও নির্বিঘ্ন থাকবে। পাশাপাশি নৌ বাহিনীর ফ্রিগেটসহ যেকোন ধরনের যুদ্ধ জাহাজের চলাচলেও কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকছে না। এমনকি কঁচা নদীর মধ্যভাগে সেতুটির সবচেয়ে প্রসস্ত স্প্যানটিতে ১২২ মিটার এলাকা নৌযান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে।
প্রকল্পটি সম্পন্ন হওয়ার মধ্য দিয়ে এ অ লের অর্থনীতিতে নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। পিরোজপুর বেকুটিয়া ফেরিঘাটে বাসিন্দা মনজু শেখ বলেন, এই সেতুটিকে গিরে আমাদের আগ্রহ অনেক বেশি এটি এ অ লের সব থেকে বড় সেতু। সেতুটির দুই পারে রয়েছে সৃষ্টিনন্দন দুটি গেট। এবং নিচে বসার ব্যাবস্থা তাই প্রতিদিন সেতুটি দেখতে মানুষের ঢল নামে।
জেলা ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মাওলা নকীব বলেন, সেতুকে ঘিরে এরই মধ্যেই শুরু হয়েছে এ এলাকার উন্নয়ন প্রক্রিয়া। হোটেল-মোটেল রেঁস্তোরাসহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ হয়েছে। এ সেতুটি চালু হলে পাল্টে যাবে এ জেলার যোগাযোগ ও অর্থনীতির চিত্র।
এই সেতু চালুর মাধ্যমে তৈরি হবে কলকারখানসহ শিল্প প্রতিষ্ঠান। মানুষের জন্য সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থান। জীবন যাত্রার মান উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে এ সেতুটি। ফলে পিরোজপুর পরিণত হবে একটি আধুনিক জেলায়,স্বপ্ন জেলাবাসীর।