রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের বলেছিলেন, "আপনারা কেউ লাশের সঙ্গে টুঙ্গিপাড়া যেতে চাইলে যেতে পারেন।" কিন্তু মোশতাক দেখলেন কেউই লাশের সঙ্গে যেতে আগ্রহী নন। আরে কেউ মোশতাকের পতনের চার বছর পরও বঙ্গবন্ধুর কবর জিয়ারত করতে টুঙ্গিপাড়ায় যাননি।
এ যে ছিল নির্মম-নিষ্ঠুর এক বাস্তবতা। এতে করে মোশতাকের মনে আরও আশার সঞ্চার হয়েছিল। পতন না হলে যে, খুনী মোশতাকের আওয়ামী লীগই করতেন তার মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা-এতে কোনপ্রকার সন্দেহ নেই।
মাত্র ৮৩ দিনের মাথায় মোশতাক রাজত্বের অবসান ঘটবে সেটা বোধকরি তারা কেউই আঁচ করতে পারেননি, বরং মন্ত্রীত্ব নিয়েই তারা ব্যস্ত ছিলেন। মন্ত্রীদের লোভ তাদের এতোটাই পেয়ে বসেছিল যে, দফতর বন্টনের সময় কেউ কেউ খুনী ফারুক-রশিদেরও দ্বারস্থ হয়েছিলেন। মোশতাক আশ্বস্ত হয়েছিলেন মন্ত্রীদের প্রতি। আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত করেই তাকে অগ্রসর হতে হবে এ বুদ্ধিটাও মন্ত্রীরা দেন। মোশতাক ১৯৭৫ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী থেকে একদলীয় (বাকশাল) পদ্ধতি রহিত করেন। রাষ্ট্রপতির প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা এম এ জি ওসমানীই প্রথম বাকশাল ব্যবস্থা রহিত করার পরামর্শটি দেন। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়া নৌ ও জাহাজ চলাচল মন্ত্রী জেনারেল ওসমানী ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি একদলীয় (বাকশাল) ব্যবস্থার বিরোধিতা করে সংসদ সদস্য পদ হারান। কিন্তু যারা বঙ্গবন্ধুর বাকশালকে উত্তম পন্থা বলে মুখে ফেনা তুলেছিলেন, দেখা গেলো সেই তারাও বাকশাল রহিত করে আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করার পক্ষে সাফাই গাইলেন। এরা বঙ্গবন্ধুর বাকশাল মন্ত্রিসভারই সদস্য ছিলেন। বাকশালে কোথাও ছিলেন না দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান মোশতাকের অবাধ্য হওয়ায় হত্যা করা হয়।
আব্দুস সামাদ আজাদ, কোরবান আলী ছাড়া বঙ্গবন্ধুর বাকশাল মন্ত্রিসভার সকলেই মোশতাকের মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করেন। পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েন এমন মন্ত্রীদের মধ্যে শেখ আবদুল আজিজ, মোল্লা জালাল উদ্দীন, মিজানুর রহমান চৌধুরী, এম আর সিদ্দিকী, ডঃ মফিজউদ্দিনকে মোশতাকের মন্ত্রিসভায় দেখা যায়নি।
যাহোক রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক পহেলা সেপ্টেম্বর বাকশাল রহিত করে ৩ সেপ্টেম্বর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন। ১৯৭৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দেন।
রাষ্ট্রপতি মোশতাক ১৯৭৫ সালের ১৬ অক্টোবর বঙ্গভবনে আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের অধিবেশন ডাকেন। নিয়মানুযায়ী জাতীয় সংসদের স্পিকার আব্দুল মালেক উকিলের সভাপতিত্বেই বৈঠক শুরু হয়। বৈঠক উত্তপ্ত হয়ে ওঠে গাজীপুরের ময়েজউদ্দিন আহমদ, কুমিল্লার অ্যাড, সিরাজুল হক ও ঢাকার শামসুল হক বঙ্গবন্ধু হত্যার তীব্র প্রতিবাদ করলে। কিন্তু ওই বৈঠকেও একজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী খুঁজে পাওয়া যায়নি তাদের কন্ঠে কন্ঠ মেলানোর জন্য। ১৯৭৫ সালের ২৬ আগস্ট বঙ্গবন্ধু মর্মে 'ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ' জারি করা হয় মন্ত্রিসভার সর্বসম্মতিক্রমে। মোশতাকের আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের খসড়া তৈরি করে বৈঠকে বাহবা কুড়ান। তিনি বঙ্গবন্ধুরও আইনমন্ত্রী ছিলেন।
মোশতাকের মোসাহেবি এমনভাবে শুরু হয় যে, দেশে জাতীয় পাখি আছে, জাতীয় ফুল আছে, জাতীয় ফল আছে, একটা জাতীয় টুপি থাকা দরকার। অতএব একটা জাতীয় টুপির পক্ষে মন্ত্রিসভার অনুমোদন মিললো। গাঢ় ছাই রঙের কিস্তি টুপি যে টুপিটা খন্দকার মোশতাক পরিধান করেন। ২৬ আগস্টের ওই বৈঠকের সিদ্ধান্তক্রমেই সংসদ ভবনসহ সমস্ত সরকারি দফতর থেকে বঙ্গবন্ধু ছবি নামিয়ে ফেলার নির্দেশ দেয়া হয়।
মন্ত্রিসভা গঠনের ৮ দিনের ব্যবধানে (২৩ আগস্ট) গ্রেফতার করা হয় সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, এম মনসুর আলী, এএইচএম কামরুজ্জামান, আব্দুস সামাদ আজাদকে। ২ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার করা হয় জিল্লুর রহমান, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ ও গাজী গোলাম মোস্তফাকে। পরে গ্রেফতার করা হয় আমির হোসেন আমু, মোজাফফর হোসেন পল্টুকে। এসব গ্রেফতার নিয়েও কী মন্ত্রিসভার কোন সদস্য মুখ খুলেছিলেন? রাষ্ট্রপতি মোশতাক কী গ্রেফতারের আগে তার মন্ত্রীদের পরামর্শ নেননি?
বঙ্গবন্ধু সরকারের তথ্যমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী তার 'রাজনীতির তিনকাল' গ্রন্থে লিখেছেন, "একদিন খন্দকার মোশতাক আমাকে ইফতারের দাওয়াত দিলেন। ইফতারের পর বললেন, "তোমাকে আমার সঙ্গে কাজ করতে হবে। তুমিও যদি দেশের রাষ্ট্রপতি হও তাহলে তোমারও দেশ পরিচালনার জন্য ৫০ জন লোক লাগবে। " জবাবে বললাম, মোশতাক ভাই আপনি তো বলেছেন আওয়ামী লীগ করবেন। তাই আমাকে দলের জন্যই রাখেন। সরকারে টানার দরকার নেই।
'৬৬-৭২ আওয়ামী লীগে সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরী নেতাদের গ্রেফতারের প্রতি ইঙ্গিত করে বঙ্গভবনের সভায় বলেছিলেন, "যেভাবে নেতাকর্মীদের নির্যাতন, গ্রেফতার ও হয়রানি করা হচ্ছে, তাতে দল করবেন কাদের নিয়ে?
বাস্তবতা ছিল মোশতাকের ৮৩ দিনের রাজত্বে একজন মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীর পদত্যাগের ঘটনা ঘটেনি।
যদিও খন্দকার মোশতাকের আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবনের সুযোগ আর হয়নি। তিনি ডেমোক্রেটিক লীগ নামে একটি দল গঠন করেছিলেন। '৭৬ সালে বায়তুল মোকাররম মসজিদ প্রাঙ্গণে তার জনসভায় কে বা কারা অতর্কিত সাপ ছেড়ে দেয় এবং ঘটে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা। ৯ জন এতে মারা যায়। ১৯৯৬ সালের ৫ মার্চ মোশতাক মারা যায়। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মোশতাকের নাম থাকলেও কোন মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রীর নাম ছিল না, বরং তারা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ছিলেন।
১৯৭৬ সালের ৪ নভেম্বর আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবনের পর সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন নেতৃত্বলাভ করেন। পরে স্পিকার আবদুল মালেক উকিলের হাতে চলে যায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব। আব্দুর রাজ্জাক কারাগারে বসে সাধারণ সম্পাদক হন। মালেক উকিল আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান শেষে লন্ডনে যাত্রা বিরতিকালে সাংবাদিকদের বলেন, "বাংলাদেশ ফেরাউনের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে চরম ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্য করার পরও আবদুল মালেক উকিল কি করে আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়েছিলেন তার জবাব কে দেবেন?
১৯৭৯ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় সংসদ গঠিত হলে মোশতাকের নৌ জাহাজ চলাচল মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বিরোধী দলের নেতা নির্বাচিত হন।
মোশতাকের মন্ত্রীদের মধ্যে ফণিভূষণ মজুমদার, আব্দুল মান্নান, আব্দুল মোমিন, সোহরাব হোসেনও আওয়ামী লীগের রাজনীতির শীর্ষে অবস্থান করেন।
অপরদিকে, মোশতাকের অর্থমন্ত্রী ড. আজিজুর রহমান মল্লিক, শিক্ষামন্ত্রী ড. মোজাফফর আহমদ চৌধুরী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী মোশতাকের পতনের পর নিস্ক্রিয় হয়ে পড়েন।
পরিকল্পনা মন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলী আওয়ামী লীগ (মিজান) এর সাধারণ সম্পাদক হলেও পরে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির মন্ত্রী হন। আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর রাজনীতি থেকে হারিয়ে যান। বঙ্গবন্ধু সরকারের নৌ জাহাজ চলাচল মন্ত্রী জেনারেল এম এ জি ওসমানী মোশতাকের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হয়েছিলেন। পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তাকে সমর্থন দেয়।
প্রতিমন্ত্রীদের মধ্যে দেওয়ান ফরিদ গাজী আওয়ামী লীগে ফেরেন। বিএনপিতে পাড়ি জমান কেএম ওবায়দুর রহমান, রিয়াজুদ্দিন আহমেদ ভোলা মিয়া, নূরুল ইসলাম মঞ্জুর। আর জাতীয় পার্টিতে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, ডাঃ ক্ষিতীশ চন্দ্র মন্ডল। তাহের উদ্দিন ঠাকুর, নূরুল ইসলাম চৌধুরী, সৈয়দ আলতাফ হোসেন, মোসলেম উদ্দিন খান ও মোমেন উদ্দিন আহমেদও মোশতাকের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ছাড়া মোশতাক মন্ত্রিসভার কেউ বেঁচে নেই।
১৯৭১ সালে মুজিব নগর সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোশতাক পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন গঠনের চক্রান্তের দায়ে অভিযুক্ত হন। হারান মন্ত্রীত্ব। আর সেই মধুর প্রতিশোধ নেন '৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জাতীয় চারনেতাকে হত্যা করে। রাষ্ট্রপতির ভাষণে মোশতাক বঙ্গবন্ধুর খুনীদের 'দেশের সূর্য সৈনিক' হিসাবে অভিহিত করেন।
আওয়ামী লীগ একুশ বছর পর '৯৬ সালের ২৩ জুন ক্ষমতায় ফিরে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চারনেতা হত্যার বিচার কার্য শুরু করে। ভাগ্যিস মোশতাক তার আগেই মারা যান। পুলিশ পাহারায় বায়তুল মোকাররম মসজিদ প্রাঙ্গণে মোশতাকের লাশ এনে নামাজে জানাজা করতে চাইলেও গণবিক্ষোভের মুখে সম্ভব হয়নি। কুমিল্লার দাউদকান্দির দশপাড়ায় পারিবারিক কবরস্থানে মোশতাককে দাফন করা হয়। সব কবরে নামফলক থাকলেও নেই মোশতাকের কবরে। মোশতাকের ছেলে ইশতিয়াক আহমেদ থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে। আর দুই মেয়ে শিরিন সুলতানা ও ডাঃ নাজনীন সুলতানা যুক্তরাজ্যে। তারা জনরোষের ভয়ে বাড়িতে আসছেন না। পরিত্যক্ত এখন সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা মোশতাকের বাড়িটি।
আগেই বলেছি খন্দকার মোশতাক ২১ বছর বাড়ির চার দেয়ালে বন্দী ছিলেন। দুরারোগ্যে ভুগতে ভুগতে ’৯৬ সালের ৫ মার্চ মারা যান। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মোশতাক আসামি হলেও মৃত বলে আদালত তার নাম বাদ দেয়। যদিও মরণোত্তর বিচারেরও সুযোগ ছিল।
নামাজে জানাজার জন্য পুলিশ পাহারায় মোশতাকের লাশ বায়তুল মোকাররম মসজিদ প্রাঙ্গণে আনার চেষ্টা করা হলেও বিক্ষোভের মুখে তা সম্ভব হয়নি। দাউদকান্দিতে কবর দেয়া হলেও নেই কোনো নামফলক। মোশতাকের বাড়িটিও পরিত্যক্ত। এক ছেলে যুক্তরাষ্ট্রে আর দুই মেয়ে আছে যুক্তরাজ্যে। নিয়তির কী বিধান জনরোষের আতঙ্কের কারণে বাবার কবর দেখতেও তারা দেশে ফিরতে পারেন না। অথচ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মাজারকে ঘিরে কতশত মানুষের প্রার্থনা। তিনি বঙ্গবন্ধু শুধু নিজ স্বদেশে নয়, জাতিসংঘের মূল্যায়নে ‘বিশ্ববন্ধু’।
নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে খোশবাগে আলীবর্দি খানের পাশেই কবর দেয়া হয়। তিনিও ইতিহাসের বীর নায়ক। ১৭৫৭ সালের ২৯ জুন মসনদে বসা মীর জাফর ক্ষমতা হারিয়ে কুষ্ঠরোগে মরে থাকেন রাস্তায়। যেদিন সিরাজের মস্তকহীন লাশ হাতিতে চড়িয়ে রাজধানী মুর্শিদাবাদের অলিগলি প্রদক্ষিণ করছিল সেই দিনটি সম্পর্কে পলাশীর খলনায়ক লর্ড ক্লাইভ লিখেছেন, ‘কয়েক লাখ লোক দর্শক হলো, তারা চাইলে শুধু লাঠি ও ঢিল দিয়ে ইংরেজ সৈন্যদের মেরে ফেলতে পারতো।’
রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাংবিধানিকভাবে আপনাআপনি ভারপ্রাপ্ত বা অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হওয়ার কথা। কিন্তু প্রথমেই প্রধান বিচারপতি এ বি সিদ্দিক সংবিধান লঙ্ঘন করে খন্দকার মোশতাককে রাষ্ট্রপতি পদে শপথবাক্য পাঠ করান। সংবিধান অনুযায়ী স্পীকার আবদুল মালেক উকিলের কাছে শপথ গ্রহণের কথা রাষ্ট্রপতির। বঙ্গবন্ধু স্পীকারের কাছেই শপথ গ্রহণ করেছিলেন।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম অপারগতা প্রদর্শন করলে প্রধানমন্ত্রী এম মনসুর আলী অথবা তিনিও অপরাগতা প্রকাশ করলে স্পীকার আবদুল মালেক উকিল অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন, এটাই ছিল সাংবিধানিক ব্যবস্থা।
কিন্তু অবৈধভাবেই সব কার্য সম্পন্ন করা হয় সেখানে আর সংবিধান কি? বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি থেকে পাঁচ বছরের জন্য বাকশালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন সংবিধান চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে। তিনি সাংবিধানিক জাতীয় দল বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) এর চেয়ারম্যান ছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর উপরাষ্ট্রপতি ও বাকশালের ভাইস চেয়ারম্যান সৈয়দ নজরুল ইসলাম নন, বাণিজ্যমন্ত্রী মোশতাকের নাম রাষ্ট্রপতি হিসাবে ঘোষণা করা হয়। খুনী মেজর ডালিম বেতার-টিভিতে এ ঘোষণা দেয়। শপথের আগেই রাষ্ট্রপতি! প্রধান বিচারপতি শপথ গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করলে তাঁকেও কি হত্যা করা হতো? মোশতাকের আনুগত্য স্বীকার করে মন্ত্রীত্ব গ্রহণ না করলে সবাইকেই কি হত্যা করা হতো? সেনাবাহিনী প্রধান কে এম শফিউল্লাহ, বিমান বাহিনী প্রধান এ কে খন্দকার, নৌ বাহিনী প্রধান মোশাররফ হোসেন খান, বিডিআর প্রধান খলিলুর রহমান, পুলিশ বাহিনী প্রধান নুরুল ইসলাম ও রক্ষীবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত প্রধান খুনী মোশতাকের প্রতি আনুগত্য স্বীকার না করলে তাদেরও কি হত্যা করা হতো? তারা প্রত্যেকেই অবৈধ সরকারকে আনুগত্য স্বীকার করে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। যদিও আনুগত্য স্বীকার করেও পদ হারিয়েছেন সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ। খুনীদের পছন্দে জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান হওয়ার তিনদিনের মাথায় ২৬ আগস্ট "৭৫ জারি করা হয় ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ। পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতির পদ দখল করে জিয়াই সংবিধানে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ পাস করিয়ে খুনীদের হত্যাকে বৈধতা দেন। শুধু তাই নয়, বিদেশি দূতাবাসে খুনীদের দিয়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করান। সিজিএস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ জিয়াকে বন্দী করে মোশতাককে দিয়ে সেনাপ্রধানের পদ ভাগিয়ে নেয়াও ছিল অপ্রকৃতস্থদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই। মোশতাককে মেনে নিয়েই খালেদ মোশাররফ সেনাপ্রধান হয়েছিলেন। কিন্তু জাতীয় চার নেতা হত্যার খবর পেয়ে মোশতাককে হটিয়ে প্রধান বিচারপতি এএসএম সায়েমকে রাষ্ট্রপতি করেন। কিন্তু জেনারেল ওসমানী ও খালেদ মোশাররফের খুনীদের বিদেশে পাঠিয়ে দেয়া কি চরম বিশ্বাসঘাতকতামূলক ছিল না? বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারে ১২ খুনীর ফাঁসি দেখে কি বলার সুযোগ আছে যে বঙ্গবন্ধু হত্যা ছিল রাজনৈতিক হত্যা ও দেশ-বিদেশের গভীর ষড়যন্ত্রের ফল? গুটি কয়েক সেনা সদস্যই হত্যাকান্ড ঘটালে তারা কেনো ক্ষমতা নিলো না?
হত্যার জন্য জাতীয় চার নেতার সঙ্গে লাইনে দাঁড় করানো হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদকেও। প্রয়াত নেতার ভাষ্যমতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান সাহেবের সঙ্গে তাকেও খুনীরা হত্যার জন্য লাইনে দাঁড় করিয়ে ছিল। কিন্তু খুনীদের মধ্য থেকে কেউ একজন তাকে সরিয়ে দেয়।
আব্দুস সামাদ আজাদের মতে, সেদিন যদি বঙ্গবন্ধুর বাকশাল মন্ত্রিসভার ২১ সদস্য মোশতাকের কাছে শপথ না নিতো, তাহলে ইতিহাস আরেকটি জনযুদ্ধে রূপ নিতো। চার নেতা হত্যার শিকার হতেন না।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ইতিহাস বিশেষজ্ঞ।