সদ্যবিদায়ী অর্থবছরে সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দরের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৯৫৪ কোটি টাকা। এর বিপরীতে আদায় হয়েছে ৭৪১ কোটি টাকা। সে হিসাবে বন্দরটিতে ঘাটতি ২১৩ কোটি টাকা। অথচ সেই বন্দরেই সিরিয়াল দেয়ার নামে চলছে রমরমা চাঁদাবাজির ‘ব্যবসা’। স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ এবং সিঅ্যান্ডএফ মিলেমিশেই এ চাঁদা আদায় করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। দৈনিক ভোরের পাতার সরেজমিন অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে চাঁদাবাজির পুরো চিত্র। যদিও স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ ও নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় বলছে, চাঁদাবাজির অভিযোগ তাদের কাছেও এসেছে। ঈদের ছুটির পরই এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
উল্লেখ্য, যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল তা পূরণ করতে পারেনি সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২১৩ কোটি টাকা ঘাটতি দেখা গেছে। তবে ‘চাঁদাবাজির লক্ষ্যমাত্রা’ পূরণে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন খোদ সিঅ্যান্ডএফের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক।
সদ্যবিদায়ী অর্থবছরে ভোমরা স্থলবন্দরের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৯৫৪ কোটি টাকা। এর বিপরীতে আদায় হয়েছে ৭৪১ কোটি টাকা। সে হিসাবে বন্দরটিতে ঘাটতি ২১৩ কোটি টাকা। দিন দিন রাজস্ব কমে আসার কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম ও চাঁদাবাজির কথা। আর এসব অভিযোগের তীর সিঅ্যান্ডএফের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে।
ব্যবসায়ী আব্দুল গফুর বলেন, ‘এলসি করা ট্রাক বাংলাদেশে ঢুকতে সিরিয়ালের নামে চাঁদাবাজি হচ্ছে ঘোজাডাঙ্গায়। ৩০ হাজার টাকা না দিলে ট্রাক আটকে রাখা হয় দিনের পর দিন।
ব্যবসায়ীরা বলছেন প্রতিদিন চাঁদাবাজির কয়েক লাখ টাকা পেতে দুই কোটি টাকা খরচ করে চেয়ারে বসেছেন বর্তমান সিঅ্যান্ডএফ কমিটির সভাপতি কাজী নওশাদ দিলওয়ার রাজু ও সাধারণ সম্পাদক এস এম মাকসুদ খান।
তারা বলেন, গত (১৫ মে) বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় একতরফা পাতানো নির্বাচনে জয়লাভ করেন রাজু ও মাকসুদ খানের নেতৃত্বাধীন ৯ সদস্যের কমিটি। নির্বাচনে প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও সাংবাদিক নামধারী সংশ্লিষ্টদের দুই কোটি টাকা দিয়ে ‘ম্যানেজ’ করে করা হয় এই কমিটি। যে টাকার একটি বড় অংশ দিয়েছেন স্বর্ণ চোরাকারবারি খ্যাত স্থানীয় এক ব্যবসায়ী নেতা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিঅ্যান্ডএফের এক নেতা বলেন, বর্তমান কমিটির অধিকাংশ সদস্যদের মতামত না নিয়ে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। দায়িত্ব গ্রহণের পর দুইবার বিদেশ ভ্রমণও করেছেন তারা। দুবারই চাঁদাবাজির ভাগবাটোয়ারা নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। আলোচনায় মধ্যস্থতা করেন পশ্চিমবঙ্গের বসিরহাটের কুখ্যাত চোরাকারবারি বারিক বিশ্বাস (৪২)।
এদিকে, নির্বাচনে প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি এমনকি স্থানীয় কিছু নামধারী সাংবাদিকসহ সংশ্লিষ্টদের দুই কোটি টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে করা হয় এই কমিটি। যার একটি বড় অংশ দিয়েছেন স্বর্ণ চোরাকারবারি খ্যাত সাতক্ষীরা জেলা যুবদলের সভাপতি ও ব্যবসায়ী নেতা। যাকে নিয়ে গোয়েন্দা সংস্থা মাঠে নেমেছে।
ভারতের গণমাধ্যম বলছে একসময় বারিকের পেট চলত গাড়ি ধুয়ে। খালাসি হিসেবে খেটে। এখন রাজ্যজুড়ে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি করে বসে আছে বসিরহাটের আব্দুল বারিক বিশ্বাস। গত দুই দশকের মধ্যে সামান্য গাড়ি সাফাইয়ের কর্মী থেকে তার এই ‘উত্থান’ রূপকথার মতোই ঠেকেছে গোয়েন্দাদের কাছেও। অথচ, ধরা পড়ার আগ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে এ রাজ্যে কোথাও কোনো লিখিত অভিযোগও হয়নি। বারিক বিশ্বাস মূলত সোনা, গরু, অস্ত্র চোরাকারবারি হিসেবে পরিচিত।
ভোমরা সিঅ্যান্ডএফের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জি এম আমির হামজা জানান, চাঁদাবাজির কারণে ব্যবসার পরিবেশ নষ্ট হওয়ায় ভোমরা বন্দর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। তা ছাড়া সিঅ্যান্ডএফের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নিজেদের ইচ্ছামাফিক চলায় ব্যবসায়ীদের উন্নয়নে কোনো কাজ হচ্ছে না।
এদিকে, ভেমরা স্থলবন্দরের থেকে কলকাতার দূরত্ব মাত্র ৬০ কিলোমিটার হওয়ায় ব্যবসায়ীরা এ বন্দর ব্যবহারে বেশি আগ্রহী। তবে আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও সব পণ্য আমদানি না হওয়া ও অতিরিক্ত চাঁদার টাকা দিতে হয় বলে এ বন্দর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন তারা।
১৯৯৬ সালের ১৫ এপ্রিল ১৬টি পণ্যের আমদানি নিয়ে এলসি স্টেশন হিসেবে যাত্রা শুরু ভোমরা স্থলবন্দরের। ২০১৩ সালে ওয়্যারহাউস নির্মাণের পর বন্দরটি পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দরের মর্যাদা পায়। ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি আদায় হয়েছে বন্দরটিতে। তারপর থেকে শুরু হয়েছে ঘাটতি।
এর আগে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে সিঅ্যান্ডএফের সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ খান বলেন, ‘কাস্টম হাউস না থাকার কারণে উচ্চশুল্কের পণ্য আমাদের এখানে আসে না। ভোমরা স্থলবন্দর অন্যান্য বন্দরের তুলনায় বৈষম্যের শিকার। কাঁচামালের ক্ষেত্রে শতকরা দশ ভাগ প্লাস-মাইনাস থাকে সব বন্দরে। কিন্তু ভোমরায় নেই। তাই ব্যবসায়ীরা এখানে আসেন না।’ এ সময় ঘোজাডাঙ্গা সিঅ্যান্ডএফের মাধ্যমে চাঁদাবাজির বিষয়ে তার কাছে জানতে চাইলে ‘পরে কথা বলব’ বলে বিষয়টি এড়িয়ে যান মাকসুদ খান।
চাঁদাবাজির ব্যাপারে জানতে সিঅ্যান্ডএফের সভাপতি কাজী নওশাদ দিলওয়ার রাজুর মুঠোফোন নম্বরে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, এখনো পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর চালু না হওয়ায় সব ধরনের পণ্য আমদানি-রপ্তানির সুযোগ নেই। এ ছাড়া ভোমরার বিপরীতে ভারতের ঘোজাডাঙ্গায় সিরিয়ালের নামে ব্যাপক চাঁদাবাজিসহ বেশ কয়েকটি কারণে আর তারা ভোমরা স্থলবন্দরমুখী হচ্ছেন না।
এদিকে, সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দরকে ঘিরে ভারত প্রান্তে সব চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করে বসিরহাটের ব্যবসায়ী বারিক বিশ্বাস। ইতিমধ্যেই গরুপাচার-কাণ্ডে সিবিআই বারিক বিশ্বাসকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। এই বারিক বিশ্বাসের এদেশীয় ব্যবসায়িক পার্টনার হিসাবে কাজ করছেন ভোমরা স্থলবন্দর সিঅ্যান্ডএফ কমিটির সভাপতি কাজী নওশাদ দিলওয়ার রাজু ও সাধারণ সম্পাদক এস এম মাকসুদ খান। এ বন্দরকে ব্যবহার করে চাঁদাবাজি ছাড়াও তাদের বিরুদ্ধে স্বর্ণ চোরাচালান থেকে শুরু করে মানবপাচারেরও অভিযোগ রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে নিয়মিত কমিশন নিয়ে তাদের সহায়তার অভিযোগ রয়েছে খোদ বন্দরের উপপরিচালক মনিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে।
ভোমরা শুল্ক স্টেশনের সহকারী কমিশনার আমীর মামুন জানান, ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাইয়ে রাজস্ব আদায় করা হয়েছে ৪৪ কোটি ৫২ লাখ টাকা, আগস্টে ৫৭ কোটি ৬৩ লাখ, সেপ্টেম্বরে ৭৩ কোটি ৩০ লাখ, অক্টোবরে ৭১ কোটি ২৮ লাখ, নভেম্বরে ৭৪ কোটি ২৮ লাখ, ডিসেম্বরে ৫৫ কোটি ২৭ লাখ, জানুয়ারিতে ৫৯ কোটি ২০ লাখ, ফেব্রুয়ারিতে ৬২ কোটি ৪১ লাখ, মার্চে ৯৩ কোটি ৯৮ লাখ, এপ্রিলে ৫৭ কোটি ৪৬ লাখ, মে মাসে ৪৩ কোটি ৪৪ লাখ এবং জুনে রাজস্ব আদায় হয় ৪৮ কোটি টাকা।
ভোমরা স্থলবন্দরের উপ-পরিচালক মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘অবস্থানগত কারণে ভোমরা স্থলবন্দর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া পদ্মা সেতু চালু হয়েছে। পণ্য পরিবহন দ্রুত সময়ে করা যাবে। তাই সরকার ভোমরা স্থলবন্দরের বিভিন্ন বিষয় খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বিভিন্ন অবকাঠামোগত সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ চলমান রয়েছে।’ তিনি জানান, ভোমরা স্থলবন্দরের বিভিন্ন কার্যক্রম এখন এনালগ পদ্ধতির পরিবর্তে অটোমেশন পদ্ধতিতে হচ্ছে। তবে চাঁদাবাজির বিষয় এবং এতে তার সম্পৃক্ততার কথা জানতে চাইলে মনিরুল ইসলাম কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
এসব অভিযোগের বিষয়ে নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ভোরের পাতাকে বলেন, সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর নিয়ে এর আগেও নানা অভিযোগ ছিল। এবার স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে উচ্চ পর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এদিকে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, ভোমরা স্থলবন্দরসহ যেসব বন্দর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সুপারিশ করা হবে মন্ত্রণালয়কে। সেখানে বন্দর কর্তৃপক্ষের কোনো কর্মকর্তার গাফিলতি থাকলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়ার জন্যও সুপারিশ করা হবে।
ভোমরা স্থলবন্দর-কেন্দ্রিক চাঁদাবাজির বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ভোরের পাতাকে বলেন, ‘বন্দর-কেন্দ্রিক নানা ধরনের ঘটনা ঘটে। তবে কোনো ব্যবসায়ী বা ভুক্তভোগীর পক্ষ থেকে যদি অভিযোগ পাওয়া যায়, তাহলে অবশ্যই আমরা ব্যবস্থা নেব।’