ঘর পাওয়া মানুষের মুখের সেই হাসিই জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বৃহস্পতিবার (২১ জুলাই) সকালে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে ভূমিহীন-গৃহহীন আরও ২৬ হাজার ২২৯টি পরিবারকে পাঁচটি আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধীনে ঘর হস্তান্তর অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এ মন্তব্য করেন। এসময় তিনি উপকারভোগীদের কাছে ঘরগুলো হস্তান্তরে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও কর্মকর্তাদের অনুমতি দেন। ঘর হস্তান্তরের মাধ্যমে পঞ্চগড় ও মাগুরা জেলার সব উপজেলাসহ দেশের ৫২টি উপজেলা ভূমিহীন ও গৃহহীনমুক্ত হওয়ার ঘোষণাও দেন প্রধানমন্ত্রী।
এসময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটা ঘর একটা মানুষের জীবন পাল্টে দেয়। ঘর পাওয়া মানুষের মুখের সেই হাসিই জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া, এরচেয়ে বড় কিছু আর হতে পারে না।
তিনি আরও বলেন, আশ্রয়ণ একটি মানুষের ঠিকানা। জীবন-জীবিকার একটি সুযোগ, বেঁচে থাকা, স্বপ্ন দেখা এবং তা বাস্তবায়ন করার। যে বাংলাদেশ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন, সে বাংলাদেশের কোনও মানুষ যেন ঠিকানাবিহীন না থাকে, তাদের জীবনটা যেন অর্থহীন হয়ে না যায়, তাদের জীবনটা যেন সুন্দর হয়, সেই লক্ষ্য নিয়েই এই উদ্যোগটা সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুই নিয়েছিলেন।
সরকার প্রধান বলেন, ১৯৭০ সালের ১৪ নভেম্বর যখন ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় হয় তখন নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছিল। সে নির্বাচনের কাজ ছেড়ে দিয়ে জাতির পিতা পৌঁছে গিয়েছিলেন দুর্গত মানুষে পাশে। ভোলা, পটুয়াখালীসহ অনেক জায়গায় গিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ালেন, দেখেছেন মানুষের দুর্দশা। তারপর থেকেই দুর্যোগ মোকাবিলায় তাঁর চিন্তা-ভাবনা ছিল। একাত্তর সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি সেই চিন্তার বাস্তবায়ন করেছিলেন। ভূমিহীন মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেন। সিদ্ধান্ত নেন খাস জমি ভূমিহীনদের মাঝে বিতরণ করার। ১০০ বিঘার উপর কেউ জমি রাখতে পারবে না ভূমি ব্যবস্থাপনায় এমন নীতি গ্রহণ করেন। তাদের বাড়তি জমি খাস জমি হয়ে যাবে। এসব জমি ভূমিহীনদের মাঝে বিতরণ করার সিদ্ধান্ত তিনি এবং তা বাস্তবায়ন শুরু করেন। দুর্ভাগ্য যে, সেটা তিনি শেষ করে যেতে পারেননি।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করেই আজকে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। তৃতীয় বার সরকার গঠনের পর আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমরা গৃহহীনদের সেমি-পাকা বাড়িঘর করে দেবো। এবং দুই কাঠা জমি সকলের নামে কিনে দেবো। এই জমি কেনার জন্য, কিছু জমি খাস জমি উদ্ধার করা, পাশাপাশি যেখানে খাস জমি পাওয়া যাচ্ছে না, সেখানে যেন জমি কিনে দেওয়া যায় তার জন্য একটি ফান্ড তৈরি করি। প্রয়োজনে আমরা জমি কিনে প্রকল্পের মাধ্যমে এখন ঘর তৈরি করে দিচ্ছি।' এসময় প্রধানমন্ত্রী এই ফান্ডে যারা অনুদান দিয়েছেন তাদের ধন্যবাদ জানান।
তিনি আরও বলেন, এবারে তৃতীয় পর্যায়ের দ্বিতীয় ধাপে আমরা ২৬ হাজার ২২৯টি ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারকে স্থায়ীভাবে মাথা গোঁজার ঠিকানা দিতে পারছি বলে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করি।' এই কাজের সাথে যারা সম্পৃক্ত তাদের সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, ইতোমধ্যে আমরা ৯ লাখ ২৫ হাজার ৬৪৫ জন ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষকে তাদের নিজস্ব ঘরে বসবাস করার সুযোগ করে দিতে পেরেছি। আমরা চাই এই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের কোনও মানুষ যেন আর ছিন্নমূল না থাকে। সে ব্যবস্থাই আমরা নেব, সেটাই আমাদের লক্ষ্য। সে লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আশ্রয়ণ প্রকল্প শুরু হওয়ার পর মোট ৫ লাখ ৯ হাজার ৩৭০টি পরিবারের পুনর্বাসন হয়েছে। ১৯৯৭ সালে আমরা পুনর্বাসনের যে কাজ শুরু করেছিলাম তা হিসাব করলে এ পর্যন্ত আমরা ৭ লাখ ১১ হাজার ২৬৩টি পরিবারকে ঘর তৈরি করে দিয়েছি। প্রতি পরিবারে ৫ জন হিসাবে ঘরগুলোতে মোট আশ্রয় পেয়েছেন ৩৫ লাখ ৫ হাজার ৩১৫ জন। এর পাশাপাশি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়, ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়, তাছাড়া সচিবরা উদ্যোগ নিয়ে দিয়েছে, পুলিশবাহিনী, সেনাবাহিনীসহ সমাজের অনেক মানুষ গৃহহীনদের ঘর বানিয়ে দেওয়ায় এগিয়ে এসেছেন। ফলে আমি বিশ্বাস করি, এ দেশে কোন মানুষ গৃহহীন থাকবে না।
উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার চর পোড়াগাছা ইউনিয়নে নদীভাঙনে ক্ষতিগস্ত ২১০টি পরিবারকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে প্রতিটি পরিবারকে ২.৫ একর করে ভূমি বন্দোবস্ত প্রদান করে ছিন্নমূল ও অসহায় মানুষের পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু করেন। এখন বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত এই ইউনিয়নে কলাকোপা আশ্রয়ণ প্রকল্পে ৫.১৫ একর অবৈধ দখল উদ্ধারকৃত জমিতে নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত জেলে, ভিক্ষুক, বিধবা ও অসহায় ১৪২৫ পরিবারকে পুনর্বাসন করা হচ্ছে।
একইভাবে সারাদেশে ‘আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প’র মাধ্যমে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের পুনর্বাসন করছে সরকার। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা- ‘বাংলাদেশের একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না।’
এরই মধ্যে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে সারাদেশে ৫ লাখ ৯ হাজার ৩৭০ পরিবারকে ভূমি ও সেমিপাকা ঘর করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্বাহী সেলের মাধ্যমে ৭ হাজার ৮০৯ পরিবার, ভূমি মন্ত্রণালয় ৭২ হাজার ৪৫২ পরিবার, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ৪ হাজার ২৩৭ পরিবার, বাংলাদেশের গৃহায়ণ তহবিল থেকে ৮৮ হাজার ৭৮৬ পরিবার এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ২৮ হাজার ৬০৯ পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। এভাবে সারাদেশে মোট ৭ লাখ ১১ হাজার ৬৩ পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে।