গত ১৫ বছরে ১০০ কোটি টাকা হাতিয়ে দেশে ছেড়ে কানাডায় চলে গেছেন তিনি। নিয়োগ ও তদবির ‘বাণিজ্য’ করে এই বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়েছেন। কানাডার টরন্টোতে বেগমপাড়াখ্যাত এলাকায় কিনেছেন ডুপ্লেক্স বাড়ি। যার কথা বলা হচ্ছে তিনি হলেন বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবদুল খালেক। বেবিচক ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে খালেকের সপরিবারে কানাডায় চম্পট দেওয়াসহ নানা তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, ২০০৪ সালের ৮ আগস্ট স্টেনোগ্রাফার পদে চাকরি পেতে আবেদন করেন আবদুল খালেক। আবেদনের কিছুদিন পরই হয়ে যায় তার চাকরি। চাকরিটি হয় অর্থ ও তদবিরের বিনিময়ে। এ সময় তার পড়াশোনা ছিল এইচএসসি পর্যন্ত। চাকরির এক বছরের মাথায় তিনি নানা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। একসময় স্নাতকোত্তর পাস করেন এবং পদোন্নতি বাগিয়ে হয়ে যান প্রশাসনিক কর্মকর্তা। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। বেবিচকে গড়ে তোলেন নিয়োগ ও তদবির বাণিজ্যের বিশাল চক্র।
ছয় মাস আগে অসুস্থতার কথা বলে পরিবারসহ পালিয়ে যান কানাডায়। এমনকি তার অফিসের ড্রয়ারে পাওয়া গেছে ১৫ লাখ ৬৬ হাজার টাকার পে-অর্ডার।
আবদুল খালেকের বিরুদ্ধে নিয়োগবাণিজ্যসহ নানা অভিযোগ ওঠায় গঠন করা হয়েছে তদন্ত কমিটি। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ইতিমধ্যে তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাও হয়েছে। তদন্ত কমিটি তাকে পলাতক উল্লেখ করে গত ১৯ জুলাই একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে বেবিচক চেয়ারম্যানের কাছে। তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে বেবিচক আন্তর্জাতিক পুলিশের সংস্থা ইন্টারপোলের সহায়তাও চাইতে পারে বলে জানা গেছে।
জানতে চাইলে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান গতকাল মঙ্গলবার বলেন, ‘প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবদুল খালেকের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ এসেছে। অভিযোগগুলো পেয়ে আমরা অনেকটা হতভম্ব ও বিব্রত। তিনি ছুটির নাম করে কানাডায় চলে গেছেন। এখন শুনছি তিনি সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। ছয় মাসের বেশি সময় ধরে তিনি অনুপস্থিত। বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘খালেকের সঙ্গে আর কারা কারা জড়িত আছে তাদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে।’
বেবিচকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, আবদুল খালেক চাকরি জীবন থেকেই নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। চাকরিও পান তদবির ও অর্থের জোরে। প্রশাসনিক কর্মকর্তা হওয়ার পর তার দৌরাত্ম্য আরও বেড়ে যায়। বিভিন্ন সময়ে তিনি টাকা নিয়ে নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি করে কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরি দিয়েছেন। গত এক মাস ধরে অনেকে খালেকের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ নিয়ে আসছেন। চাকরির নাম দেওয়ার কথা বলে অনেকের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, বেবিচকের বিভিন্ন শাখায় অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়োগ পরীক্ষায় একেক প্রার্থীর কাছ থেকে ১৫ লাখ থেকে শুরু করে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়েছেন তদন্তে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। তাছাড়া তিনি বদলির তদবিরও করতেন। তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে তারা নিশ্চিত হয়েছেন এসব অপকর্ম করে অন্তত ১০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন খালেক। ওইসব অর্থ দিয়ে টরেন্টোতে একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি কেনা ছাড়াও দেশে নামে-বেনামে প্রচুর সম্পদ গড়েছেন।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, চলতি বছরের ১৬ জুন আবদুল খালেকের অফিসের টেবিলের ড্রয়ার থেকে ৭ হাজার ৮৩০টি পে-অর্ডার উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার হওয়া পে অর্ডারের মুল্য ১৫ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। ২০১৭ সালে ২০ ক্যাটাগরি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির পরিপ্রেক্ষিতে প্রাপ্ত আবেদনের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল ওইসব পে-অর্ডার। ওই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির আবেদনগুলোর যাচাই-বাছাই কমিটিতে সদস্য সচিবও ছিলেন আবদুল খালেক। তিনি আবেদনপত্রগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত ওই পে-অর্ডার অর্থ বিভাগে না পাঠিয়ে অরক্ষিত অবস্থায় নিজের কাছে দুই বছর ধরে রেখে দিয়েছিলেন। এ অভিযোগে তাকে বেবিচকের সদর দপ্তরে হাজির হয়ে কারণ দর্শানো ও ব্যাখ্যা তলব করে নোটিস জারি করা হয়।
বেবিচকের প্রশাসন শাখার এক কর্মকর্তা গত সোমবার জানান, অভিযুক্ত আবদুল খালেক আত্মসাতের উদ্দেশ্যেই পে-অর্ডারগুলো নিজের কাছে লুকিয়ে রেখেছিলেন। বিভিন্ন সময়ে বেবিচকে নিয়োগ পরীক্ষা হয়েছিল। তার মধ্যে অর্থ বিভাগ, আইটি বিভাগ, এটিএম বিভাগ, এফএসআর বিভাগ, এভিয়েশন একাডেমি, পরিকল্পনা, উন্নয়ন ও মনিটরিং বিভাগ, প্রকৌশল বিভাগ, প্রশাসন বিভাগ, ফায়ার কন্ট্রোল বিভাগসহ কয়েকটি বিভাগে ১ হাজার ৬২০ জনের নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। এসব নিয়োগে প্রার্থীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন বলে তারা নিশ্চিত হয়েছেন।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, খালেকের বাবার নাম আবদুর রহমান, মায়ের নাম সায়েরা খাতুন, গ্রামের বাড়ি কক্সবাজারের বাহারছড়া। থাকতেন কাওলা স্টাফ কোয়ার্টারে। তার স্ত্রী শায়কা জামাল। সাকশান কে রহমান ও সুশান কে রহমান নামে খালেকের দুই সন্তান রয়েছে। ২০১৯ সালের ৪ সেপ্টেম্বর একটি নিয়োগ পরীক্ষার জালিয়াতির অভিযোগে বিভাগীয় মামলা হয়েছিল তার বিরুদ্ধে। চলতি বছর আরেকটি বিভাগীয় মামলা হয়েছে।
বেবিচক সূত্র জানায়, চাকরি দেওয়ার নাম করে সাড়ে ৭ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে গত ৭ জুন বেবিচক চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন তানজিমুল ইসলাম রিফাত, রিদুয়ানুল ইসলাম, মোস্তাকিম তানভীর নামে তিন ভুক্তভোগী। তাদের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের বাকলিয়ায়। তারা অভিযোগ করেন, ২০১৯ সালের ১৫ ও ১৭ অক্টোবর পাঁচটি চেকের মাধ্যমে একটি ব্যাংকে ওই টাকা দেওয়া হয়। কিন্তু চাকরি না দিয়ে খালেক আরও টাকা দাবি করেন। টাকা না দেওয়ায় চাকরি হবে না বলে তাদের জানিয়ে দেন। এ অভিযোগ আসার পর একটি তদন্ত কমিটি করা হয়। কমিটির প্রধান কর্মকর্তা সিভিল এভিয়েশন একাডেমির পরিচালক প্রশান্ত কুমার চক্রবর্তী। তদন্ত কমিটি নিশ্চিত হয়, দুই মাসের ছুটি নিয়ে খালেক কানাডায় পালিয়ে গেছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, খালেক তার স্ত্রীর বড় ভাইকে দেখতে দুই মাসের ছুটি নিয়ে গত বছর ৮ নভেম্বর কানাডায় যান। কিন্তু ছুটি শেষে তিনি আর দেশে ফেরেননি। কানাডায় যাওয়ার পর অসুস্থ হয়ে পড়েন উল্লেখ করে গত ১০ জানুয়ারি খালেক একটি অবগতিপত্র পাঠান সদর দপ্তরে। কিন্তু ওই পত্রের সঙ্গে কোনো ডাক্তারি সনদপত্র বা প্রামাণিক দলিলাদি সংযুক্ত করেননি। পরবর্তী সময়ে অসুস্থতার বিষয়ে নতুন করে কর্তৃপক্ষকে কিছু না জানিয়ে কর্মস্থলে অনুপস্থিত আছেন।
অভিযোগকারী তানজিমুল ইসলাম রিফাত জানান, নিয়োগ পরীক্ষার আবেদন জমা দিতে এসে খালেকের সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি চাকরি দিতে পারবেন বলে নিশ্চিত করেন। পরে তাকে টাকা দেওয়া হয়। গত নভেম্বর মাস থেকে তাকে আর পাওয়া যায়নি। তার আশকোনায় বাসায়ও গেছেন তারা। প্রতিবেশীরা তাদের জানিয়েছেন, স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে খালেক কানাডায় পালিয়ে গেছেন। সূত্র: দেশ রূপান্তর