রাজধানীর ফার্মগেটে খামারবাড়ি। সরকারের কৃষি-সংক্রান্ত বহু প্রকল্পের কেন্দ্র। এই দপ্তরগুলো কয়েক মাস ধরে অন্যরকম মুখর। ইউরোপে নেদারল্যান্ডসের আলমেয়ার শহরে চলছে আন্তর্জাতিক হর্টিকালচার বা উদ্যানতাত্ত্বিক প্রদর্শনী। ১৪ এপ্রিল থেকে ৯ অক্টোবর পর্যন্ত; নাম 'ফ্লোরিয়েড এক্সপো-২০২২'। এই মেলা ঘিরে খামারবাড়িতে ধুন্ধুমার আলোচনা। কে নেদারল্যান্ডস যাচ্ছেন, কার নামে বিদেশ সফরের সরকারি আদেশ (জিও) জারি হলো- কর্মকর্তাদের কক্ষে কক্ষে এমন কথাবার্তার ঢেউ। মেলা দেখতে মন্ত্রণালয়, দপ্তর ও সংস্থা থেকে ১৫০ জনের তালিকা করা হয়। অন্তত ১০০ কর্মকর্তা ঘুরেও এসেছেন। একা নন, কেউ উড়াল দিয়েছেন স্ত্রীকে নিয়ে, আবার কারও সফরসঙ্গী ছিলেন স্বামী। অনেকে সেনজেন ভিসার সুযোগে ঘুরে এসেছেন অন্য দেশ।
করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পর কৃষি মন্ত্রণালয় ও সংশ্নিষ্ট দপ্তরগুলো থেকে বিদেশ সফরে যাওয়ার ধুম পড়ে। এখন চলছে নেদারল্যান্ডস যাওয়ার মাতামাতি। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বন্ধের পরিপত্র জারির পরও ফাঁকফোকরে ভ্রমণ বন্ধ নেই কর্মকর্তাদের। ছোট-বড় প্রায় সব প্রকল্পেই রাখা হয়েছে বিদেশ সফরের সুযোগ। কখনও প্রশিক্ষণের নামে, কখনও মেলা কিংবা আনারস দেখতে, আবার কখনও মসলা চাষ শিখতে বিলাসী ভ্রমণে যাচ্ছেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। অপ্রয়োজনেও ভ্রমণে ছুটছেন অনেকে। বিদেশ যেতে কর্মকর্তারা লেগে আছেন তদবিরে। এসব সফরে সরকারি ভান্ডার থেকেও খরচ হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। অনেক ক্ষেত্রে সরকারি বরাদ্দ না থাকলেও ভ্রমণ থেমে নেই, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের টাকায়ও বিদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন কেউ কেউ।
সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কৃষি মন্ত্রণালয়ের শতাধিক কর্মকর্তা নেদারল্যান্ডস সফর করেছে। সেখানে কৃষি মন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কর্মরত মাকসুদুল হাসান মাসুদ মাসে ১৬ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেও নিজ তথ্য গোপন করে ঠিকাদার হিসেবে নিজ মালিকানায় মেয়ের নামে মের্সাস নামিরা এন্টারপ্রাইজ, কালিপুর ধনবাড়ী, টাঙ্গাইল পরিচয়ে নেদারল্যান্ডস সফর করছেন, যা তার নিয়োগর সাথে সাংঘর্ষিক। তিনি নামিরা এন্টারপ্রাইজ লাইসেন্স দিয়ে কুমিল্লার পিডি ও বিএডিসির ইসিএইচডিপি’র পিডি থেকে নিয়মিত কাজ করে আসছে। মন্ত্রীর পিএ হিসেবে সরকারের বেতনভুক্ত কর্মচারী হয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ে ব্যবসা করার এখতিয়ার কি তার আছে? এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন খোদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
নিজের নামে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান করে নিজ মন্ত্রণালয়ে কাজ করে বা টেন্ডারবাজি করে কৃষি মন্ত্রীকেও বিশেষ সুবিধা দিচ্ছেন এই মাকসুদ। এলাকার লোকজন কাছে পিএ মাকসুদ মন্ত্রীর ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত। এর আগেও বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় অন্য মিডিয়ায় তার সম্পর্কে লেখা-লেখি হলেও মন্ত্রী মহোদয়ের ছত্র-ছায়ায় তিনি তার একছত্র আধিপত্য বিস্তার করে চলছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাকসুদের বাসা ইস্টার্ন সার্কিট হাউজ-৩০, সার্কিট হাউজ রোড ঢাকা, বাসা ভাড়া ৫০ হাজার টাকা। এক মাত্র কন্যা নামিরা পড়া লেখা করে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল: কিডস টিউটোরিয়াল। সেখানে ১০ লাখ টাকা দিয়ে ভর্তি করানো হয়েছে। তার বিলাসবহুল জীবন-যাপন, প্রায়ই বিদেশ ভ্রমণ, গাড়ী-বাড়ী, নিজস্ব ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মন্ত্রণালয়ের একক আধিপত্যের কারণে এলাকার সবাই তাকে প্রতি-মন্ত্রী হিসেবে জানেন।
মিরপুরের ১২ নম্বর শাড়িপাট্টির পাশে ৮তম তলা বিশিষ্ট দুইটি বাড়ি, টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীতে শ্বশুরের নামে তিন কোটি টাকার বাড়ি করেছেন মাকসুদ। নিজ গ্রাম মুশুদ্দি ও শ্বশুর বাড়ি ধনবাড়ীর কালিপুরে প্রায় ৫০ একর জমি ক্রয় করেছে।
উল্লেখ্য, মাসুদের বড় ভাই বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের আশরাফুল হক হল ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সহ-সভাপতি ছিল। আরেক ভাই ও বোন’কে প্রক্সি দিয়ে খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ দিয়েছে, যা দুদকে তদন্তাধীন অবস্থায় রয়েছে।
এদিকে গত আট মাসে সবচেয়ে বেশি বিদেশ সফর করেছেন বিএডিসি ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। গেল নভেম্বর থেকে বুধবার পর্যন্ত কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে ৭৭টি জিও হয়েছে। এই জিওর অনুকূলে ৩৩২ জনের বিদেশ সফরের আদেশ হয়েছে। এর মধ্যে দেশে ডলার সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১২ মে বিদেশ সফর বন্ধে অর্থ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারির পরও আরও ৩০টি জিও হয়। এই জিওর অনুকূলে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি পান ১১৪ জন। সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা ব্যবসায়ীদের নামও রয়েছে এ তালিকায়। বিশেষ করে নেদারল্যান্ডস সফরে সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিক বা কর্তাব্যক্তিদের নিয়ে যাওয়ার ঘটনা বেশ আলোচিত।
জিও অনুযায়ী কৃষি মন্ত্রণালয়, বিএডিসি ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাসহ সংশ্নিষ্টরা নেদারল্যান্ডস, ইতালি, জার্মানি, জাপান, তুরস্ক, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, নেপাল, আমেরিকা, মালয়েশিয়া, মিসর ও দক্ষিণ কোরিয়া সফর করেছেন। এখনও চলেছে সফর।
বিএডিসির সফরের ক্ষেত্রে বেশিরভাগই প্রাইভেট কোনো কোম্পানির অর্থায়নে কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের কথা উল্লেখ করা হয়েছে জিওতে। বিভিন্ন ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্পের সুবিধাভোগী কোম্পানির টাকায় তাঁরা সফর করেছেন। এর মধ্যে সোলার ল্যান্ড বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেড থেকে দুটি, সুপারস্টার রিনেবল এনার্জি লিমিটেড থেকে চারটি, সিগমা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড থেকে দুটি এবং বি. ট্রাক ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড থেকে দুটি সফরের খরচ বহনের কথা বলা হয়েছে জিওতে।
এ ব্যাপারে কৃষি সচিব মো. সায়েদুল ইসলাম বলেন, 'দেশের কৃষিকে বিশ্বজুড়ে তুলে ধরার জন্য নেদারল্যান্ডসের মেলা বিশাল সুযোগ। মেলায় ধাপে ধাপে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা গেছেন, যাবেন। সেখানে এত কর্মকর্তা যাওয়ার কারণ, মেলায় অনেক কাজ থাকে। নিয়মিত গাছে পানি দিতে হয়। কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। মেলায় আমাদের স্টলের জন্য অনেক কিছু সংগ্রহ করতে ইউরোপের দেশে যাওয়ার দরকার হয়। এমন কাজে কেউ কেউ নেদারল্যান্ডসের বাইরে যেতে পারেন।'
আনারস এনে দেশে চাষের পর আবার বিদেশ সফর কেন- এমন প্রশ্নে সচিব বলেন, 'মাত্র তো এমডি-২ জাতের আনারসের চাষ শুরু হয়েছে। এর পরিচর্যা, কালচারাল অপারেশন, এটা থেকে নতুন চারা তৈরি এবং টিস্যু কালচারের কিছু বিষয় রয়েছে, সেগুলো দেখে আসবেন তাঁরা।' ঠিকাদারের টাকায় বিদেশ সফরের ব্যাপারে সচিব বলেন, 'ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তির আগে বিদেশ সফরে খরচ বহনের কথা উল্লেখ করা থাকে।'