জাহান্নাম হলো পরলোকের এমন একটি বিশাল এলাকা, যেখানে বিভিন্ন ধরনের শাস্তির জন্য ভিন্ন ভিন্ন এলাকা নির্ধারিত আছে। সেগুলোকে প্রধানত সাত ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা—
১. নার তথা আগুন। ২. জাহান্নাম তথা আগুনের গর্ত। ৩. জাহিম তথা প্রচণ্ড উত্তপ্ত আগুন। ৪. সায়ির তথা প্রজ্বলিত শিখা। ৫. সাকার তথা ঝলসানো আগুন। ৬. হুতামাহ তথা পিষ্টকারী। ৭. হাবিয়া তথা অতল গহ্বর।
পবিত্র কোরআন ও হাদিসে জাহান্নামের আগুনের উত্তাপের কিছু বিবরণ দেওয়া হয়েছে। এক আয়াতে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘এটা তো লেলিহান অগ্নি, যা গায়ের চামড়া খসিয়ে দেবে।’ (সুরা মাআরিজ, আয়াত : ১৫-১৬)
অন্য আয়াতে এসেছে, ‘তাদের মাথার ওপর ঢেলে দেওয়া হবে ফুটন্ত পানি, যা দিয়ে তাদের চামড়া ও পেটের ভেতর যা আছে তা বিগলিত করা হবে।’ (সুরা হজ, আয়াত : ১৯-২০)
রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘এক হাজার বছর জাহান্নামকে উত্তপ্ত করা হয়েছে। ফলে তার আগুন রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। অতঃপর পুনরায় এক হাজার বছর উত্তাপ দেওয়ার ফলে এটি সাদা রং গ্রহণ করেছে। তারপর আরো এক হাজার বছর উত্তাপ দেওয়ার ফলে এর আগুন কৃষ্ণবর্ণ হয়ে গেছে। সুতরাং জাহান্নাম এখন সম্পূণরূপে গাঢ় কালো তমসাচ্ছন্ন।’ (তিরমিজি শরিফ)
মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, ‘জাহান্নামের মধ্যে সেই ব্যক্তির শাস্তি সবচেয়ে হালকা হবে, যার পাদুকাদ্বয় ও জুতার ফিতা হবে আগুনের তৈরি। এর ফলে হাঁড়ির মতো তার মস্তিষ্ক ফুটতে থাকবে। সে মনে করবে, তার শাস্তিই সর্বাপেক্ষা কঠিন। অথচ তার আজাবই সর্বাপেক্ষা হালকা।’ (বুখারি ও মুসলিম)
জাহান্নামের আগুনের উত্তাপ কখনো প্রশমিত হবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অতঃপর তোমরা (আজাব) আস্বাদন করো, আমি তো তোমাদের শাস্তি কেবল বৃদ্ধিই করব।’ (সুরা নাবা, আয়াত : ৩০)
অন্যত্র তিনি বলেন, ‘যখনই তা (জাহান্নামের আগুন) স্তিমিত হবে তখনই আমি তাদের জন্য অগ্নিশিখা বৃদ্ধি করে দেব।’ (সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৯৭)
নিম্নে জাহান্নাম থেকে মুক্তির কিছু আমল বর্ণনা করা হলো-
প্রিয় নবীজি (সা.)-এর মাধ্যমে শিখিয়েছেন এমন কিছু আমল, যা মানুষকে খুব সহজে জাহান্নাম থেকে মুক্তির সন্ধান দিতে পারে। জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারে।
দৈনন্দিন তাসবিহ পাঠ
দৈনিক ৩৬০ বার তাসবিহ-তাহলিল, তাকবির আদায় করা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক আদম সন্তানকেই ৩৬০টি গ্রন্থির ওপর সৃষ্টি করেছেন আর প্রতিটি গ্রন্থির কিছু সদকা রয়েছে। সুতরাং যে ব্যক্তি ওই সংখ্যা পরিমাণ ‘আল্লহু আকবার’ বলল, ‘আলহামদু লিল্লাহ’ বলল, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলল, ‘সুবহানাল্লাহ’ বলল, ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ বলল, মানুষের চলার পথ থেকে পাথর, কাঁটা অথবা একটি হাড় সরাল, ভালো কাজের আদেশ করল, কিংবা মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করল (এবং সব মিলিয়ে ৩৬০ সখ্যক পুণ্যময় কাজ করল), সে ওইদিন এ অবস্থায় সন্ধ্যা যাপন করল যে, সে নিজেকে জাহান্নাম থেকে দূরে সরিয়ে নিলো।’ (মুসলিম : ২২২০)
প্রথম তাকবিরে নামাজ
৪০ দিন তাকবিরে উলার সঙ্গে সালাত আদায় করা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে একাধারে ৪০ দিন তাকবিরে উলার (প্রথম তাকবির) সঙ্গে জামাতে নামাজ আদায় করবে আল্লাহ তায়ালা তাকে দুটি তালিকা থেকে মুক্তি দেবেন- ১. জাহান্নামিদের তালিকা থেকে মুক্তি ২. মুনাফিকদের তালিকা থেকে মুক্তি।’ (তিরমিজি : ২৪১)
গীবতমুক্ত জীবনযাপন করা
প্রিয় নবী সা: ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি তার (মুসলিম) ভাইয়ের সম্ভ্রম রক্ষা করে, কিয়ামতের দিবসে আল্লাহ তায়ালা তাকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করবেন (তিরমিজি : ১৯৩১)।
বেশি বেশি দান-সদকা
দান-সদকা বিপদ-মুসিবত দূর করে। আল্লাহর অসন্তুষ্টি দূর করে। জাহান্নামের আগুন দূর করে। তাই প্রতিদিন অল্প করে হলেও দান-সদকা করা উচিত। আদি ইবনে হাতেম (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী কারিম (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘তোমরা জাহান্নাম থেকে বাঁচো; যদিও এক টুকরো খেজুর সদকা করে হয়।’ (বুখারি : ১৪১৭)
জাহান্নাম থেকে মুক্তির দোয়া
জাহান্নামের শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য ইবাদত-আমলের পাশাপাশি দোয়া করা চাই। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি তিনবার আল্লাহ তায়ালার কাছে জান্নাত প্রার্থনা করে, জান্নাত তখন বলে, হে আল্লাহ! তাকে জান্নাতে প্রবেশ করান। আর যে ব্যক্তি তিনবার আল্লাহর কাছে জাহান্নাম থেকে মুক্তি চায়, জাহান্নাম তখন আল্লাহ তায়ালার কাছে বলে, হে আল্লাহ! তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিন। (তিরমিজি : ২৫৭২)
জোহর-আসরের আগে নফল
প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের আগে-পরে কিছু সুন্নত নামাজ রয়েছে। গুরুত্বের সঙ্গে নামাজগুলো আদায় করলে পরকালের শাস্তি থেকে বাঁচা সহজ হবে ইনশাল্লাহ। জোহরের ফরজ নামাজের আগে চার এবং পরে চার রাকাত নামাজ আদায় করলে এ সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি জোহরের আগে চার রাকাত এবং পরে চার রাকাত সালাত পড়বে, মহান আল্লাহ তার জন্য জাহান্নাম হারাম করে দেবেন।’ (ইবনে মাজা : ১১৬০)
মানুষের সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার
পৃথিবীর সব মানুষকে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি যে সদাচারী হবে, আল্লাহ তার প্রতি খুশি হবেন। তাকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হবে। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আমি কি তোমাদের জানিয়ে দেব না কোন ব্যক্তির জন্য জাহান্নাম হারাম এবং জাহান্নামের জন্য কোন ব্যক্তি হারাম? যে ব্যক্তি মানুষের কাছাকাছি (জনপ্রিয়) সহজ-সরল, নম্রভাষী ও সদাচারী। (তিরমিজি : ২৪৮৮)
চোখের হেফাজত
মানুষের পাপের বড় একটি উৎস চোখ। যে ব্যক্তি চোখের হেফাজত করল সে যেন পাপের একটি উৎস বন্ধ করল। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, জাহান্নামের আগুন দুটি চোখকে স্পর্শ করবে না- ১. আল্লাহ তায়ালার ভয়ে যে চোখ ক্রন্দন করে। ২. আল্লাহর রাস্তায় যে চোখ পাহারা দিয়ে রাত পার করে। (তিরমিজি : ১৬৩৯)
বেশি বেশি নফল রোজা
রোজা সারাবছরই রাখা যায়। রোজা এমন একটি আমল, যা মানুষকে দেখানোর চেয়ে আল্লাহকে দেখানোর কাজ বেশি। আল্লাহর ভয়ে কৃত এমন আমল জাহান্নামের ঢাল হিসেবে বিবেচিত। প্রিয়নবী (সা.) বলেন, ‘রোজা (জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার জন্য) ঢালস্বরূপ।’ (বুখারি : ১৮৯৪)। রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে এক দিন রোজা রাখবে, আল্লাহ তায়ালা ওই এক দিনের বিনিময়ে তার থেকে জাহান্নামকে ৭০ বছর (পরিমাণ পথ ) দূরে রাখবেন। (বুখারি : ২৮৪০)
কন্যাসন্তান লালন-পালন
কন্যাসন্তান মা-বাবার জীবনে আশীর্বাদস্বরূপ। তারা পৃথিবীর বরকত ও আখেরাতের সম্পদ। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ভিখারিণী দুটি কন্যা সঙ্গে করে আমার কাছে এসে কিছু ভিক্ষা চাইল। আমার কাছে একটি খেজুর ছাড়া আর কিছু ছিল না। আমি তাকে তা দিয়ে দিলাম। খেজুরটি সে দুভাগ করে কন্যা দুটিকে দিয়ে দিল। তা থেকে সে নিজে কিছুই খেল না। এরপর সে উঠে বের হয়ে গেল। তারপর নবীজি আমাদের কাছে এলে তাকে ওই ঘটনা শোনালাম। ঘটনা শোনে তিনি বললেন, যে ব্যক্তি একাধিক কন্যা নিয়ে সঙ্কটাপন্ন হবে এবং সে তাদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে। সে কন্যাসন্তান তার জন্য জাহান্নামের আগুন হতে অন্তরাল (পর্দা) হবে। (বুখারি : ১৪১৮)
আল্লাহ মানুষকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন পরকালের জীবনের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য। এখানে যারা আমল করবে তাদের জন্য পরকালের চিরস্থায়ী জীবনে জান্নাত ও আমল না করলে জাহান্নাম।
কিন্তু মানুষ আল্লাহর অবাধ্যতা ও পাপাচার দ্বারা নিজের শুভ্র-সফেদ জীবনটাকে কয়লার মতো কালো বানিয়ে ফেলেছে। পাপের পথে দিবানিশি চলতে চলতে প্রতিনিয়ত জাহান্নামের নিকটবর্তী হয়ে চলেছে। শ্রেষ্ঠ জীব থেকে অতি নিকৃষ্ট জীবে পরিণত হয়ে যায় পাপের কালিমা মেখে। এ সত্ত্বেও মহান আল্লাহ মানুষকে সুযোগ দেন কয়লা ধুয়ে পরিষ্কার করার, জাহান্নাম থেকে মুক্তির উপায় করে নেওয়ার।