পদ্মা সেতু আমাদের আত্মমর্যাদার: আমু
পদ্মা সেতুর গল্পের শুরুটা ছিলো অনেক কঠিন। দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগে প্রকল্প থেকে একে একে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করল বিশ্ব ব্যাংক জাইকা, এডিবিসহ অন্যান্য দাতাসংস্থাগুলোও। বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হয় দেশের এই বৃহৎ প্রকল্প নিয়ে। দৈনিক ভোরের পাতার সঙ্গে আলাপকালে এমটি বলছিলেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য আমির হোসেন আমু। তিনি বলেন, সেই সময়টা ছিলো খুবই কষ্টের। ঠিক তখনই সকল বিপর্যয় কাটিয়ে ২০১২ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষাণা করেন নিজস্ব অর্থেই পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হবে। আর এক দশকের ব্যবধান পদ্মা সেতু খুলে দেওয়া হয়েছে দেশের মানুষের জন্য।
আমির হোসেন আমু বলেন, ‘পদ্মা সেতু আমাদের জন্য কখনই বিলাসী ভাবনা ছিল না। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। এই সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানবিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। আমি মনে করি, পদ্মা সেতু বিশ্বের বুকে একটি নিদর্শন তৈরি করেছে। পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া ব্রিজ নিয়ে নানা গল্প আছে। এমন গল্প এখন পদ্মা সেতু নিয়েও তৈরি হচ্ছে।’ তিনি বলেন, আজকে পদ্মা সেতু নিয়ে অনেকে কথা হচ্ছে। অনেকে অনেক ষড়যন্ত্র করেছেন। নোবেল পুরস্কার জয়ী থেকে শুরু করে এদেশের অনেক মানুষ পদ্মা সেতু যেন না হয় তার জন্য চেষ্টা করেছিলেন। তারা একবার চিন্তা করেননি যে, পদ্মা ব্রিজ হলে শুধু আওয়ামী লীগের লোকেরা পার হবেন না, সারা দেশের মানুষ সেতু দিয়ে পার হবেন। তারা চিন্তা করেননি, এই পদ্মা ব্রিজের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের উন্নতি হবে না, এই বাংলার অর্থনৈতিক উন্নতি হবে। এই পদ্মা ব্রিজের মাধ্যমে ওই দক্ষিণ অঞ্চলে বাণিজ্য কেন্দ্রিক একটা জায়গা গড়ে উঠবে।
২০০৮ সাল। ক্ষমতার গ্রহণের পরপরই আওয়ামী লীগ পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পদ্মা সেতুর জন্য ডিজাইন কনসালট্যান্ট নিয়োগ হয়। কনসালট্যান্ট ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সম্পন্ন করেন এবং সেতু বিভাগ প্রিকোয়ালিফিকেশন দরপত্র আহ্বান করা হয়। ২০১১ সালে সরকার বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণ চুক্তিবদ্ধ হয়। এর পরের বছর ২০১২ সালে বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি বাতিল করে। ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে অন্যান্য দাতা সংস্থাগুলোও ঋণের সিদ্ধান্ত বাতিল করে।
বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের ভিত্তিতে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনক মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। যোগাযোগ সচিব মোশাররফ হোসেন ভূইয়াকে জেলে পাঠানো হয়। পরবর্তীসময়ে দুর্নীতির অভিযোগটি মিথ্যা প্রমাণিত হয় এবং কানাডার আদালত দুর্নীতির অভিযোগের মামলাটি বাতিল করেন। এরপর প্রকল্পটি বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করার সিদ্ধান্ত নেয়।
পদ্মা সেতু আমাদের আত্মমর্যাদার প্রতীক: মেনন
ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেছেন, পদ্মা সেতু আমাদের কাছে আত্মমর্যাদার প্রতীক। বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের সক্ষমতার প্রমাণ। আমাদেরকে করেছে আরও আত্মবিশ্বাসী। এই আত্মবিশ্বাস আমাদের মুক্তিযুদ্ধের। পাকিস্তানিদের বিশ্বাসঘাতকতার মুখে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘আর দাবায়ে রাখতে পারবা না’। তেমনি বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে ঋণ প্রত্যাহার করে নিলে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা জুলাই ২০১২-তে একই সাহস নিয়ে বলেছিলেন, আমাদের নিজেদের অর্থায়নেই আমরা পদ্মা সেতু করব। সেদিন আমরা সমর্থন জানিয়েছিলাম। সোমবার দৈনিক ভোরের পাতা প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, আপনাদের হয়তো মনে থাকতে পারে, সেই সময় মন্ত্রীসভার মধ্যে, সরকারের মধ্যে, সংসদের অনেকের মধ্যে টালমাটাল ও দোদুল্যমনতা আমরা দেখেছিলাম। অনেকেই বলেছিলেন বিশ্বব্যাংককে আবার ফিরিয়ে আনতে। সেই প্রশ্নই আবার বিএনপি করছে বিশ্বব্যাংকের অর্থ নেওয়া হয়নি কেন। সেই আনার প্রচেষ্টায় এক বছর সময় অতিবাহিত হয়েছিল। সেসব কিছুকে মোকাবিলা করে আমাদের অর্থনীতির সক্ষমতাই পদ্মা সেতু সম্ভব করেছে।
আমার মতে বিশ্বব্যাংক নিজেই দুর্নীতি সংশ্লিষ্ট ষড়যন্ত্রের মাস্টার। যে মুক্তবাজার অর্থনীতি দুর্নীতির জন্ম দিতে বাধ্য তারা সেই অর্থনীতি দর্শনেই প্রবক্তা। আমাদের দেশে যে দুর্নীতির বিস্তার ঘটেছে, অর্থ পাচার থেকে শুরু করে সকল অর্থনৈতিক দুবৃত্তপনা ঘটছে তা বিশ্বব্যাংক অনুসৃত নয়াউদারবাদী অর্থনীতির বিষময় ফলাফল। বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ বিশেষ করে মার্কিন অর্থনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারে হেন কাজ নাই যা বিশ্বব্যাংক করে না।
বিশ্বব্যাংকের ঋণ বাতিলের ব্যাপারে মার্কিনী প্ররোচনা ছিল। ড. ইউনুসের প্ররোচনায় হিলারী ক্লিনটন যে এ কাজে বিশ্বব্যাংককে করতে বলেছিল তার প্রমাণ মেলে সে সময় বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যে। প্রধানমন্ত্রী যখন নিজ অর্থায়নে পদ্মা সেতু করবেন বললেন এবং বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ চেয়ে বিশ্বব্যাংকে চিঠি দিতে অর্থমন্ত্রীকে বললেন ঠিক তখনই ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত মেজিনা সাহেব ভয় দেখাতে শুরু করেছিলেন যে এতে যুক্তরাষ্ট্রে গার্মেন্টস ও প্লাস্টিক জাতীয় পণ্যের বাজার বন্ধ হয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করার ভয়। এই ভয় ফারল্যান্ড সাহেব দেখিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধুকে এই বলে যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা বাংলাদেশকে বায়াফ্রায় পরিণত করতে পারে। বঙ্গবন্ধুর সরকার সেদিন যেমন মাথা নত করে নাই, বঙ্গবন্ধু কন্যাও মাথা নত করবে না। পদ্মা সেতুর মত স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতিতে অটল থাকবেন।
পদ্মা সেতু হতে পারত আমাদের জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। কিন্তু বিএনপি-জামাতি-বামাতিরা সেটা হতে দিতে রাজী হয়নি। এখনও না। নানা দুর্নীতি-অপচয়-অপব্যয়ের নানা হিসাব দিচ্ছে। চেষ্টা করছে দেশের মধ্যে এক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে। কিন্তু পদ্মা সেতু দিয়ে তাদের যেমন পারাপার করার বাস্তবতা মেনে নিতে হবে, তেমনি মেনে নিতে হবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক অভিযাত্রাকে।
পদ্মা সেতু সকল ষড়যন্তের উত্তর: ইনু
জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেছেন “পদ্মা সেতু সব ষড়যন্ত্রের উত্তর। তিনি বলেন এই সেতু বাঙালির আত্মবিশ্বাসের প্রতীক। এই সেতুর ওপর দিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আগামী নির্বাচনে আবারও দেশ শাসনের দায়িত্ব পাবে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় জোট। গত ২৫ জুন গর্বের পদ্মা সেতু উদ্বোধন হয়েছে এর সুফল বাংলাদেশের মানুষ পেতে শুরু করেছে। বৃহস্পতিবার দৈনিক ভোরের পাতার প্রতিনিধির সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, “একদিকে সারা দেশে বন্যা হচ্ছে, অন্যদিকে এই সেতু ঘিরে আনন্দের হিল্লোল বয়ে যাচ্ছে। এটি বিশ্বের বিস্ময়। অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। পদ্মা সেতু সেই সব ষড়যন্ত্রের উত্তর। আগামী নির্বাচনে এই সেতু দেশকে সামনে অনন্য উচ্চতায় এগিয়ে নিয়ে যাবে।”