আমরা প্রতি বছরই ৫ই আগস্ট এলে কামাল ভাইয়ের জন্মদিন উপলক্ষে আলোচনা সভা করি। যারা কামাল ভাইয়ের সঙ্গে তখন পড়াশুনা করতেন তাদের সাথে আমরা দেখা করি এবং তার সম্বন্ধে আরও জানতে চাই। তার সম্পর্কে আমরা যত শুনি ততো বেশী মুগ্ধ হয়। শেখ কামাল নিরহঙ্কার, নির্লোভ রাজনৈতিক, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। একটা উক্তি আছে, যে আগামীকাল দেখে। কামাল কিন্তু আগামীকাল দেখতে পারতো অর্থাৎ সে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ভবিষ্যৎ দেখতে পারতো। আজকে তার জন্মদিন হলেও আমাদের মধ্যে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, আমাদের মধ্যে আহাজারি কাজ করছে। আজকে যদি সে বেচে থাকতো তাহলে বাংলাদেশের খেলাধুলা এক অনন্য চূড়ায় আহরণ করতো।
দৈনিক ভোরের পাতার নিয়মিত আয়োজন ভোরের পাতা সংলাপের ৭৮৭তম পর্বে এসব কথা বলেন আলোচকরা। ভোরের পাতা সম্পাদক ও প্রকাশক ড. কাজী এরতেজা হাসানের নির্দেশনা ও পরিকল্পনায় অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন-বাংলাদেশ স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, সংসদ সদস্য পঙ্কজ দেবনাথ, স্বাধীন বাংলার জাতীয় ক্রিকেট দলের প্রথম দলনেতা রকিবুল হাসান, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক কর্নেল (অব.) কাজী শরীফ উদ্দীন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ভোরের পাতার বিশেষ প্রতিনিধি উৎপল দাস।
পঙ্কজ দেবনাথ বলেন, আজকে ভোরের পাতা সংলাপের বিষয় বহুমাত্রিক তারুণ্যের রোল মডেল শেখ কামাল নির্বাচন করার জন্য আমি শুরুতেই ভোরের পাতাকে ধন্যবাদ জানাতে চাচ্ছি। আমরা প্রতি বছরই ৫ই আগস্ট এলে কামাল ভাইয়ের জন্মদিন উপলক্ষে আলোচনা সভা করি। যারা কামাল ভাইয়ের সঙ্গে তখন পড়াশুনা করতেন তাদের সাথে আমরা দেখা করি এবং তার সম্বন্ধে আরও জানতে চাই। তার সম্পর্কে আমরা যত শুনি ততো বেশী মুগ্ধ হয়।মাত্র ২৬ বছরের জীবনসীমায় দেশ ও সমাজের জন্য যা করে গেছেন, তা নিছক কর্ম নয় বরং সেটি তরুণদের উজ্জীবিত হওয়ার মূলমন্ত্রও বটে। ক্ষণজন্মা এ মহীয়ান পুরুষের আজ ৭৩তম জন্মদিন। ১৯৪৯ সালের আজকের এ দিনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের সংসার আলোকিত করে পৃথিবীতে শুভ আগমন ঘটে শেখ কামালের। ৭১- এর ২৫ মার্চ ভয়াল কালরাতে পাকহানাদার বাহিনী যখন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ করে, ঠিক সেই সময় দেশকে স্বাধীন করার জন্য কামাল ধানমন্ডির বাড়ি থেকে পাড়ি জমান রণাঙ্গনে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে এসে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এমজে ওসমানীর এডিসি হিসেবে কাজ করেন। তরুণ বয়সে শুধু মুক্তিযুদ্ধে গিয়েই ক্ষান্ত হননি বরং একজন তরুণের জীবন কতখানি কর্মময় হতে পারে তা শহীদ শেখ কামালের সংক্ষিপ্ত জীবন বিশ্লেষণে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মহান মুক্তিযুদ্ধে অন্যতম সংগঠক হিসেবে ছাত্রসমাজকে সুসংগঠিত করে দেশমাতার মুক্তিযুদ্ধে হাতিয়ার তুলে নিয়েছিলেন তিনি। দায়িত্বে ছিলেন মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর এডিসি হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্বাধীন বাংলার ফুটবল দলকে সুসংগঠিত করেন শেখ কামাল। তিনি স্বপ্ন দেখতেন দেশ স্বাধীন হলে পাল্টে যাবে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের চিত্র এবং ক্রীড়াক্ষেত্রে অনন্য উচ্চতায় বহির্বিশ্বে আসীন হবে বাংলাদেশ। শেখ কামালের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় স্বাধীনতাবিরোধী ও একটি কুচক্রীমহল। নানামুখী ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচারের মাধ্যমে শেখ কামালের জনপ্রিয়তার লাগাম টেনে ধরা ও তার উদ্যমতাকে দমিয়ে রাখার ষড়যন্ত্র করে ঐ কুচক্রীমহলটি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মা ও বাবাসহ পরিবারের ১৮ জন সদস্যদের সংগে বিশ্বাসঘাতকদের নির্মম বুলেটে মৃত্যুর শিকার হন তিনি।
রকিবুল হাসান বলেন, আমি সেই ভাগ্যবান যে ছোট বেলা থেকেই কামালের সান্নিধ্য পেয়েছিলাম। শাহীন স্কুলে তখন কামাল পড়াশুনা করতো আর আমি সেন্ট গ্রেগরিতে পড়াশুনা করতাম। তদাকিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে বিভিন্ন ধরণের খেলাধুলা হতো, যেমন বেসবল, রাগবি, বাস্কেটবল। সেই সুবাধে শাহিন স্কুল তখন অনেক ভালো ছিল। আমি হয়তো তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। কামাল আমার থেকে এক বছরের একাডেমিকলি সিনিয়র ছিল। কারণ ক্রীড়াবিদদের মধ্যে কোন বয়সের সিনিউরিটি বা বয়সের প্রাধান্য থাকেনা। ক্রীড়াঙ্গন এমন একটা প্লাটফর্ম যেখানে অফুরন্ত ভালোবাসা, উদ্যম কাজ করে। তাই ওইসময় থেকেই আমাদের মধ্যে একটা বন্ধুত্বসুলভ সম্পর্ক চলে এসেছিল। সেসময় এক বাস্কেটবল টুর্নামেন্ট থেকে তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক শুরু। ধারাবাহিকভাবে আমাদের মধ্যে তখন যোগাযোগ হতে থাকলো। ওই খেলার সুবাদে আমাদের মধ্যে দেখা হতো, আলাপ হতো। এইজন্যই আমি সব সময় বলি কামালের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল লাভ এন্ড হেইট। এই ভালোবাসা আবার এই শত্রুতা। ভালোবাসা ছিল যখন আমরা সামাজিকভাবে একত্রে হতাম তখন আর শত্রুতা হতো যখন আমরা খেলার মাঠে থাকতাম। খেলা শেষ আবার আমাদের মধ্যে চলতে থাকলো সম্পর্কটা। সে বহুমাত্রিক গুনের অধিকারী ছিল। আবাহনী ক্রীড়াচক্র প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি দেশের ক্রীড়াজগতে স্মরণীয় হয়ে আছেন। ‘স্পন্দন শিল্পীগোষ্ঠী’র প্রতিষ্ঠাও তাকে অমরত্ব দান করেছে। প্রকৃতপক্ষে শেখ কামাল ছিলেন একজন ক্রীড়া ও সংস্কৃতিমনা সুকুমার মনোবৃত্তির মানুষ। তিনি কখনও ব্যবসায়িক কার্যকলাপে জড়িত হননি, অনর্থক ছোটেননি অর্থের পেছনে। শেখ কামাল নিরহঙ্কার, নির্লোভ রাজনৈতিক, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। একটা উক্তি আছে, যে আগামীকাল দেখে। কামাল কিন্তু আগামীকাল দেখতে পারতো অর্থাৎ সে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ভবিষ্যৎ দেখতে পারতো। আজকে তার জন্মদিন হলেও আমাদের মধ্যে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, আমাদের মধ্যে আহাজারি কাজ করছে। আজকে যদি সে বেচে থাকতো তাহলে বাংলাদেশের খেলাধুলা এক অনন্য চূড়ায় আহরণ করতো।
অধ্যাপক কর্ণেল (অব.) কাজী শরীফ উদ্দীন বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাঁচ সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় এবং জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল ১৯৪৯ সালের এই দিনে তৎকালীন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকার বিএএফ শাহীন স্কুল থেকে ১৯৬৭ সালে এসএসসি (মাধ্যমিক) পাশ করেন ও ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৬৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। স্কুল জীবন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বিনয়ী ও মার্জিত শেখ কামাল তার মানবিক গুণাবলী ও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের জন্য বন্ধু, সহপাঠী সকলের কাছেই সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছিলেন। ছাত্রলীগের কর্মী ও সংগঠক হিসেবে তিনি ৬ দফা, ১১ দফা আন্দোলন এবং ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে বীরোচিত অংশগ্রহণ ছিল তাঁর। অসামান্য সাংগঠনিক দক্ষতার অধিকারী শেখ কামাল সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ওয়ার কোর্সে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে মুক্তিবাহিনীতে কমিশন্ড লাভ করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম এ জি ওসমানীর এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য ছিলেন। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নেওয়ার অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা শহিদ শেখ কামাল। খেলাধুলার নতুন ধারা সূচনা করতেই ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ’আবাহনী ক্রীড়াচক্র’। শেখ কামাল ছিলেন খেলাধুলায় একজন নিবেদিত প্রাণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে খেলেছেন ফুটবল, আবাহনীর হয়ে খেলেছেন ক্রিকেট। মূলত ক্রিকেট, ফুটবল, বাস্কেটবলসহ সবধরনের খেলায় সাফল্য দেখিয়েছিলেন তিনি। শেখ কামালের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় স্বাধীনতাবিরোধী ও একটি কুচক্রীমহল। নানামুখী ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচারের মাধ্যমে শেখ কামালের জনপ্রিয়তার লাগাম টেনে ধরা ও তার উদ্যমটাকে দমিয়ে রাখার ষড়যন্ত্র করে ঐ কুচক্রীমহলটি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মা ও বাবাসহ পরিবারের ১৮ জন সদস্যদের সংগে বিশ্বাসঘাতকদের নির্মম বুলেটে মৃত্যুর শিকার হন তিনি। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারের হত্যাকান্ডের এই নারকীয় ঘটনায় প্রথম শহীদ শেখ কামাল।