রাজধানীর অদূরে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরনের কেরামতিতে বেহাল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
লাগামহীন দুর্নীতি ও অনিয়ম করে সাধারণ কাউন্সিলর হয়ে রাতারাতি হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক বনে যাওয়া, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা, লুটপাট, দ্বৈতনাগরিকত্ব, কমিশন বানিজ্য সহ নানা অভিযোগ বিক্ষুব্ধ নগরবাসী গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরনের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় থেকে শুরু করে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে লিখিতভাবে অভিযোগ জানিয়েছে। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরনের নানা অপকর্ম নিয়ে ভোরের পাতার ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে প্রথম পর্ব।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরনের পিতা মরহুমর নূর মোহাম্মদ খান ছিলেন একটি স্কুলের দপ্তরী। এমনকি আসাদুর রহমান কিরন ছিলেন একটি কারাখানার শ্রমিক। স্বৈরশাসক এরশাদের জাতীয় পার্টিতে যোগদানের মাধ্যমে আসাদুর রহমান খান কিরনের রাজনীতির হাতে খড়ি। এরপর গাজীপুরের সাবেক সংসদ সদস্য বিএনপির হাসান উদ্দিন সরকার এবং শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলা ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত আসামী নুরুল ইসলাম সরকারের ছত্রছায়ায় টংগীতে রাজনৈতিক জীবন শুরু কিরনের।
২০০০ সালে বর্তমান মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খান ২য় মেয়াদে টংগী পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলে কিরন রাতারাতি আজমত উল্লাহ খানের ঘনিষ্টজন হয়ে যান। এরপর পর্যায়ক্রমে তিনি টংগী পৌরসভার কমিশনার এবং পরবর্তীতে ২০১৩ সালে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। কমিশনার নির্বাচিত হয়েই কিরন দুর্নীতিতে জড়িয়ে পরেন। ২০১৩ সালে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের প্রথম নির্বাচিত মেয়র অধ্যাপক মান্নান ২০১৩ সালে সাময়িক বরখাস্ত হলে আসাদুর রহমান কিরন বিপুল পরিমান অর্থের বিনিময়ে প্যানেল মেয়র এবং ভারপ্রাপ্ত মেয়র নির্বাচিত হন।
এদিকে, ভারপ্রাপ্ত মেয়র নির্বাচিত হয়ে ২০১৫-২০১৮ মাত্র ২৭ মাসেই আসাদুর রহমান কিরন সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেন। গাজীপুরের টংগীতে ৩টি এবং ভালুকায় ২০০ বিঘা জমিতে ১টি শিল্প কারখানা গড়ে তোলেন এবং টংগীর, উত্তরা তে অসংখ্য জমি, ফ্লাটে বিনিয়োগ করেন। তার দায়িত্বকালীন সময়ে সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন শিল্প কারখানার হোল্ডিং ট্যাক্স জালিয়াতি করে কমিয়ে এবং ঠিকাদারদের থেকে কমিশন বানিজ্য করে বিভিন্ন সেটেলমেন্ট করে কয়েকশত কোটি টাকা যুক্তরাষ্ট্রে পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কিরন এবং তার স্ত্রীর নামে যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক শহরে ৩ টি বিলাশবহল বাড়ী রয়েছে। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত নাগরিক। ২০২১ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটুক্তির দায়ে সিটি মেয়র জাহাঙ্গীর আলম বরখাস্ত হলে কিরন আবারও বিপুল পরিমান অর্থের বিনিময়ে ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব গ্রহন করেন বলেও জানিয়েছেন তারই ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র।
আরো জানা গেছে, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনে কমপক্ষে ৫-৭ জন সিনিয়র এবং দক্ষ ও জনপ্রিয় দলীয় কাউন্সিলর থাকা সত্বেও ২৫ কোটি টাকা অবৈধ অর্থের বিনিময়ে কিরন ভারপ্রাপ্ত মেয়র পদ হাতিয়ে নেয়। ভারপ্রাপ্ত মেয়র পদ হাতিয়ে নেওয়ার ১ সপ্তাহের মধ্যেই কিরন তার অনুসারী স্থানীয় ৩/৪ জন কাউন্সিলরের এর মাধ্যমে সিটি কর্পোরেনের বিভিন্ন জোনের শতাধিক কর্মকর্তা কর্মচারীদের চাকুরিচুত্য করে এবং পরবর্তিতে বিপুল পরিমান অর্থ হিসেবে গ্রহণ করে তাদের অনেক জনকে পুনরায় নিযোগদান করেন।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ সরকারি বিভন্ন দপ্তরে জমা দেয়া ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান খান কিরনের দুর্নীতির কিছু খতিয়ান ভোরের পাতার পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো। উত্তরায় ১১ নাম্বার সেক্টরে ৭ নাম্বার রোডে ১০ নং বাড়ি (৭ তলা আলিশান ভবন বর্তমান মুল্য ১৫ কোটি টাকা) উত্তরায় ০৭ নাম্বার সেক্টরে ১৮ নাম্বার রোডে ৯৫ নং ১২ তলা ভবন (নির্মানাধীন) আনুমানিক মুল্য ৩৫ কোটি টাকা)।
রূপায়ন সিটি উত্তরায় ম্যাজিস্ট্রিক ফেইস ৮ নাম্বার বিল্ডিং এ ২ টি লাক্সারিয়াস কন্ডোনিয়াম ফ্ল্যাটট যার মুল্য ৮.৩০ কোটি টাকা করে ২ টি ১৬.৬০ কোটি টাকা। ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা উপজেলায় নিজের এবং কিরনের স্ত্রীর নামে ২০০ বিঘা জমির উপর ফ্যাক্টরী যার আনুমানিক মুল্য ৩০০ কোটি টাকা। রাজধানীর গুলশান -০২, ৭৯ নাম্বার রোডে ২৫০০ স্কয়ারফিটের আলিশান ফ্ল্যাট যার আনুমানিক মুল্য -১৪ কোটি টাকা।
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন আওতাধীন টংগী জোনে তার ৩ টি ফ্যাক্টরী যার আনুমানিক মুল্য ৩০০ কোটি টাকা। টংগীর পাগারে, আশুলিয়া এবং গাজীপুরে নিজ নামে, স্ত্রীর নামে শ্যালক এবং শ্যালিকার নামে ১১২ বিঘা জমি। (টংগীর পাগারে জমি গুলো খৃস্টানদের নিকট থেকে ভয়ভীতি দেখিয়ে ক্রয়কৃত) ১ম মেয়াদে ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবে দুর্নীতি করে পাচার করা টাকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে ৩ টি বাড়ি যার মুল্য ৪০০ কোটি টাকা। নিজ নামে, স্ত্রীর নামে শ্যালক এবং শ্যালিকার নামে এবং নিজের ছেলে মেয়ের নামে মার্কিন যুক্তরাস্ট্রে এবং বাংলাদেশে বিপুল পরিমান নগদ অর্থ। নিজ নামে, স্ত্রীর নামে শ্যালক এবং শ্যালিকার নামে বিভিন্ন ব্যাংকের লকারে রক্ষিত ৫০০-৬০০ ভরি স্বর্ণ ও ডায়মন্ড।
সিটি কর্পোরশনের শিল্প ট্যাক্স আদায়ে অনিয়ম (বকেয়া ট্যাক্স ৩ কোটি হলে চুক্তি অনুযায়ী শিল্প মালিক দেয় ১.৫ কোটি, ৫০ লক্ষ সিটি কর্পোরেশনের ফান্ডে জমা দিয়ে ১ কোটি কিরন নিজে আত্মসাত করে)। বিগত ৬ মাসে ৮ টি জোনে এরকম ঘটনা শতাধিক বার ঘটেছে।
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন গুরূত্বপুর্ন কাজের বিল /ফাইল এবং নথি কিরন তার নিজ বাসভবন উত্তরায় ১১ নাম্বার সেক্টরে ৭ নাম্বার রোডে ১০ নং বাড়িতে যার অবস্থান গাজীপুরের বাইরে সেই উত্তরায় নিয়ে দীর্ঘ সময় আটকে রেখে ঠিকাদারদের কাছ থেকে ২০ শতাংশ কমিশন আদায় করে তারপর বিল প্রদান করেন। উত্তরায় তার নিজ বাসভবনের ৬তলায় তিনি সিটি কর্পোরেশনের একটি শাখা অফিস স্থাপন করেছেন যেখানে বসে তিনি দুর্নীতির সকল পরিকল্পনা করে থাকেন। ২য় মেয়াদে ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসাবে দায়িত্ব নিয়েই কিরন চাকুরি স্থায়ীকরণ করা হবে বলে কয়েকশত কর্মচারীর নিকট হতে প্রায় ১০ কোটি টাকা অগ্রিম গ্রহন করেছেন। আসাদুর রহমান কিরন ২০১৬-২০১৭ সালে দায়িত্ব থাকাকালীন একটি টেন্ডার আহবান করেছিলেন টেন্ডার নং : এঈঈ/ত০১/০৬/১৬-১৭ উক্ত টেন্ডারের কোন কাজ সম্পুর্ন না হওয়ায় পরবর্তীতে নির্বাচিত মেয়র জাহাঙ্গীর আলম কোন বিল প্রদান করেন নাই। ২০২১ সালে জাহাঙ্গীর আলম বহিস্কার হওয়ার পর কিরন পুনরায় ভারপ্রাপ্ত মেয়র নির্বাচিত হয়েই ২০১৬-২০১৭ সালের উক্ত কাজের ঠিকাদারগনের কাছ খেকে বিপুল পরিমান টাকা কমিশন গ্রহন করে বিভিন্ন প্রকল্পর কয়েকশত কোটি টাকা বিল প্রদান করেন।
সম্প্রতি কিরন সম্পূর্ন বে-আইনী ভাবে এবং নিজের ক্ষমতার জোড়ে তার নিজের সহ টংগীর পাগার এলাকার বেশ কয়েকটি শিল্প কারখানার ট্যাক্স কমিয়েছেন।
এসব অভিযোগের বিষয়ে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরনের মুঠোফোনে কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তাকে অভিযোগের বিষয়গুলো জানিয়ে এই প্রতিবেদকের পক্ষ থেকে একটি ক্ষুদেবার্তা পাঠানো হয়েছে।
চলবে......