#স্বপদে বহাল বিআইডব্লিউটিএ কর্মচারী জাকির হোসেন। # দুই মামলায় হয়েছে কারাদণ্ডের রায়।
প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের পৃথক দুই মামলায় আদালত জেল-জরিমানার আদেশ দিলেও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) এক কর্মচারী বহাল তবিয়তে চাকরি করে যাচ্ছেন। আসামির নাম, পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা এবং কর্মস্থল উল্লেখ করে আদালত থেকে বরিশালের পুলিশ সুপার বরাবর গ্রেফতারি পরোয়ানাও (স্মারক নং ১৮২, তারিখ :১৯ মে ২০২২) পাঠানো হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিন পরও তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। এমনকি নিয়মিত বেতন-ভাতাও উত্তোলন করে চলেছেন তিনি। দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত কর্মচারী হলেন সংস্থার প্রকৌশল বিভাগের বরিশাল সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর কার্যালয়ের নিম্নমান সহকারী জাকির হোসেন।
এদিকে সরকারি চাকরি শৃঙ্খলা বিধি অনুযায়ী ফৌজদারি মামলায় দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত একজন কর্মচারিকে দীর্ঘদিনেও বরখাস্ত না করায় আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্ট অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। উচ্চ আদালতের একজন আইনজীবী বলেছেন, আইনের বিধান অনুযায়ী রায়ের কপি হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আসামিকে বরখাস্ত করার কথা। অথবা বহুল প্রচারিত একাধিক গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হলে পত্রিকার কাটিং সংযুক্ত করে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করার রীতি রয়েছে। এটা না করা হলে তা হবে আদালত অবমাননার শামিল। জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে করা দুটি মামলারই রায় দিয়েছেন বরিশাল তৃতীয় যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক শিবলী নোমান খান। প্রথম মামলার রায় হয়েছে গত ১২ মে। রায়ে তার বিরুদ্ধে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ১০ লাখ জরিমানা করা হয়েছে। তবে রায় ঘোষণাকালে জাকির হোসেন আদালতে উপস্থিত ছিলেন না।
মামলা সূত্রে জানা যায়, জাকির হোসেন নগরীর বরিশাল মেরিন ওয়ার্কশপ মাঠ থেকে সাত শতক জমি ইজারা পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে বরিশাল শহরের বান্দরোড এলাকার সিরাজ মল্লিকের ছেলে রুবেল মল্লিকের কাছ থেকে ২০১৮ সালের ১০ নভেম্বর নগদ ১০ লাখ টাকা নেন। জমির ইজারা পাইয়ে দিতে না পারায় জাকির হোসেন টাকা ফেরত দিতে টালবাহানা শুরু করেন। একপর্যায়ে জাকির ২০২০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর পূবালী ব্যাংক, হাসপাতাল রোড, বরিশাল শাখায় তার নিজস্ব হিসাবের বিপরীতে ১০ লাখ টাকার একটি চেক দেন রুবেলকে। কিন্তু হিসাবে প্রয়োজনীয় টাকা না থাকায় ওই বছরের ৪ অক্টোবর চেকটি ডিজঅনার হয়। এ ঘটনায় রুবেল ২৮ অক্টোবর জাকিরকে আইনি নোটিশ পাঠান। এরপরও জাকির টাকা ফেরত না দেওয়ায় তার বিরুদ্ধে ২০২১ সালে আদালতে মামলা দায়ের করেন রুবেল। এই মামলায় গত ১২ মে রায় দেন আদালত। জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে করা অপর মামলার রায় হয়েছে গত ২২ জুন। রায়ে জাকিরের বিরুদ্ধে ছয় মাসের কারাদণ্ড এবং ৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা জরিমানার আদেশ হয়েছে। এই মামলার বাদী বরিশাল নদীবন্দরের শুল্ক আদায়কারী মো. কামাল হোসেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, জাকির বরিশাল নদীবন্দর এলাকার একটি ঘর ইজারা পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে কামালের কাছ থেকে নগদ ৬ লাখ ২৫ টাকা নিয়েছিলেন। শেষপর্যন্ত ইজারা পাইয়ে দিতে ব্যর্থ হয়ে নগদ টাকার বিপরীতে একটি ব্যাংক-চেক দিয়েছিলেন। কিন্তু চেকটি ‘ডিজঅনার’ হওয়ায় তার বিরুদ্ধে বরিশাল তৃতীয় যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ আদালতে প্রতারণার মামলা করেন কামাল হোসেন। সংশ্লিষ্ট আদালতের বিচারক শিবলী নোমান খান গত ২২ জুন এই মামলার রায় ঘোষণা করেন। আলাদা দুটি প্রতারণার মামলায় আদালত জেল ও জরিমানার আদেশ দেওয়ার পরও একজন কর্মচারি (দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামি) কীভাবে চাকরিতে বহাল থাকেন, কীভাবে বেতন-ভাতা উত্তোলন করেন এবং কেনো তাকে দীর্ঘদিনেও বরখাস্ত করা হচ্ছে না- এসব প্রশ্নের জবাব পেতে বিআইডব্লিউটিএর সংশ্লিষ্ট বিভাগের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তারা কেউ মুখ খুলতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা ভোরের পাতাকে বলেন, আদালতের রায়ের অনুলিপি এখনো তাদের কাছে আসেনি; অনুলিপি হাতে পেলে ব্যবস্থা নেবেন।
বিআইডব্লিউটিএর বরিশাল নদীবন্দর কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমানের বরাত দিয়ে প্রথম মামলার রায়ের পরের দিন ১৩ মে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছিল, আদালতের রায়ের কপি হাতে পাওয়ার পর জাকির হোসেনকে সরকারি চাকরি বিধি অনুযায়ী বরখাস্ত করা হবে। তবে এখন তিনি এ বিষয়ে মুখ খুলতে নারাজ। জানতে চাইলে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হারুনুর রশীদ ভোরের পাতাকে বলেন, ‘প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ’ ও ‘চেক ডিজ-অনার’- দুটিই প্রতারণা। এগুলো ফৌজদারি অপরাধ। সরকারি কর্মচারি চাকরিবিধি (শৃঙ্খলা ও আপিল) অনুযায়ী, এসব অপরাধের জন্য কোনো সরকারি কর্মচারি কিংবা কর্মকর্তা আদালত কর্তৃক দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত হলে তিনি চাকরিতে থাকার অযোগ্য বিবেচিত হবেন। রায়ের অনুলিপি হাতে পাওয়ার পরপরই তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে হবে।
অ্যাডভোকেট হারুনুর রশীদ আরো বলেন, অনেক সময় আদালতের রায়ের সহি মোহরী অনুলিপি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পৌঁছাতে বিলম্ব হয়। সে ক্ষেত্রে যদি রায়ের বিষয়টি একাধিক জাতীয় দৈনিক, টেলিভিশন কিংবা অন্য কোনো গ্রহণযোগ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়, তাহলে সেসব পত্রিকা বা গণমাধ্যমের কাটিং অথবা টেলিভিশনের ডিস্ক সংযুক্ত করে দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত কর্মচারিকে সাময়িক বরখাস্ত করার রীতি প্রচলিত আছে। কিন্তু তাকে স্থায়ী বা সাময়িক বরখাস্ত না করে স্বপদে বহাল রাখা ও নিয়মিত বেতন-ভাতা প্রদান করা হলে তা ‘আদালতের প্রতি অসম্মান দেখানো’ বলে গণ্য হবে। সে ক্ষেত্রে আদালত অবমাননার দায়ে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান ও সচিব ফেঁসে যেতে পারেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ক্ষমতা থাকলে সবকিছুই সম্ভব। না হলে মামলা হয়েছে এমন ব্যক্তি কিভাবে চাকরিতে বহাল থাকে। বুঝেনই তো ভাই সিবিএ।’ এ বিষয়ে অভিযুক্ত জাকির হোসেন ভোরের পাতাকে বলেন, ‘একটি চক্র আমার বিরুদ্ধে লেগেছে। আমি বিআইডব্লিউটিএতে বরিশাল সার্কেলে কর্মরত আছি। এবং বরিশাল সিবিএর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক। ভালো কাজের কোনো দাম নেই। আমি মানুষের টাকা দিয়ে দেব।’ এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএর বরিশাল সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোহাম্মদ সফিউল্লাহ ভোরের পাতাকে বলেন, ‘আমাদের কাছে এখনো কোনো চিঠি আসেনি। এলে তার (জাকির) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’