বিদায়... সাংবাদিকতার জেমস বন্ড সম্পাদক
অমিতদার সাথে শেষ দেখা ২২ জুলাই শুক্রবার। বিআরবি হাসপাতালে। আগের রাতে মুমূর্ষু অবস্থায় তাঁকে হাসপাতালে নেবার খবরটি জানায় সহকর্মী মাশহুদুল হক। দেশ রুপান্তরের প্রধান প্রতিবেদক উম্মুল ওয়ারা সুইটির কাছে বিস্তারিত খবরের জন্য জানতে চাইলে, খবরের এই মেয়েটি ফোনের ওপারে থেকে খবর কিছু তেমন করে বলতে পারেনি, কেঁদেছে অঝোরে। এক সহকর্মীর অঝোর কান্নার গভীরেতো পরতে পরতে খবর- মানে বার্তা। যারা চেনেন না সাংবাদিক অমিত হাবিবকে, তারা সহজেই বুঝে নেবেন, নামের আগে যে বিশেষণই থাক না কেন, মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়া মানুষটি, মানুষ হিসেবে- সহকর্মী হিসেবে এটুকু অর্জন করেছেন যার জন্য চোখের পানি ঝরছে সহযোদ্ধাদের।
শুক্রবার দুপুরে বিআরবি হাসপাতালের আইসিইউর স্টাফরা অকপটে এ কথাই বলছিলেন, পর্দায় দেখা চেনাজন - এই আমাকে। অমিতদা তখন প্রায় অচেতন। সারা শরীরে যেসব যন্ত্রপাতি সংযোজিত, সেগুলি দেখাচ্ছে অবস্থা উন্নতির দিকে।
অচেতন অমিত হাবিবের মাথায় হাত বোলালাম, হাতটা ধরে থাকলাম। এক মুহূর্তেই চলে গেলাম ৯১ এর আজকের কাজগের নিউজ টেবিলে। পুলক গুপ্ত আমাদের হেডস্যার, অমিত হাবিব সহকারি হেডস্যার। মানে ইন্টারন্যাশনাল ডেস্কের এ্যাসিস্ট্যন্ট শিফট ইন চার্জ। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে সবে ভর্তি হয়েছি। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে কাজ শেখার প্রথম চাকরির কর্মস্থল। কিছুই পারতাম না তখন। ভুলভাল লেখা অমিত দা, পুলকদা এডিট করে দিতেন। কোনো শব্দের বানান- মানে বা কোন দেশ কোন রাজধানী... সেই দেশের রাজনীতি একটু ব'লে, গম্ভীর গলায় আমাদের ডেস্কের হেডস্যার পুলকদা হালকা বকা দিতেন। পরে বলতেন- মনে থাকবে তো? পরে যেন ভুল না হয়...।
আর অনুবাদ খবরের কপিটি অমিতদার হাতে পড়লে তো শেষ! মানে অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখবেন। অনেকটা একগাদা উত্তরপত্রের শেষ খাতাটা দেখার সিচুয়েশন। আমি তখনো বয়সে অনেক ছোট, নতুন, মাত্র ছাত্র... এবং ভীতু। অমিতদাকে বাঘের মত ডরাই। পাশে বসে থাকি নিউজটা কারেকশনের সময় অমিত হাবিবের 'খিঁচানো বকা' খাওয়ার অপেক্ষায়। মেরিনা আপা, সুমি আপা, জাকারিয়া সব হৈ হৈ করতে করতে লাঞ্চ ব্রেকে যাওয়ার সময় চোখ দিয়ে আমার ডাকে। আমি চোখে ইশারায় বুঝিয়ে দেই-- আজকে ধরা খাইছি অমিত হাবিবের কাছে, সো দুপুরে বকা খেয়েই পেট ভরে যাবে, তোমরা যাও। আড়চোখে অমিতদা এসব চোখে চোখে কথাবার্তা দেখেও নেন। "একটু টাইট দিলাম মার্কা" হাসি হেসে, মাথা নিচু করে আমার কপিটা দেখতে দেখতে ডিকশনারী দেখতে বলেন। তখনতো আর গুগল ছিলো না... কোনো কোনো শব্দ, দেশের অবস্থান, জামার্ন, ফরাসী উচ্চারন ভেদে কী হতে পারে সবটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য জনে জনে পাঠাতেন আমাকে। যান, পুলকদার কাছে জেনে আসেন, আজফার হোসেন কে জিজ্ঞেস করেন, সাজ্জাদ শরীফকে জিগান গিয়ে...।
শুধু ডিকশনারি ঘাটলেই, যে ভুলটা শুধরে নেয়া যায়, সেটা ১২ জনের কাছ থেকে জেনে নিলে বহুমাত্রিক জানা হয়, এবং তাতে ভবিষ্যতের একজন সংবাদকর্মীর তৈরী হওয়াটা পোক্ত হয়- সে মিশনটাই persuite করতেন অমিত হাবিব। চঞ্চল বয়সী এই আমাদের, এইসব perfectionist বস্ গিরি পছন্দ হবে না, সেটাই স্বাভাবিক। তাই অমিতদা আমাদের কাছে 'ডর'। এই ডর ভয়ের মানুষটি নিজে থেকেই কম করেননি কিছু... যেদিন খুব বকা দিয়েছেন, সেদিনই ঝিগাতলার বাসায় নিজহাতে ডিম ভেজে ভাত খাইয়েছেন, সন্ধ্যা হয়ে গেলে ভাবীসহ রিক্সায় বাড়ি পৌছে দিয়েছেন। গত ৩০ বছরে একসাথে ১ টেবিলে বা একই প্রতিষ্ঠানে অমিতদার সঙ্গে ছিলাম আমি ৯ বছর। তারপর পত্রিকা থেকে broadcast. সেই ডর - এর অমিত হাবিবই বলেছেন,' মুন্নী আপনিতো ভালই করেন টিভি রিপোর্টিং...'। তারপরের বাক্যেই খোঁচা--- আরে এখন তো আপনি স্টার, গোটা দেশের মানুষ আপনারে চেনে, আর আমাদের কী পাত্তা দেবেন!
একসাথে এক টেবিলে এক প্রতিষ্ঠানে কাজ করি আর না- ই করি, অমিতদা কে পাত্তা দিতেই হয়, হয়েছে। শুধু আমি নই, নবনীতা, উৎপল শুভ্র, রঞ্জনা দি, জাকারিয়া এমন আরো অনেকেরই। আমরা সে সময়কার এক টেবিলে আড্ডার, কাজ করার মানুষ এখন আলাদা আলাদা অবস্থানে, আলাদা পরিচিতিতে যতই উজ্জল হইনা কেন... অমিত হাবিব মানে আমাদের 'ডর- বস, ডর - বন্ধু'। এই ডর - পার্ফেকশনের, সৎ সাংবাদিকতা, নির্মোহ জীবনচারিতার আর ভীড়ের মধ্যে সাংবাদিকতার একজন নিভৃত জেমস্ বন্ড অমিত হাবিব হতে পারার।
গত ৩০ বছরে আমরা একসাথে বয়স বাড়িয়েছি, বুড়ো হয়েছি... অনেক আড্ডা, বেড়ানো, তর্ক, রাজনীতি, রান্না খাওয়া হয়েছে। অমিত দা আমাদের বস্ বন্ধু হয়ে উঠছেন, কিন্তু সহজেই তারঁ মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়া যায়- সম্পর্কের সেই গাম্ভীর্যটা ভাঙ্গেনি।
এইতো- করোনার সময় আমার করোনা অভিজ্ঞতা শেয়ার করে অমিত হাবিব কে ফোনে পরামর্শ দেয়া শুরু করলাম। তখন অমিত দা'ও আক্রান্ত। আমি কী আনবো... কোনটা খাবেন, কয়বার গার্গেল করবেন... এসব নিয়ে হরবর করে ফোনে অমিত দা'র ওপর ডাক্তারি করার চেষ্টা করছি, আর ওপ্রান্ত থেকে তাঁর খিঁচানো ধমক ---" পাকামো কইরেন না তো মুন্নী, একটু করোনা হইছে... আর তাতে এক্সপার্ট হয়ে গেছেন! আমার জন্য কিছু আনতে হবে, কিছু পাঠাতে হবে না... আপনি আপনার করোনা দর্শনটা লেখেন, আমাকে পাঠান। দেখি দেশ-রুপান্তরে একটা স্পেশাল কিছু করবো ভাবছি"।
অমিত হাবিব কে এই বুড়ো বয়সেও আমি এতটাই ভয় পাই যে, ভয়ে ভয়ে আমি করোনা নিয়ে লিখেও ফেললাম। আর অমিত দা শুধু পুরো পাতা জুড়ে আমার লেখাটিই ছাপলেন। ছাপানো পত্রিকার পাতাজুড়ে আমার লেখা দেখে আমার ডর মাস্টারকে জিজ্ঞেস করলাম--- পুরোটা ছাপলেন যে! কাইট্টা- ছিল্ল্যা- লবন লাগায়া সুন্দর একটা স্লিম লেখা ছাপবেন দেইখ্যা বড়োসরো ৩ হাজার শব্দ লিখলাম, আপনি দেখি কিছুই করেন নাই... পড়েন নাই লেখাটা অমিতদা? এম্নেই ছাইপা দিলেন!
আর যায় কোথা! কী বিভৎস চিৎকার অমিত হাবিবের...।
আপনি আমাকে ছুঁক ছুঁক করা সাংবাদিক ভাবছেন? চেহার সর্বস্ব ভেটকি মাছ ভাবছেন, পত্রিকাটা সাইনবোর্ড বানিয়ে প্রেসক্লাবে দলবাজি, ক্ষমতাসীন দের তেল দেয়া, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস কনফারেন্সে সামনের চেয়ার নিয়ে টানাটানি করা সম্পাদক ভাবছেন? শোনেন মুন্নী--পত্রিকার প্রতিটি শব্দ- বাক্য - আইডিয়া- কলাম ইঞ্চি নিয়ে সম্পাদক দায়ী। আমার টীম টা ভালো, কিন্তু আমি পারতপক্ষে কোনোকিছু না পড়ে ছাড়ি না...।
সেইদিন আমিও ছাড়িনি অমিতদাকে। সেই সময়ের একটি আলোচিত হত্যাকান্ড নিয়ে, তাঁর নিজের করা একটি শিরোনাম খবর নিয়ে তাকে একহাত নিলাম।
অমিত হাবিবের স্পষ্ট জবাব -" আমাদের পত্রিকায়, ঐ ঘটনাটি নিয়ে পক্ষপাতিত্ব পাঠকের কাছে স্পষ্ট করতে ওই হেডলাইন আমি করেছি, নিউজটা আমি করিয়েছি। "অবিমৃশ্যকারিতা"না করার জন্য ওটা আমার স্ট্যান্ড'।
তর্কে তাঁর সাথে কে পারে? আমরা কখনো কেউ পারিনি, তাই ভয়ও ভাঙ্গেনি। সেই ভয় ভয় দূরত্ব নিয়ে অমিত হাবিব আমাদের গুরু, হেড মাস্টার, বন্ধু। যে বন্ধুটি পরিপূর্ণ জ্ঞানে, সক্রিয় থাকার সময়ে জ্বর দেখার ছলেও মাথায় হাত রাখা হয়নি। তাঁর মা চলে যাওয়ার শোকে সান্তনা দেবার জন্য হয়নি... একটার পর একটা পত্রিকার মালিকপক্ষ তাঁকে ব্যবহার করে পত্রিকা দাঁড় করানোর পর, তাঁকে ছুঁড়ে ফেলায় সহমর্মিতাতা জানানোর জন্যও মাথায় হাত, হাতটা ধরে বলা হয়নি অমিতদা ভয় পেয়েন না, আপনি উঠে দাঁড়াবেন।
৩০ বছর সাংবাদিকতার উচ্চ পদে থেকে, দীর্ঘ সময় ধরে অনেক সংবাদপত্র-- "সম্পাদক" হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেবার পরেও প্রেসক্লাবের সদস্য হতে না পারার আক্ষেপের সময়ও আমরা বলতে পারিনি, অমিতদা সরি!
সেই অমিত'দার মাথায় হাত বোলানোর সময় নার্স-ডিউটি ডাক্তাররা বললো, দিদি আপনি একটু ডাক্ দেন-- চেতন আছে।
"অমিত দা...অমিত দা... আমি মুন্নী"--- ডাকলাম ডাক্তারের পরামর্শে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নার্স মেয়েটি বললো, দিদি মাস্কটা একটু খোলেন, পুরা নামটা বলেন... চেনে কি- না দেখেন...
অরেক বার অমিতদা বলে ডাকতেই ঘুম ভরা চোখে অমিতদা একনজর দেখলেন। বা হাতে আমার হাতটা ধরা। বললাম চাপ দেন, জোরে...। যথেষ্ট জোড়ে হাতটা চেপে ধরলাম। এরপর তাঁর ডান হাতে ধরে, হাতটা দিয়ে বললাম চাপেন। অমিতদা পূর্ণ চেতনায় তখন। ডান হাতে, আমার হাতটা ধরতে পারলেন না--- সেটা তিনি বুঝেও গেলেন। অসহায় চোখে আমার দিকে জিজ্ঞাসার চাহনি---যেন জানতে চাইছেন, আমার ডান দিক?
আমি তার স্নেহের মুন্নী সাহা, যতই ডাক্তারি ভাষায় বলি না কেন, যে আপনি ঠিক হয়ে যাবেন, সেটা উনি মেনে নেয়ার, বিশ্বাস করার লোক নন। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে, অসহায় দূর্বল অবস্থায়ও নন। ঘুমে ঢুলুঢুলে চেতনে, কেমন করে বুঝিয়ে দিতে হয় সে কায়দা অমিতদাই একমাত্র জানেন। তিনি বুঝিয়ে দিলেন-- আমার এ অসহায় -পরনির্ভর - করুনার জীবন আমি মানি না। আমার চোখের সামনেই অভিমানে চোখ বন্ধ করলেন অমিত'দা।
এ অভিমান- ক্ষোভ তারঁ একার নয়, যেন আমাদের অনেকেরই পক্ষ থেকে। আমরা যারা নব্বইয়ের দশকে তারুণ্যের উচ্ছাসে শুধু সৎ- নিরেট শুদ্ধ সাংবাদিকতা করবো বলেই সাংবাদিকতার সাথেই সংসার করেছি বা করছি। যারা মালিকপক্ষ হতে চাইনি, হইনি বা হতে পারিনি। সাংবাদিকতার খাতিরে, বরং বারবার মালিকপক্ষের ঘুঁটি হয়ে ব্যবহৃত হচ্ছি- হয়েছি। তাদের সকলের অসহায়ত্ব এক চাহনি দিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে, অমিত হাবিব চোখ বুজলেন। যেন ধমক দিয়ে বলছেন- দেখলেন তো যৌবনের, পরিশ্রমের, সততার, সবটা,--- এই পত্রিকার ব্লটিং পেপার কেমন করে শুষে নেয়, আর টয়লেট পেপারের মত ছুঁড়ে ফেলে?
বিআরবি হাসপাতালের আইসিইউতে অমিত হাবিবের বেড এর পাশে, আমাদের অনেকের লড়াই এবং পরিনতি মিলিয়ে নিলাম। আসলে নেত্বত্ব বা দেশ না চাইলে, শুধু আমরা ৫/৭ জন চুনোপুটি সাধারন নাগরিক সংবাদপত্র বা মিডিয়ার শুদ্ধতার ব্রতচারি হলে, ব্যক্তিগত জীবনটার অপচয় ছাড়া আর কিছুই হয় না। আর এ অপচয়ের উসুলটা ব্যবসায়ীরা পায়- পেতেই থাকে। তারা পেয়ে যার তাদের অনৈতিকতা পাহারা দেয়ার এলসেসিয়ান মিডিয়া।
অমিত হাবিবের অভিমান ভরা চোখ এবং টুকরো টুকরো স্মৃতিতে ভরা পুরো পরিস্থিতির "একটা দীর্ঘশ্বাস" আইসিইউ তে রেখে এলাম।
বাইরে এসে সোস্যালমিডিয়াতে চোখে পড়লো সুইটির পোষ্ট --- ' উল্লেখ্য দেশ রুপান্তর সম্পাদক অমিত হাবিব এর সার্বিক চিকিৎসার খোঁজ খবর নিচ্ছেন রুপায়ন গ্রুপ, তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো হবে... ব্লা ব্লা... '
এ প্রেসরিলিজ টা বার বার গায়ে লাগছিলো। অমিতদা কি এই গ্রেইস বা অনুগ্রহ ডিসার্ভ করেন? তিনি কি গ্রহন করবেন? নাকি একজন তেজি, হার না মানা, আউট এন্ড আউট নিউজে ডুবে থাকা, দ্রুত হাঁটা, দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারা সম্পাদককে দেখার আমাদের অভ্যস্থ চোখও মেনে নিতে পারবে কারো সাহায্য নিয়ে বেঁচে থাকা, হুইল চেয়ারে বসা অমিত হাবিবকে?
আমার সেসব এলোমেলো মনের প্রশ্নের জবাব অমিত হাবিবই দিয়ে গেলেন। কিভাবে অপ্রোজনীয় হওয়ার গ্লানি না নিয়ে গ্রেইসফুল জার্নি অব্যাহত রাখতে হয়...!
ক্রিকেট প্রিয় অমিত হাবিব, আপনাকে হ্যাটস্ অফ্... ইনিংসটা graceful ছিলো।
(লেখাটি এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী সম্পাদক মুন্নী সাহার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে নেওয়া)