২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় এই ইস্যুতে মুখ খুলতে নারাজ বিএনপি নেতৃবৃন্দ। নারকীয় এই ঘটনাটিকে রাজনৈতিক ভুল হিসেবে মেনে নিলেও সেটি প্রকাশ্যে স্বীকার করতে রয়েছে দলীয় হাইকমান্ডের বাধা।
জানা গেছে, শুধুমাত্র পদ-পদবি রক্ষায় তারেক রহমানের নির্দেশে তারা এই ইস্যুতে কথা বলতে চান না। তবে দলের এমন ন্যক্কারজনক ঘটনার কারণে তৃণমূল পর্যায়ে দলীয় কর্মীদের রাজনীতি করাটাও দুরূহ হয়ে পড়েছে।
জানা গেছে, ২১ আগস্ট নিয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের মুখ বন্ধ রাখতে সরাসরি নির্দেশ দিয়েছেন লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এ ঘটনায় উল্টো আওয়ামী লীগকে দায়ী করে সমালোচনা করতেও নির্দেশ দিয়েছেন বিএনপি প্রধান। নির্দেশনা থাকলেও সত্যকে মিথ্যা বলে প্রচার করতে ইতস্তত বোধ করছেন দলটির কর্মীরা।
তবে পদ-পদবি রক্ষা করতে এই ইস্যুতে বিএনপি-জামায়াতের পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়ে সমালোচনা সত্ত্বেও মুখে কুলুপ এঁটেছেন নেতাকর্মীরা। বিরোধী দল দমনে দলের এমন নৃশংস হামলার ঘটনাকে দলের ইমেজ নষ্ট হয়েছে এবং বিএনপি জঙ্গিবাদকে সমর্থন দেয়ার আঞ্চলিকসহ আন্তর্জাতিক সমর্থন হারিয়েছে বলেও মনে করে দলটির একটি অংশ। তবে রাজনৈতিক কারণে এসব বিষয়ে তারা মুখ খুলতে পারেন না বলেও জানা গেছে।
বিএনপি ছেড়ে বিকল্প ধারায় যোগদানকারী এক নেতা ভোরের পাতাকে বলেন, ২১ আগস্টের ঘটনার জন্য সরাসরি বিএনপি দায়ী। আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে, তারেক রহমানের সাজানো পরিকল্পনায় নৈতিকভাবে সায় দিয়ে ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে গেছেন বেগম জিয়াও। জিয়া পরিবারকে স্থায়ীভাবে ক্ষমতায় রাখতে তারেক রহমান পাকিস্তানী চরদের সহায়তা জঙ্গিদের ভাড়া করে এই নারকীয় ঘটনার অবতারণা করেন। অবশ্য এই পরিকল্পনার বিষয়ে আগেই আঁচ করতে পেরে তারেক রহমানকে থামাতে বেগম জিয়াকে অনুরোধ করেছিলেন একাধিক বিএনপি নেতা। কিন্তু তারা সফল হননি। উল্টো বিভিন্ন সময়ে এসব নেতাদের দল ছাড়তে হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, ২১ আগস্টে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব জড়িত সেটি দলটির নেতাদের কাছেও দিনের মতো পরিষ্কার। কিন্তু দল ও দলীয় শীর্ষ কথিত সম্মান রাখতে তারা মুখে কুলুপ এঁটেছেন। বেগম জিয়া ও তারেক রহমানের অপকর্মের কারণে বিএনপি আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে সেটি জেনেও নিরুপায় হয়ে দল করতে হচ্ছে বিএনপি কর্মীদের। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদে বিএনপির সম্পৃক্ততার ঘটনায় সারাজীবন বিএনপি কর্মীদের ভোগাবে বলেও মনে করেন তিনি।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ব্লু-প্রিন্ট এঁকেছিলেন খোদ তারেক রহমান। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে একাধিক সিনিয়র নেতা বেগম জিয়াকে বাধা দিতে অনুরোধ করলেও তিনি কথা কানে তোলেননি। বেগম জিয়া চাইলেই তারেক রহমান এমন ভয়াবহ ঘটনা ঘটাতে পারতেন না।
জানা গেছে, এই ঘটনা বিএনপির ইমেজ নষ্ট করবে এবং আগামী দিনের রাজনীতিতে এমন ইস্যুতে দলে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে-তা জেনেও বেগম জিয়া নীরবতা পালন করেছেন। বিরোধী দলকে নেতৃত্বশূন্য করে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার চিন্তায় বেগম জিয়া সম্ভবত ভয়ংকর এই পরিকল্পনার কথা জেনেও চোখ-কান বন্ধ রেখে এর সুবিধা নিতে চেয়েছিলেন।
বিভিন্ন গোপন সূত্র বলছে, ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলার জন্য শুধু তারেক নন বেগম জিয়াও পরোক্ষভাবে দায়ী। এই বিষয়টি বিএনপির সকল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের কাছে ওপেন সিক্রেটের মতো। বিরোধী দলকে নিঃশেষ করে দীর্ঘমেয়াদে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলে রাখতে বেগম জিয়াও বিভিন্ন পথ খুঁজছিলেন। এরই মধ্যে বিরোধী দলীয় নেত্রীকে শেষ করতে তারেক রহমানের গোপন পরিকল্পনার কথা জানতে পারায় মনে মনে খুশিই হন বেগম জিয়া। তিনি ভেবেছিলেন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে তো খেল খতম, দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকতে কোন বাধা থাকবে না। আর পরিকল্পনা ভেস্তে গেলে ভুল-ভাল বুঝিয়ে ইস্যু তৈরি করে বিষয়টিকে ধামাচাপা দেয়া যাবে। আর বেগম জিয়ার এমন মনোভাব বুঝতে পেরেই তারেক রহমান আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। বিরোধী নেত্রীকে রাজনীতির পথ থেকে সরিয়ে দিতেই তারেক এই ঘটনা ঘটান। আর বেগম জিয়া সেটি সুফল ভোগ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরিকল্পনা বিফলে যাওয়ায় জজ মিয়া নাটকের অবতারণা করে বিএনপি সরকার।
বেগম জিয়া ও তারেক রহমানের এমন অগণিত অপরাধ ও দুর্নীতির কারণে বিএনপির এই দুর্দশা। তবে ২১শে আগস্টের মতো নারকীয় ঘটনার জন্য বিএনপিকে সারাজীবন অপবাদ সইতে হবে। এসব অপকর্মের দায় বিএনপিকে সারাজীবন ভোগাবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
স্বাধীনতার প্রাক্কালে ১৪ ডিসেম্বর যেভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছিল, ঠিক একই উদ্দেশ্যে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী জনসভায় চালানো হয়েছিল ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা। দেশে বিরোধী মতকে দমন ও নিশ্চিহ্ন করার অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার উপর এই হামলা করা হয়। এই হামলায় নিহত হন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এর মহিলাবিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ ২৪ জন, এবং আহত হন শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের কয়েকশ নেতা-কর্মী।
বর্বরোচিত এই হামলার হোতা হিসেবে কাজ করেছিল তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, লুৎফুজ্জামান বাবর, কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুজাহিদ। ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলায় মাঠ পর্যায়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অন্যতম ভূমিকা পালন করে বিএনপি নেতা আবদুস সালাম পিন্টু ও তার ভাই মাওলানা তাজউদ্দীন।
প্রাথমিকভাবে তাজউদ্দীন হরকাতুল জিহাদকে পরিকল্পনায় সম্পৃক্ত করে। হামলা বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয় হুজির রাজশাহী জেলার প্রধান মুফতি হান্নানকে। এ হামলা বাস্তবায়ন হলে হুজিকে রাজনীতিতে আসার সুযোগ দেয়া হবে এই মর্মে হুজির আমির আবদুস সালামকে প্রতিশ্রুতিও দেয়া হয়েছিল। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, বিশ্বে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে পরিচিত এই হুজি তৎকালে নির্বাচন কমিশনে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছিল।
বিভিন্ন সূত্রের প্রাপ্ত তথ্যে ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি ও জুন মাসে তারেক রহমান সিঙ্গাপুরে বসে হামলার পরিকল্পনা করেন বলে জানা গেলেও ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে তারেক বিজি-০০৭ বিমানে কোথায় গিয়েছিল তার সকল তথ্য মুছে ফেলা হয়। ধারণা করা হয় সে সময় তারেক থাইল্যান্ড হয়ে পাকিস্তান সফর করেছিল। তারেক ফিরে আসে ২৩ বা ২৪ আগস্ট। ২১ আগস্ট হামলার পরিপ্রেক্ষিতে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে তারেক মালয়েশিয়ায় পাড়ি দিত। এসব নানা প্রমাণাদিই তারেককে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার হোতা হিসেবে প্রমাণ করে।
এব্যাপারে রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিভুরঞ্জন সরকার বলেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর সঙ্গে জড়িত বিএনপি লালিত বিচ্ছিন্নতাবাদ, জঙ্গীবাদ ও উগ্রপন্থার শেকড়। সুষ্ঠু রাজনীতির স্বার্থে তারেক রহমানসহ হামলায় জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। কেননা একাত্তরের পরাজিত শক্তি ও দোসররা বারবার আগস্ট মাসকে তাদের দানবীয় হত্যাযজ্ঞের মাস হিসেবে বেছে নিয়েছে। ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা, ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতাকে জেলের মধ্যে হত্যা, ৭ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধা হত্যা, ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী সিরিজ বোমা বিস্ফোরণ এবং ২১ আগস্ট শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা একসূত্রে গাঁথা।