সম্প্রতি পুলিশের রংপুর রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন মো. আব্দুল আলীম মাহমুদ। ২০১৮ সালে যাত্রা শুরু হওয়া রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) প্রথম কমিশনার হিসেবে ওই বছরের ২৯ জুলাই যোগদান করেন তিনি। গতকাল রোববার ছিল তার আনুষ্ঠানিক বিদায়। যোগদানের পর থেকেই আরএমপিকে জনবান্ধব করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মেধা, শ্রম, সাহস ও সততা নিয়ে কাজ করেছেন। আরএমপির নানামাত্রিক উন্নয়নে প্রথম কমিশনার হিসেবে তার ভূমিকা অবিস্মরণীয়। কাজ করতে গিয়ে দীর্ঘ চার বছরের অভিজ্ঞতা ও আবেগ-অনুভূতির নানা দিক তিনি তুলে ধরেছেন তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজে। রোববার নিজের ফেসবুক ওয়ালে তিনি যে স্ট্যাটাস দিয়েছেন তা ভোরের পাতার পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
‘রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের প্রথম পুলিশ কমিশনার হিসেবে ২৯-৭-২০১৮ তারিখে যোগদান করি। চার বছর দায়িত্ব পালন শেষে আজ আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায়। যদিও ২৪-০৭-২০২২ তারিখে আমি এখানে দায়িত্ব হস্তান্তর করে রংপুর রেঞ্জে যোগদান করেছি। নতুন এই প্রতিষ্ঠানে বিগত চার বছরের অসংখ্য কর্মকা- এবং স্মৃতি মনে করে আজকের এই পোস্টÑ
ধাপ পুলিশ ফাঁড়িতে পুলিশ কমিশনারের অস্থায়ী কার্যালয়ে যোগদান করি। দোতলার কক্ষগুলোতে সহকারি পুলিশ কমিশনার ও তদুর্ধ কর্মকর্তারা বসতাম। নিচতলার কক্ষগুলোতে সদর দফতরের অপরাধ শাখা, রিজার্ভ অফিস, ট্রাফিক অফিস, প্রধান সহকারীর অফিস, হিসাব শাখা, সিটিএসবি, ডিবি এবং ফাঁড়ির কার্যক্রম চলত। অনেকদিন পরে সেখান থেকে কাছারি বাজারস্থ বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের তৃতীয় তলায় পুলিশ কমিশনারের কার্যালয়টি স্থানান্তর করা হয়। নবাবগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়ি উর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে উপ পুলিশ কমিশনার (অপরাধ), উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিবি) সহকারী পুলিশ কমিশনার (পেট্রোল), সহকারি পুলিশ কমিশনার (কোতোয়ালি জোন) সহকারি পুলিশ কমিশনার (মাহিগঞ্জ জোন) এর কার্যালয় স্থাপন করা হয়।
রংপুর সিটি কর্পোরেশন, হারাগাছ পৌরসভা, সারাই এবং কল্যাণী ইউনিয়ন নিয়ে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের অধিক্ষেত্র নির্ধারিত হয়। পুরাতন থানা এবং কোর্ট থেকে সমস্ত নথি এবং রেজিস্টারপত্র পৃথক করে নবগঠিত ছয়টি থানার জন্য প্রস্তুত ও বিতরণ করা হয়।
রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশে প্রথম যোগদানকারী উপ-পুলিশ কমিশনার জনাব মহিদুল ইসলাম ইতোপূর্বেই চারটি থানা এবং পুলিশ লাইন্সের ভাড়ার কার্যক্রম শুরু করে । ছয়টি থানা, পুলিশ লাইন্স, উপ পুলিশ কমিশনারদের কার্যালয় এবং পুলিশ কমিশনারের কার্যালয়ের জন্য সমস্ত অফিস সরঞ্জামাদি সংগ্রহ করা হয়। অর্থাৎ উদ্বোধন অনুষ্ঠানের পূর্বেই অফিসার ও ফোর্সের যোগদান, রেজিস্টার পত্র পৃথককরন, তৈরি ও বিতরণ, যানবাহন ও অফিস সরঞ্জামাদি সংগ্রহ, টেলিকমিউনিকেশন সিস্টেম চালুসহ প্রশাসনিক সমস্ত কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়।
১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কার্যক্রমের শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করেন। জমকালো সেই উদ্বোধন অনুষ্ঠানের পরপরই রোড শো, র্যালি এবং সন্ধ্যায় মনোমুগ্ধকর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। উদ্বোধনের প্রথম দিন থেকেই রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ পুরোদমে অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু করে।
পুলিশ লাইন্স, চারটি থানা, পুলিশ কমিশনারের কার্যালয়, পুলিশ কমিশনারের বাসভবন এবং অফিসারদের আবাসনের জন্য জমি অধিগ্রহণ কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়। দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে পুলিশ লাইনস এবং দুটি থানার জমি অধিগ্রহণের জন্য বাজেট পাওয়া যায়। অবশিষ্ট ইউনিটসমূহের জন্য জমি অধিগ্রহণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
দ্রুততম সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি, সেবা প্রার্থী মানুষের দুর্দশা লাঘব, দ্রুত ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে সমস্যা সমাধানে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করার মাধ্যমে জনবান্ধব পুলিশিং ব্যবস্থা চালু করা হয়।
ওএমএস এবং টিসিবি পণ্য বিক্রয়ের অনিয়ম রুখতে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উদ্যোগ সারাদেশের মানুষের নজরে আসে।
যানবাহনের সংকট নিরসনের জন্য নিজস্ব অর্থায়নে একটা প্রাইভেট কার ও ছয়টি হিউম্যান হলার ক্রয় করা হয়। করোনাকালীন মানুষের বাড়িতে বাড়িতে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী সরবরাহের নিমিত্তে হোম ডেলিভারি সার্ভিস চালু, ১০ লক্ষ মাস্ক, স্বাস্থ্য বিধান সামগ্রী বিতরণ, শহরকে জীবাণুমুক্তকরণের ব্যবস্থা গ্রহণ, মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরিতে মাইকিং, লিফলেট বিতরণ, সিটি বাজারের ভিড় এড়ানোর জন্য বাজার স্থানান্তর এবং সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মাঝে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করা হয়। চ্যানেল আই এ বিষয়ে ‘হ্যাটস অফ’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্বীকৃতি প্রদান করায় চ্যানেল আই এর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
জনাব মো. ইদ্রিস আলীকে সভাপতি ও জনাব সুশান্ত ভৌমিককে সাধারণ সম্পাদক করে কমিউনিটি পুলিশিংÑএর প্রথম কমিটি গঠনপূর্বক অপরাধ প্রতিরোধে জনগণকে উদ্বুদ্ধকরনের নানামুখী কর্মসূচি নেওয়া হয়। বাংলাদেশ পুলিশের তৎকালীন ইন্সপেক্টর জেনারেল ড. জাবেদ পাটোয়ারী বিপিএম (বার) মহোদয়ের উপস্থিতিতে কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির প্রথম অভিষেক অনুষ্ঠিত হয়। কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির সদস্যদের নিয়ে ঘন ঘন প্রীতি ব্যাডমিন্টন এবং প্রীতি ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন হয়।
বিট পুলিশিং কার্যক্রম শুরুর জন্য অফিস নিয়ে এবং স্থানীয় সম্মানিত নাগরিকগণকে সাথে নিয়ে এ কার্যক্রম চালু করা হয়। রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশে যা কিছু প্রথম তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণের লক্ষ্যে মেট্রোপলিটন পুলিশ আর্কাইভ চালু করা হয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন সহজে মেট্রোপলিটন পুলিশের ইতিহাস জানতে এবং তথ্য নিয়ে গবেষণা করতে পারে সেজন্য এই উদ্যোগ।
রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশে আধুনিক সুবিধা সম্বলিত পুলিশ ট্রেনিং স্কুল চালু করা হয়। অসুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়াতে এবং দ্রুত তাকে হাসপাতালে পৌঁছানোর জন্য সুলভ মূল্যে অ্যাম্বুলেন্স সেবা চালু করা হয়। আধুনিক সুবিধাসম্বলিত শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এই অ্যাম্বুলেন্স-এর মাধ্যমে অসংখ্য অসুস্থ মানুষকে মেট্রোপলিটন পুলিশ প্রতিনিয়ত সেবা দিয়ে যাচ্ছে।
ব্যস্ততম সড়কের ফুটপাত উচ্ছেদপূর্বক হকারদের অন্যত্র পুনর্বাসন করা, যানজট নিরসন, চাঁদাবাজ, দখলবাজ এবং হকারমুক্ত রেখে শহরকে মানুষের চলাচলের উপযোগী করা হয়। উদ্বোধনের প্রায় এক মাস পর ঝামেলা ও দুর্নীতিমুক্ত চঙঝ মেশিনের মাধ্যমে যানবাহনে জরিমানা আদায় করা হয়।
পুলিশ ফোর্সের জন্য পুলিশ লাইন্সে লাইব্রেরি চালু করা হয়। পুলিশ লাইন্সে ডাইনিং হল নির্মাণ ও অডিটোরিয়াম চালু করা।
মানবতার বন্ধনে রংপুর প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিত এতিম অসহায় মানুষের মাঝে খাবার বিতরণ, গাছের চারা বিতরণ, নলকূপ স্থাপন, শীতবস্ত্র বিতরণ এবং চিকিৎসা সুবিধা প্রদান করা হয়। মানবতার বন্ধনে এতিমখানা ও মাদ্রাসা, (দর্শনা) এবং মানবতার বন্ধনে এতিমখানা ও হেফজখানা, (মদামুদন) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। মেট্রোপলিটন পুলিশে কর্মরত অফিসারদের নিয়ে নিজস্ব উদ্যোগে প্রায় আট একর জমির উপরে হাউজিং প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়।
প্রথম পুলিশ কমিশনার হিসেবে আমি আমার সর্বোচ্চ মেধা, শ্রম আর প্রজ্ঞা দিয়ে চেষ্টা করেছি এ প্রতিষ্ঠানকে জনবান্ধব, সৎ এবং দক্ষ ইউনিট হিসেবে গড়ে তুলতে। আমার সহকর্মীরা আমাকে সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করেছেন। আমাকে কাজ করার এবং এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। যতটুকু সফল হয়েছি তার সব কৃতিত্ব আমার সহকর্মীদের আর ব্যর্থতার সব দায় আমার। আমার এই চার বছরের কর্মকাল আমৃত্যু আমার স্মৃতিতে জাগরুক থাকবে। সহযোগিতার জন্য সম্মানিত নগরবাসীসহ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’