#জোট বেঁধে দাম বাড়াচ্ছে বড় প্রতিষ্ঠানগুলো #খাদ্য উৎপাদনকারীদের কারসাজিতে বাজার বেহাল #ফিড মিল ও পোল্ট্রি ফার্ম দুই ব্যবসায়ই জড়িত এরা #ব্যয় কুলাতে না পেরে পথে বসছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা
দফায় দফায় পোল্ট্রি খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি ও সিন্ডিকেটের কারণে ডিম ও ব্রয়লার মুরগির দাম আকাশছোঁয়া। যদিও গত কয়েক দিনের সরকারি অভিযানে দাম কিছুটা কমেছে, তবে তাতে জনজীবনে এর ইতিবাচক প্রভাব খুব কমই পড়েছে। মুরগির খাদ্য উৎপাদনকারীদের কারসাজিতে বাজারের এ অবস্থা বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা জানান, গুটিকয়েক পোল্ট্রি ফিড কোম্পানির কারসাজিতেই হুটহাট দাম বাড়ে-কমে। কারণ এই শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর ফিড মিলের পাশাপাশি আছে পোল্ট্রি ফার্মও। যে কারণে তারা কারসাজি করে মুরগির খাদ্য উপাদানের দাম বাড়িয়ে দেয়। যেন এই অসুস্থ প্রতিযোগিতায় টিকতে না ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছোটবড় পোল্ট্রি শিল্প গড়ে উঠলেও সাভারসহ রাজধানীর আশপাশের এলাকা ও গাজীপুরের টঙ্গী, বোর্ড বাজার, জয়দেবপুরে দেশের সবচেয়ে বড় পোল্ট্রি শিল্প গড়ে উঠেছে। মূলত এখান থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয় ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের বাজার। ব্যবসায়ীরা জানান, মূলত দেশের বড় পোল্ট্রি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো সিন্ডিকেট করে ডিম ও মুরগির দাম বাড়াচ্ছে। এর মধ্যে কাজী ফিড, সিপি নারিশ, প্যারাগন, আফতাব ফিড অন্যতম।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খামারিরা করোনাকাল থেকেই লোকসান দিয়ে আসছেন। এর মধ্যে কিছু সময় মুরগি-ডিমের সামান্য দাম বাড়লেও তা দিয়ে খামার টেকানো সম্ভব হয়নি। ফলে বেশির ভাগ খামার বন্ধ হয়ে গেছে। বিদেশ থেকে পোল্ট্রি ফিড তৈরির উপাদান যেমন সয়াবিন মিল, ভুট্টা, প্রোটিন আমদানি করতে হয়। এসব পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। কিন্তু ডিম-মুরগির দাম বাড়েনি। অথচ সে সময় দাম বাড়ানো যৌক্তিক ছিল। এখন বাজারে কিছু সময়ের জন্য মুরগি সরবরাহ কমেছে ফলে দাম বাড়া স্বাভাবিক।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী দেশের নিবন্ধিত ২৭০টি ফিড মিল তাদের উৎপাদিত খাদ্যের দাম বাড়িয়েছে। প্রতিকেজি খাদ্যে মধ্য মে থেকে আগস্ট পর্যন্ত দাম বেড়েছে ২ থেকে আড়াই টাকা। ফলে ৫০ কেজির বস্তা ১০০ থেকে ১২০ টাকা বেশি দামে কিনতে হচ্ছে খামারিদের। খামারিরা বলছেন, করোনাকালের শুরু থেকে প্রতিবস্তা পোল্ট্রি খাদ্যে ১০০০ থেকে ১২৫০ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। করোনা শুরুর দিকে ১৮০০ টাকার খাদ্যের বস্তা বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৩২৫০ টাকায়।
পোল্ট্রি খামারি প্লাবন কোরায়েশী জানান, ‘একটা পূর্ণবয়স্ক লেয়ার মুরগি দিনে ১৮০ থেকে ২২০ গ্রাম খাবার খায়। ৬টি মুরগি খায় ১ কেজি খাদ্য। আগে ১ কেজি খাবার ৫০ টাকায় পাওয়া যেত অর্থাৎ ৫০ কেজির বস্তা ২৫০০ টাকায় হয়ে যেত। একই খাদ্য এখন কিনতে হচ্ছে প্রতি কেজি ৬৫ থেকে ৭০ টাকা দরে।
তিনি বলেন, আগে প্রতিপিস ডিম উৎপাদনে খরচ হতো ৭ টাকা। আর বিক্রি হতো ৭ টাকা ৯০ পয়সা কিংবা ৮ টাকায়। এখন একই ডিম উৎপাদনে খরচ পড়ছে সাড়ে ৮ টাকার ওপরে। আর বিক্রি হচ্ছে ১০ টাকায়। ১ হাজার মুরগি থেকে ১ হাজার ডিম পাওয়া যায় না। ডিম পাওয়া যায় সর্বোচ্চ ৯০০ পিস। ৯০ শতাংশ ডিম পেলে ১ টাকা করে লাভ হয়। এখন যারা বলছেন ডিমের দাম কেন বেড়েছে তাদের কাছে প্রশ্ন- শুধু খাবার খাইয়েই মুরগি পালন সম্ভব? নাকি শ্রমিক, ঔষুধ, ভ্যাকসিন, পরিবহন আছে?
তিনি আরো বলেন, সকল ব্যবসা এখন নিয়ন্ত্রণ করছে গ্রুপ কোম্পানিগুলো। সরকার থেকে বারবার আমরা ঋণ চেয়েও পাচ্ছি না, অথচ তারা হাজার কোটি টাকা পাচ্ছে।
আরেক খামারি আলমগীর হোসেন বলেন, ডিম দেওয়া ১ হাজার লেয়ার মুরগি পালন করতে বা খামার করতে ৮ লাখ টাকা খরচ করতে হয়। এখন আমরা দিনে ১ হাজার টাকা লাভ করছি দাম বাড়ার পর। এতগুলো টাকা বিনিয়োগ করে যদি এটুকু লাভ না আসে তাহলে আমাদের সংসার চলবে কিভাবে? সবকিছুর দাম বাড়তি কিন্তু কিছুদিন আগেও আমরা সাড়ে ৭ টাকা দামে ডিম বিক্রি করেছি। মহাজনের কাছে ৮-১০ লাখ টাকা বাকি!
তিনি আরো বলেন, গুটিকয়েক পোল্ট্রি ফিড কোম্পানির কারসাজিতেই হুটহাট দাম বাড়ে-কমে। কারণ এই শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর ফিড মিলের পাশাপাশি আছে পোল্ট্রি ফার্মও। যে কারণে তারা কারসাজি করে মুরগির খাদ্য উপাদানের দাম বাড়িয়ে দেয়। যেন এই অসুস্থ প্রতিযোগিতায় টিকতে না ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা।
এসব বিষয় নিয়ে কথা হয় দেশের বৃহৎ পোল্ট্রি ফিড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কাজী ফিডের বিপণন বিভাগের প্রধান সালাউদ্দিন হাওলাদারের সঙ্গে। ভোরের পাতাকে তিনি বলেন, বর্তমানে ব্রয়লার স্টার্টার ফিড ৩ হাজার ১৬০ টাকা, ব্রয়লার গ্রোয়ার ৩ হাজার ১৯৫ টাকা, ব্রয়লার পুলেট ৩ হাজার ১৫৫ এবং ব্রয়লার ফিনিশার ৩ হাজার ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যার প্রতিটি আইটেম আগে অন্তত ৭০০ টাকা কম ছিল। সবকিছুর দাম বাড়ায় বেড়েছে ডিম-মুরগির দাম। এতে ফিড মিলাররা কিছু করতে পারবে না। কারণ সবগুলো উপাদানই দেশের বাইরে থেকে আমদানি করতে হয়।
তবে কিছু অভিযোগের বিষয়ে তিনি একমত পোষণ করে বলেন, কিছু অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়া যায় না। পোল্ট্রি সেক্টরে মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য রয়েছে। প্রান্তিক খামারিরা আসলে কতটা নিরাপদে ব্যবসা করতে পারছেন সে বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হয়।’
অপরদিকে নারিশ ফিডের প্রধান বিপনন কর্মকর্তা সামিউল আলিম ভোরের পাতাকে বলেন, পোল্ট্রি ফিড তৈরিতে যেসব কাঁচামাল ব্যবহার করা হয় তার দাম বাড়ছে। আর এ কারণেই পোল্ট্রি ফিডের দাম বাড়ছে। বাজারে সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানোর অভিযোগের বিষয় জানতে চাইলে তিনি তা এড়িয়ে যান। তিনি বলেন, ‘আমি বর্তমানে ঢাকার বাইরে আছি, আপনি পরে যোগাযোগ করেন।’
এদিকে ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকার যেন জনগণের দিকে তাকিয়ে বাচ্চা, খাবার ও ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করে। তা না হলে সারা দেশের মুরগি খামারিরা একযোগে উৎপাদন বন্ধ করে দেবে। বিশ্ববাজারে কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে ডিলার ও কোম্পানিগুলো এই শিল্প নিয়ে নোংরা খেলা শুরু করেছে। অনেকে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারছেন না। কারণ, কমবেশি আমরা সবাই ঋণের মধ্যে ডুবে আছি। তাই বাধ্য হয়েই আবার উৎপাদন চালিয়ে যেতে হয়। বিদেশে কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির কথা বলে কোম্পানিগুলো ১৬০০ টাকা ফিডের বস্তা এখন ৩২০০ টাকায় বিক্রি করছে। ৩০০ টাকার ভ্যাকসিনের দাম হয়েছে ৫৫০ টাকা। ফলে ব্যবসায়ীরা মাঠে মারা যাচ্ছেন।
প্রান্তিক পর্যায় ও বড় খামারিরা ডিম উৎপাদন করেও দাম পাচ্ছেন না। মুরগি পালনে ব্যয় বেড়েছে বহুগুণ। গত কয়েক দিনে ডিম ও মাংসের দাম কমলেও বাড়ছে বাচ্চা ও ওষুধের দাম। ডিমপাড়া মুরগির এক দিনের বাচ্চার দাম বাড়িয়েছেন হ্যাচারি মালিকরা। তারা সিন্ডিকেট করে বাচ্চার দাম বাড়িয়েছেন। বাচ্চা উৎপাদনকারী হ্যাচারি মালিকদের সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। আর তা না পারলে খামারির এই লোকসান ঠেকানো সম্ভব নয়। বাচ্চার দাম নাগালে থাকলে উৎপাদন খরচ কমে যায় এবং লাভবান হওয়া যায়। বাচ্চার দাম ৩০ টাকা থেকে ৫০ টাকার বেশি হলে লাভ সম্ভব নয়।