প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এখন আন্তর্জাতিক বাজারে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উপকরণগুলোর দাম অত্যধিক বেড়েছে। অনেক দেশেই এখন বিদ্যুতের জন্য হাহাকার তৈরি হয়েছে। অনেক উন্নত দেশেও কিন্তু দুর্ভিক্ষ শুরু হয়ে গেছে।
প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্টের (পিজিআর) ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে মঙ্গলবার (৫ জুলাই) ঢাকা সেনানিবাসে পিজিআর সদরদফতরে আয়োজিত অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে এসব কথা বলেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা কথা দিয়েছিলাম সব ঘরে বিদ্যুৎ দেবো, সেই বিদ্যুৎ কিন্তু আমরা দিতে পেরেছি। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে সারা বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা। তার ওপর রাশিয়া এবং ইউক্রেনের যুদ্ধ কারণে তেল, ডিজেল, ভোজ্য তেল, সারের দাম বেড়ে গেছে। প্রত্যেকটা জিনিসের দাম কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়ে গেছে। শুধু তাই না, যেসব শিপমেন্ট হয় তার ভাড়াও বেড়ে গেছে। যেটা হয়তো ৮০০ কোটি টাকায় পেতাম সেটা এখন আমাদের ২ হাজার কোটি টাকা কখনো তারও বেশি ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার কোটির বেশি লেগে যাচ্ছে। আমরা এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানি করতাম, তার দাম বেড়ে গেছে।
তিনি বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন আমাদের নিজস্ব সামান্য গ্যাস আর এলএনজি আমদানি এবং আমরা কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো করে দিচ্ছিলাম, যাতে শত ভাগ দিতে পেরেছি। ডিজেল এবং ফার্নেস অয়েল দিয়ে আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদন করছি। প্রত্যেকটা জিনিসের দাম কিন্তু বেড়ে গেছে। বিদ্যুতে কিন্তু মোটা অংকের সাবসিডি দিতে হচ্ছে আমাদের। অনেক বেশি ভর্তুকি। বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে খরচ আমরা কিন্তু গ্রাহকের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত সে খরচও নিতে পারি না। কিন্তু কত ভর্তুকি আমরা দেবো? যেখানে সারা বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা।
দেশবাসীর উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সে ক্ষেত্রে আপনাদের অনুরোধ করবো বিদ্যুৎ ব্যয়ে সাশ্রয়ী হবেন, সীমিত রাখবেন। তাতে আপনারও লাভ হবে। আপনার বিলও কম উঠবে। সেদিকে নজর দেন, সঙ্গে সঙ্গে আপনাদের সাশ্রয়ী হতে হবে। গাড়ি-ঘোড়া চলায় তেলের ক্রাইসিস সারা বিশ্বব্যাপী। আমরা কতদিন চালাতে পারবো সেটা হচ্ছে বড় কথা। কারণ যেখানে উৎপাদন হচ্ছে সেখানে দাম বেড়ে যাচ্ছে আনা-নেওয়ায়, যুদ্ধের কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তবু আমরা থেমে থাকিনি। যেভাবে হোক, আমরা ব্যবস্থা করে যাচ্ছি। অন্তত যেটুকু আছে সেটাই আমাদের নিজেদের সাবধান হয়ে ব্যবহার করতে হবে যেন আমরা অতিরিক্ত ব্যয় না করি।
তিনি আরও বলেন, অহেতুক ঘোরাঘুরি করে পেট্রোল পোড়াবেন না, তেল পোড়াবেন না। সে দিকে লক্ষ রাখবেন। যত কম বাইরে যাওয়া যায় সেটার ব্যবস্থা রাখবেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ করে দিয়েছি, কাজে বিদ্যুৎ আমাদের যেটুকু থাকবে তাতে ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে আপনারা যে সুযোগটা পাবেন সেটাই ব্যবহার করবেন বেশি। এখন সমগ্র বাংলাদেশে আমরা ব্রডব্র্যান্ড পৌঁছে দিয়েছি, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপন করেছি। অনলাইনে এখন কেনা-বেচা বা প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে অনেক কাজ ঘরে বসেই করা যায়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পঁচাত্তরে জাতির পিতাকে হত্যার পর বাংলাদেশে যারা স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী—যাদের বিচারকার্য শুরু হয়েছিল, তাদেরই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসানো হয়। তাছাড়া জাতির পিতার হত্যাকারীদের ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করে বিচারের হাত থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে তাদের পুরস্কৃত করা হয়। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ক্ষমতায় থাকার কারণেই এই সেনাবাহিনীতে ১৯ বারের মতো ক্যু হয় এবং বহু সেনা সদস্য, সৈনিক, অফিসার মৃত্যুবরণ করেন। এমন একটা সময় ছিল, যখন অফিসারদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে হামলা করা হয়েছে। অনেকের স্ত্রীকে হত্যা করা হয়েছে, পরিবারকে হত্যা করা হয়েছে। এ রকমও ঘটনা তখন ঘটতে থাকে একের পর এক। প্রতি রাতে বাংলাদেশে কারফিউ চলতো। মানুষের কোনও অধিকারই ছিল না। মানুষ স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারতো না। এ রকম একটা পরিবেশ বাংলাদেশে ছিল।
তিনি বলেন, ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। পঁচাত্তরে আমি ও আমার ছোট বোন বিদেশে ছিলাম। ১৯৮১ সালে আমাকে দেশে ফিরতে দেওয়া হয়নি। অনেকটা জোর করেই দেশে ফিরতে হয়েছিল। যেখানে খুনিদের রাজত্ব, যেখানে অপরাধীদের রাজত্ব; আমি জানতাম যেকোনও সময় তারা আমাকে মারতে পারে। আমি সেটা পরোয়া করিনি। মানুষের জন্য ফিরে আসি। আসার পর থেকে আমার লক্ষ্য ছিল, একদিকে যেমন বাংলাদেশের মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করা, পাশাপাশি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ, যেখানে আমার বাবা নিজের হাতে সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী, নৌবাহিনী গড়ে তুলে গেছেন; সেগুলো যাতে আরও উন্নত হয় সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া।
শেখ হাসিনা বলেন, অনেক উন্নত দেশে কিন্তু দুর্ভিক্ষ শুরু হয়ে গেছে। আমাদের দেশেকে যাতে সে পরিস্থিতিতে পড়তে না হয়, এ জন্য এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে। কোনও জলাধার যেন খালি না থাকে। যার যেখানে যতটুকু জায়গা আছে, প্রতিষ্ঠানভিত্তিকও যেখানে যতটুকু খালি জায়গা, যে যা পারবেন কিছু উৎপাদন করবেন। উৎপাদন করে অন্তত নিজেদের খাদ্যটা নিজেরা জোগাড় করার চেষ্টা করা, যাতে বাজারের ওপর চাপ না পড়ে। উদ্বৃত্তটা বিক্রি করে যাতে লাভবান হতে পারেন, সেই ব্যবস্থাটা সবাইকে নিতে হবে।
করোনার সংক্রমণ প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন আবার একটু প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। সেই সঙ্গে আমরা টিকা দিচ্ছি। টিকা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুস্টার ডোজটাও নিতে হবে। অনেকেই বুস্টার ডোজ নিচ্ছে না। সাধারণ জনগণ একটু পিছিয়ে থাকে। সেই ব্যাপারেও আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নেবো, যাতে প্রত্যেকে বুস্টার ডোজটা নেয়। যাতে প্রাদুর্ভাব আর বাড়তে না পারে।