#স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি এখনো জীবিত আছে: ড. শ্রী বীরেন শিকদার। #১৫ই আগস্টের প্রেক্ষাপট ১৯৭১ সালেই শুরু হয়েছিল: মে. জে. (অব.) এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদার। #সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র ছিল ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড: মায়েদুল ইসলাম তালুকদার বাবুল। #১৫ আগস্ট কুশীলবদের খুঁজে বের করতে হবে: শেখ মোহাম্মদ ফাউজুল মুবিন।
স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিরা কিন্তু এখনো জীবিত আছে। তারা কিন্তু এখনো নিঃশেষ হয়ে যায়নি। ষড়যন্ত্র সেই স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকেই শুরু হয়েছিল। সেই ষড়যন্ত্রে বিদেশী মদদও ছিল। কারণ যুদ্ধের পর সেসময় তারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে চায়নি। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে দেশে ফিরে এসে যদি এই বিশ্বাসঘাতকদের কঠোর হস্তে দমন করতো তাহলে কিন্তু এই ঘটনা ঘটতে পারতো না।
দৈনিক ভোরের পাতার নিয়মিত আয়োজন ভোরের পাতা সংলাপের ৭৯৮তম পর্বে এসব কথা বলেন আলোচকরা। ভোরের পাতা সম্পাদক ও প্রকাশক ড. কাজী এরতেজা হাসানের নির্দেশনা ও পরিকল্পনায় অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, ড. শ্রী বীরেন শিকদার, গবেষক ও লেখক মে. জে. (অব.) এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদার, জার্মান আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা, বাংলাদেশ কালচারাল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মায়েদুল ইসলাম তালুকদার বাবুল, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শেখ মোহাম্মদ ফাউজুল মুবিন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ভোরের পাতার বিশেষ প্রতিনিধি উৎপল দাস।
ড. শ্রী বীরেন শিকদার বলেন, আজকে ভোরের পাতা লাইভ সংলাপে আমাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য ভোরের পাতা কর্তৃপক্ষসহ সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আজকের এই দিনে আমি আমার বক্তব্যের শুরুতে গভীর শ্রদ্ধা জানাই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, যে মহামানবের অবদানে আজ আমরা লাল সবুজের পতাকা নিয়ে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছি। গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি ১৫ আগস্টের সেই কালরাতে তাঁর পরিবারের যেসব সদস্যরা শাহাদাতবরণ করেছিলেন। গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি জাতীয় চার নেতাকে, গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি ৩০ লাখ শহীদ ও ২ লাখ ইজ্জতহারা মা-বোনদের। আজকে ভোরের পাতা যে আলোচ্য বিষয় নির্ধারণ করেছে সেটা আসলেই অনেক সময়োপযোগী। স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিরা কিন্তু এখনো জীবিত আছে। তারা কিন্তু এখনো নিঃশেষ হয়ে যায়নি। ষড়যন্ত্র সেই স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকেই শুরু হয়েছিল। সেই ষড়যন্ত্রে বিদেশী মদদও ছিল। কারণ যুদ্ধের পর সেসময় তারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে চায়নি। এইরকম অনেক গুলো দেশ ছিল যারা বঙ্গবন্ধুর শাহাদাৎ বরণের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। তাহলে এর অর্থ দাড়ায় যে, বঙ্গবন্ধু যতক্ষণ পর্যন্ত আছে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিবেনা। তাদের সেই উদ্দেশ্য হাসিল হয়েছিল এবং তারা বঙ্গবন্ধুকে সরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল এবং বাংলাদেশকে আরেকটা পাকিস্তানে পরিণীত হবে সেটা নিয়ে তাদের আর কোন সন্দেহ ছিলোনা এবং সেই পক্রিয়ায় কিন্তু তারা দেশ চালিয়েছিলেন। ’৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুন্ঠিত করার জন্য নানা ষড়যন্ত্র শুরু হয়। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে পাকিস্তানি ভাবধারায় মৌলবাদের রাজনীতির পুনরুত্থান ঘটে। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে খুনিদের দেশ থেকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করার পাশাপাশি ১২ জনকে রাষ্ট্রীয় কূটনৈতিক দায়িত্বও প্রদান করেছে। ফলে সরকারি টাকায় বিদেশে বসে রাজকীয় জীবনযাপন করেছে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা।
মে. জে. (অব.) এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদার বলেন, আজকের সংলাপের আলোচ্য বিষয় ষড়যন্ত্রময় আগস্ট। আসলে আগস্ট মাসেরতো কোন দোষ নেই, কিন্তু এই আগস্ট মাসের যে প্রেক্ষাপট সেই ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট জাতির পিতা এবং জাতির পিতার পরিবারের সকল সদস্যকে হত্যা করতে সক্ষম হয়। যারা এই হত্যাকাণ্ডটি সংগঠিত করেছেন তারা ছিলেন পাকিস্তানের পরাজিত গোষ্ঠী, যারা বাংলাদেশকে মেনে নিতে পারেননি, যারা একাত্তরে পাকিস্তানীদের হয়ে কাজ করেছিলেন, যারা ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত সেই সময় পাকিস্তানি দখল বাহিনীদের সহযোগী হয়ে ভূমিকা পালন করেছিলেন তারাই মিলে এই ষড়যন্ত্রটি করে। যেহেতু তারা বঙ্গবন্ধুকে এই আগস্ট মাসে হত্যা করেছে সেহেতু তারা হয়তো মনে করতে পারে তাদের জন্য এই আগস্ট মাসটি একটি ভালো মাস। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা কিন্তু হটাত করেই হয়নি, এই হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট দীর্ঘদিন ধরেই করা হয়েছিল। এটা শুরু হয়েছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় থেকেই। এই ১৫ই আগস্টে ষড়যন্ত্রের মূল মীর জাফর হচ্ছেন খন্দকার মোস্তাক। তিনি ১৯৭১ সালের প্রবাসী সরকারের তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। তারা সেসময় পাকিস্তানের সাথে কনফেডারেশন করার একটি পায়তারা করেছিল কিন্তু সেটি আগে থকে ফাঁস হয়ে যাওয়ায় খন্দকার মোস্তাককে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। সেসময় যে তারা এই ষড়যন্ত্রটি করতে পারেনি সেজন্য তারা ধারাবাহিকভাবে সে সময় থেকে ষড়যন্ত্র শুরু করে এবং সেই পক্রিয়ায় তারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় ১৫ই আগস্ট ঘটানোর জন্য ক্ষেত্র তৈরি করেছিল। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে দেশে ফিরে এসে যদি এই বিশ্বাসঘাতকদের কঠোর হস্তে দমন করতো তাহলে কিন্তু এই ঘটনা ঘটতে পারতো না।
মায়েদুল ইসলাম তালুকদার বাবুল বলেন, আগস্ট মাস বাঙালি জাতির ইতিহাসের এক অন্ধকারাচ্ছন্ন অধ্যায়, এক শোকাবহ মাস। হাজার বছরের দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙে ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র সাড়ে তিন বছর পর- ১৯৭৫ সালের এই মাসেই সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় মুক্তির প্রবাদ পুরুষ, বাঙালি জাতির জনক ও বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে ঘাতকরা বাংলাদেশের বিকাশকে থমকে দিতে চেয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের জন্য পুঁজিবাদের রোষানল, ধর্মীয় উগ্রতা, সামাজিক নৈরাজ্য-অসমতা-বৈষম্য থেকে মুক্ত করে বাংলাদেশকে একটি প্রগতিশীল, মানবিক ও উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধু যেসব উদ্যোগ নিয়েছিলেন; বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সেসব উদ্যোগকে বাতিল ঘোষণা করে ঘাতকরা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে শুধু একজন ব্যক্তিকেই হত্যা করা হয়নি, পুরো বাঙালি জাতির ভবিষ্যতকে হত্যা করে ঘাতকচক্র। এমনকি কেউ যেনো কখনো বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রদর্শন বাস্তবায়ন করে বাঙালি জাতিকে মুক্তির পথে দেখাতে না পারে, বাঙালি জাতি যেনো স্বাধীনতার প্রকৃত সুফল ভোগ করতে না পারে, এজন্য তারা হত্যা করেছে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য ১১ বছরের শিশু রাসেলসহ পরিবারের সব সদস্যকে। এমনকি পরবর্তীতে জাতীয় চার নেতা থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদেরও হত্যা করে এই চক্র। শুধু বিদেশ থাকায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা।১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। একই বছর তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। দেশে ফেরার পরই শেখ হাসিনার চলাচলের ওপর অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকার। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে ১৯বার হত্যার চেষ্টা চালানো হয়।
শেখ মোহাম্মদ ফাউজুল মুবিন বলেন, আগস্ট আমাদের সব হারানোর মাস। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে আমাদের সবকিছু কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। যখনই আগস্ট আমাদের সামনে আসে- তখন নেমে আসে অন্ধকার। সামনে আসে এক রক্তাক্ত বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস, আগস্ট আসলেই আমরা ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাই। আগস্ট মাসে আমরা আমাদের জাতির পিতাকে হারিয়েছি। এই আগস্ট মাস নিয়ে আমরা যখন বেতিত তখন কিন্তু আমরা দেখি যে বিএনপি নেতারা তাদের নেত্রীর জন্মদিন পালন করছে। এটাকে কিভাবে মেনে নেব আমরা? পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হয়েছে কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কিন্তু এটা ঘটেনি। বঙ্গবন্ধুকে কিন্তু তারা হত্যা করে ক্ষান্ত হয়নি, তারা মূলত বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে হত্যা করতে চেয়েছিল। ১৯৪৮ থেকে শুরু করে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত এই ভূখণ্ডের সব আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি ছিলেন সংগঠক হিসেবে এবং নেতৃত্বে। বন্ধুর পথে চড়াইউৎরাই অতিক্রম করেই তিনি পেয়েছিলেন বাঙালি জাতির অকৃত্রিম ভালোবাসা। বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা, মহাকালের মহানায়ক। এ দেশের মানচিত্রের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার জীবন। এ জাতির ভাগ্য এবং দুর্ভাগ্যের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে তার জীবন। শত চেষ্টা করেও ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যায়নি তার অর্জন।