জাতীয় পতাকা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হলো কফিন। বিউগলের করুণ সুরের মূর্ছনায় শুরু হলো গার্ড অব অনার। প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুরুতে সম্মান জানিয়ে বক্তব্য রাখলেন এসিল্যান্ড। তিনি বললেন, আমরা একজন মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মান জানাতে এসেছি। সম্মান জানাচ্ছি। তিনি ১৯৭১ সালের বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে যুদ্ধ করেছেন। এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্র আজ সম্মান জানাচ্ছে। গার্ড অব অনার শেষে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। তারপর আমাদের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা আশরাফ উদ্দিন ভূঁইয়া আমার ভাই। তিনি হঠাৎ করে চলে গেলেন। মঙ্গলবার কুমিল্লায় বাড়িতে গিয়েছিলাম মাকে দেখতে। ঢাকা থেকে ফোনে জানলাম কিডনি ফাউন্ডেশনে ভর্তি করা হয়েছে ভাইকে। দুটি কিডনি নষ্ট ছিল তাঁর। রাতে ঢাকায় ফিরলাম। বৃহস্পতিবার সকালে হাসপাতালে গেলাম। আমার সঙ্গে ভাগিনা ব্যবসায়ী ইউনুস হাসান মানিক। হাসপাতালে ভর্তির পর থেকে ভাই কথা বলতে পারছিলেন না। আমাকে দেখে খুশি হলেন। ভাতিজা বৌ জানতে চাইল চিনতে পেরেছে কিনা, মাথা নাড়লেন। তারপর বললেন, আমাকে ধরো। ধরলাম। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। তিনি বললেন, আমার মা কাঁদছে...। আমার মা...। কিছুক্ষণ হাত ধরে রাখলাম। তারপর বিদায় নিয়ে বললাম, সন্ধ্যার পর আসব আবার। তিনি মাথা নাড়লেন। দুপুর ১২টার দিকে চলে এলাম অফিসে। ফিরে আসার আড়াই ঘণ্টা পর ভাতিজার ফোন পেলাম, তিনি আর নেই। আমি চলে আসার পর চোখ বুঝে ফেললেন। চুপ হয়ে গেলেন। তারপর চিরতরে চলে গেলেন। চিকিৎসকরা জানালেন, এ মানুষটি আর আসবেন না।
ঢাকায় দুটি জানাজা হলো। তারপর রাতে মরদেহ নিয়ে গেলাম কুমিল্লায়। সকাল ৯টায় ছিল দাফনের সময়। কুমিল্লা জেলা ও নাঙ্গলকোট উপজেলা থেকে পুলিশের গার্ড অব অনার টিম এলো। নাঙ্গলকোট উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যক্ষ সাদেক হোসেন, মেয়র আবদুল মালেক, আবুল খায়ের আবু, অধ্যক্ষ নুরু উল্লাহ মজুমদারসহ আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের নেতারা এলেন। আশপাশের ইউনিয়ন চেয়ারম্যানরাসহ সর্বস্তরের মানুষ এলেন। ফুল দিলেন কফিনে। জানাজা শেষ না হতেই বৃষ্টি নামল। সবাই বললেন রহমতের বৃষ্টি। ঝিরঝির বৃষ্টিতে ভিজলেন সবাই। এর মাঝে সম্পন্ন হলো দাফন। দাফন শেষ হতেই মোনাজাত হলো। মোনাজাত শেষে আমরা কবরস্থান থেকে বাড়ি ফিরে এলাম। একজন মানুষ আমাদের মাঝে ছিলেন। আজ তিনি নেই। এখন তিনি কবরবাসী। আর কোনো দিন ফিরবেন না মানুষের দুনিয়াতে। কথা বলবেন না নিজের মায়ের সঙ্গে। সন্তান আর ভাইবোনদের সঙ্গে জমাবেন না আড্ডা। স্মৃতিচারণা করবেন না মুক্তিযুদ্ধের। দুই দিনের দুনিয়াতে তিনি এসেছিলেন। নওয়াব ফয়জুন্নেছা কলেজে ছাত্রলীগ করতেন। ছাত্র সংসদে ছিলেন। সেই সময়ে বঙ্গবন্ধুর ডাকে যুদ্ধে গেলেন। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর কমান্ডারের নাম ছিল আবদুল মালেক। তিনি এখনো জীবিত আছেন। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস মালেক কমান্ডার আমাদের বাড়িতে ঘাঁটি করেছিলেন। এখান থেকে তিনি দলবল নিয়ে যেতেন বিভিন্ন অপারেশনে। তাঁর নেতৃত্বে আমার ভাই ছাড়াও মামা দেলোয়ার হোসেন, খালাতো ভাই খোকন মোল্লা যুদ্ধে যান। সেসব স্মৃতিচারণা মালেক কমান্ডার করেছিলেন কিছুদিন আগে সাংবাদিকদের কাছে। যা ইউটিউবেও আছে। মালেক কমান্ডার এখনো আছেন। চলে গেলেন তাঁর একজন যোদ্ধা।
মানুষের জীবন ও মৃত্যু অনেক কাছাকাছি। মাঝে মাঝে ভাবী এই জীবন এত ছোট কেন হয়? ইস্তাম্বুল শহরের হোটেলটির নাম ছিল থ্রি ট্রি হিলটন। গত রমজানের ঈদের দিনের ভোরবেলায় এই হোটেলে উঠলাম ফরিদা ইয়াসমিন ও আমি। ব্রেকফাস্ট সেরে ফরিদা ইয়াসমিন গেলেন রুমের দিকে। আমি আশপাশে একটু হাঁটতে বের হলাম। শীত পুরো শেষ হয়নি। হালকা সোয়েটারে মানছে না। একটু জোরে হাঁটার চেষ্টা করলাম শীত কমানোর জন্য। হঠাৎ খেয়াল করলাম হোটেলের সামনে বিশাল কবরস্থান। থমকে দাঁড়ালাম। হোটেলের সামনে এভাবে কবরস্থান অন্য শহরে অতীতে পাইনি। সুলতান সুলেমানের দেশে গিয়ে কবর ও হোটেল একসঙ্গে পেলাম। কবরস্থানের সামনে দাঁড়িয়ে সালাম জানালাম। পড়লাম, আসসালামু আলাইকুম ইয়া আহলাল কুবুর। তারপরও বাংলায় বললাম, আপনারা যারা কবরে শুয়ে আছেন আপনাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। আল্লাহপাক আপনাদের ভালো রাখুন। সব আজাব থেকে মুক্তি দিন। মুছে যাক জীবিতকালে হৃদয়ের ভিতরের জমাট বেঁধে থাকা কষ্টগুলো। ইস্তাম্বুলেও সেই দিন ছিল রমজানের ঈদ। আমরা যাচ্ছিলাম আমেরিকায় মেয়ের কাছে। ট্রানজিট ছিল ইস্তাম্বুলে। সুলতান সুলেমানের শহরটা দেখব আমরা। পুত্র আমাদের হোটেল ঠিক করে দিয়েছিল। সেই হোটেলের দুই পাশে বিশাল কবরস্থান। আগে খেয়াল করলে কবরস্থানের পাশে হোটেল নেওয়া হতো না। মৃত্যু ও জীবন পাশাপাশি হাঁটে জেনেও আমরা তা মানতে পারি না। হঠাৎ খেয়াল করলাম অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন কবরস্থানের সামনে। তারা ভিতরে প্রবেশের সময় পানি কিনছেন। কবরস্থানের সামনেই বিক্রি হচ্ছে পাঁচ লিটারের পানির জার। পানির জার হাতেই তারা প্রবেশ করছেন ভিতরে। অনেকে পানি নিয়ে আসছেন বাড়ি থেকে। কবরস্থানে পানি নিয়ে তারা কী করেন তা দেখতে কৌতূহলী হলাম। দেখলাম তারা পানি ছিটিয়ে দিচ্ছেন প্রিয় মানুষের কবরের ওপরে। আমাদের দেশে এভাবে পানি ছিটানো হয় নতুন কবরে। একই সঙ্গে মাটিতে পুঁতে রাখা হয় বরই গাছের ডাল। পুরাতন কবর সবাই জিয়ারত করতে যান। যত্ন করে পানি ছিটান না।
কবরস্থানের ভিতরে আমিও প্রবেশ করলাম। পানি ছিটানোর দৃশ্য দেখলাম দাঁড়িয়ে। খেয়াল করলাম কবরের ঘাসগুলো বেশ বড় এবং অনেক সবুজ। সবুজ ঘাস বড় হলে মেশিন দিয়ে ছেঁটে দেওয়া হয়। এতে কবর পরিচ্ছন্ন থাকে। ভালো লাগল কবরের যত্ন নেন তারা। আন্তরিকতা নিয়ে স্মরণ করেন চলে যাওয়া প্রিয় মানুষটাকে। আলাপ হলো কবরে পানি ছিটিয়ে দিতে আসা একজনের সঙ্গে। জানতে চাইলাম, তারা পুরাতন কবরের ওপর এভাবে পানি ছিটিয়ে দিচ্ছেন কেন? জবাবে ভদ্রলোক পাল্টা প্রশ্ন করলেন, তোমাদের দেশে কবরে পানি দেওয়া হয় না? বললাম, নতুন কবরে পানি দিই। চিহ্ন ধরে রাখতে একটি বরই গাছের ডালও পুঁতে রাখি। আজকাল পুরাতন কবরে যাওয়ার সময় নেই স্বজনদের। একটা মানুষ চলে গেলে তাকে সবাই ভুলে যাই। তবে শুক্রবার জুমার দিন, ঈদ বা মৃত্যু দিবসে কেউ কখনো কবরস্থানে গেলে জিয়ারত করেন। নতুন করে কেউ পানি ছিটান না। তোমরা কেন পানি ছিটিয়ে দাও কবরের ওপর? ভদ্রলোক বললেন, কবরের ওপর ঘাস তাজা থাকে। যিনি কবরে আছেন তার আত্মা অনেক কষ্টে থাকে। তার শান্তি ও স্বস্তি কামনা করতে আমাদের কবরস্থানে আসা ও পানি ছিটানো।
দুনিয়ার সব কবর, সব মৃত্যু একই। অজানা, অচেনা মানুষের কবরস্থানে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করলাম। দোয়া করলাম আল্লাহ যেন সবার কবরে শান্তি বর্ষণ করেন। মনে পড়ল সম্রাট শাজাহানের দুখিনী কন্যা জাহানারার শেষ অছিয়তের কথা। দিল্লির নিজামুদ্দিনে তিনি শুয়ে আছেন। মৃত্যুর আগে তিনি অছিয়ত করেছিলেন, তাঁর কবর যেন সাধারণ মানুষের মতোই সবুজ ঘাসে ঢাকা থাকে। ইট-পাথর নয়। জাহানারার কবর শত বছর তাই ছিল। এখন আর তা নেই। জাহানারা বুঝেছিলেন, মৃত্যুর পর কেউ রাজকুমারী থাকেন না। কেউ রাজা-মহারাজা থাকেন না। সবাইকে কাফনের কাপড় পরিয়ে শুইয়ে দেওয়া হয় সাড়ে তিন হাত মাটির কবরে। আমেরিকার বিখ্যাত কবি এমিলি এলিজাবেথ ডিকিনসন লিখেছেন, ‘আমি কেউ নই, তুমি কে?’ কবরস্থানে দাঁড়িয়ে মনে হলো আসলে আমরা কে? দুই দিনের দুনিয়াতে আমরা অল্প সময়ের মেহমান মাত্র। হুটহাট করে আমাদের বন্ধুরা চলে যাচ্ছেন। অথচ কেউই তা বুঝতে চাই না। মানুষের চলাফেরাতে ভাবখানা এমন, সবাই যেন অমরত্ব নিয়ে এসেছেন। তাই হিংসা-বিদ্বেষ, যুদ্ধ-বিগ্রহে মানুষ জীবনটা কাটিয়ে দেয়। এই দুনিয়াতে কেউ বনেন চেঙ্গিস খাঁ, কেউ রাসপুতিন। নিষ্ঠুরতা, হিংসা মানুষ তার জন্ম থেকে পেয়েছে। আল্লাহপাক পৃথিবীর প্রথম মানবকে নিষেধ করেছিলেন গন্ধম ফল না খেতে। আল্লাহর সেই নিষেধাজ্ঞা প্রথম মানব মানেননি। গন্ধম খেয়েই প্রথম মানব-মানবী দুনিয়াতে আসেন। আর এসেই তাদের উত্তরাধিকারীরা লিপ্ত হলেন হানাহানিতে। হজরত আদম (আ.)-এর দুই পুত্রের একজন আরেকজনকে খুন করেন। তারপর মাটিতে পুঁতে ফেলেন। আমরা মুসলমানরা দুনিয়ার শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.)-এর অনুসারী। আমাদের মহানবীর নির্দেশ ছিল ইতিবাচক পথে থাকতে। সব নেতিবাচক কাজ থেকে বিরত থাকতে। কিন্তু কে শুনে কার কথা। কেউ ভাবেন না একদিন চলে যেতে হবে। বোখারি শরিফে ২৯৭ অনুচ্ছেদে বর্ণিত আছে, ‘দুনিয়ার সেরা নবী আমাদের প্রিয় মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.) গুজব ছড়াতে, সম্পদ ধ্বংস করতে, অধিক যাঞ্চা করতে, অপরের প্রাপ্য অধিকারকে বাধাগ্রস্ত না করতে, মায়ের অবাধ্যচারী না হতে এবং কন্যাসন্তানকে জীবিত অবস্থায় মাটিতে পুঁতে না ফেলতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন।’ শেষ নবীর এই নির্দেশ তাঁর উম্মতরা কতটা পালন করেন?
মানুষের ভয়াবহতা বিচলিত করত কবি এমিলি ডিকিনসনকে। তিনি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন মানুষের সমাজ থেকে। সাদা কাপড় পরতেন। মানুষের সামনে যেতেন না। মানুষকে এড়িয়ে চলতেন। এই বিখ্যাত মার্কিন কবি ১৮৩০ সালের ১০ ডিসেম্বর ম্যাসাচুসেটসের এক বনেদি পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন। বাবা ছিলেন অ্যামহাস্ট শহরের একজন খ্যাতিমান আইনজীবী। বাবা খেয়াল করলেন তার অন্য সন্তানদের চেয়ে এ মেয়েটি একটু আলাদা। দুনিয়ার মানুষদের অস্বাভাবিকতা ও নোংরামি এই মেয়েটিকে কষ্ট দেয়। এ কারণে মেয়েটি একাকী থাকতে পছন্দ করত। কারও সঙ্গে মিশত না। পছন্দ করত নির্জনতা। বিয়ে করেননি। মেয়েটি নিজের ভিতরের কষ্টগুলো লিখে রাখত কবিতা আকারে। বাবা তার মেয়েটির একাকী থাকার সব ব্যবস্থা করে দেন। এমিলি জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত একাকী কাটান। বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যাও তেমন ছিল না। পারিবারিক দুটি বাড়ির সীমানায় ছিল তার জীবন। একটিতে তিনি নিজে থাকতেন। আরেকটিতে থাকতেন তার ভাই অস্টিন। মাত্র ৫৫ বছর বয়সে এই কবি মারা যান ১৮৮৬ সালে। মৃত্যু ও অমরত্ব দুটি ভাবধারা নিয়ে তিনি লিখতেন। এমিলির স্মৃতি ধরে রাখতে তার বাড়িটিকে মিউজিয়াম করা হয়েছে। অ্যামহাস্ট কলেজ ২০০৩ সালে কাজটি করেছে। কয়েক বছর আগে এক শীতের সকালে সেই জাদুঘর দেখতে গিয়েছিলাম। ঘুরে ঘুরে দেখেছি এমিলির স্মৃতিচিহ্ন। ছবি তুলতে তুলতে ভাবছিলাম, সেই যুগের একজন কবি মানুষের ভয়াবহতাগুলো কী করে এতটা অনুধাবন করেছিলেন!
জগতের হিংসার ভয়াবহতা সহ্য করতে না পেরে সংসার ও রাজত্ব ছেড়েছিলেন গৌতম বুদ্ধ। ফকির লালন শাহের জীবন ও ভাবধারা ছিল জগৎ সংসারের প্রতি উদাসীনতায়। জমিদার হয়েও দামি প্রাসাদ বানাননি হাসন রাজা। তিনি শান্তি খুঁজতেন হাওরের জলরাশিতে বজরা ভাসিয়ে গানবাজনা শুনে। প্রকৃতি কিছু জটিল রহস্য দিয়ে মানুষকে সৃষ্টি করে।
ইস্তাম্বুল থেকে গিয়েছিলাম আমেরিকায়। থাকলাম ম্যাসাচুসেটসের ছোট্ট শহরে। এই শহরেই কবি এমিলি এক সময় বড় হয়েছিলেন। শিক্ষকতা করতেন কবি রবার্ট ফ্রস্ট। মেয়ের কনভোকেশনে যোগ দিতে গিয়েছিলাম। ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটস অ্যামহাস্ট থেকে পাবলিক পলিসি নিয়ে মেয়ে মাস্টার্স শেষ করল। এক বিকালে হাঁটতে বের হলাম সান্ডারল্যান্ড শহরে। হেঁটে দেখলাম ঘোড়ার খামার। কৃষি খামার। খেয়াল করলাম নদীর তীর ঘেঁষে খ্রিস্টানদের বিশাল গোরস্তান। স্থাপিত ১৭১৪ সালে। শহরটির যাত্রাও তখন। যার পরিবর্তন এখনো হয়নি। হাঁটতে হাঁটতে গোরস্থানে প্রবেশ করলাম। কবরের নীরব পরিবেশ। নদীর কলকল শব্দে মাঝে মাঝে সেই নীরবতা ভঙ্গ হচ্ছে। শত শত বছর আগের কবরগুলো সংরক্ষণ করা। পাথরে খোদাই করে লেখা চলে যাওয়াদের নাম ও জন্ম, মৃত্যুর সাল।
গোরস্থানে ঘুরতে গিয়ে মনে পড়ল এই এলাকায় বসে লেখা কবি রবার্ট ফ্রস্টের একটি কবিতার কথা। রবার্ট ফ্রস্ট তখন অ্যামহাস্টে থাকতেন। এখন সেই বাড়িটি পুলিশ স্টেশন। অ্যামহাস্টে বসবাসকালে কবি খেয়াল করলেন, দুটি সড়ক আলাদাভাবে একটি হলুদ বনে গিয়ে থেমেছে। অথচ তিনি চাইলেও একই সময়ে দুটি রোডে হেঁটে ইয়েলো বনে যেতে পারছেন না। একসঙ্গে দুটি সড়কে হাঁটতে না পারার আক্ষেপ তৈরি হলো কবির মনে। সেই আক্ষেপে লিখেলেন-
“টু রোডস ডিভারগেড ইন এ ইয়েলো রোড
এন্ড সরি আই ক্যুড নট ট্রাভেল বোথ
এন্ড বি ওয়ান ট্রাভেলার, লং আই স্টুড
এন্ড লুকড ডাউন ওয়ান এস ফার এস আই ক্যুড
টু হোয়েআর ইট বেন্ট ইন দ্য আন্ডারগ্রোথ।”
“দুটি পথ গেছে চলে হলুদ বনে,
হায়! পথিক আমি, একাই দু’দিকে যাবো- তা পারিনে,
যতদূর চোখ যায় চেয়ে রইলাম একদৃষ্টিতে,
যেখানে লতা-গুল্মের ঝোপ পেরিয়ে সেটি গিয়েছে বেঁকে।”
আমাদের সবার জীবনে কম বেশি এমন অনেক আক্ষেপ থাকে। যা আমরা হয়তো রবার্ট ফ্রস্টের মতো প্রকাশ করতে পারি না। আমার এক বন্ধু মৃত্যুর আগে বলেছিলেন, জীবনটা এত ছোট কেন? পড়াশোনা শেষ করেই চাকরি, সংসারের লড়াই। বেঁচে থাকার লড়াই শেষ না হতেই শরীরে বেঁধেছে অসুখ-বিসুখ। সন্তানরা বড় হওয়ার আগে শরীর জানিয়ে দিচ্ছে চলে যেতে হবে। বুঝলাম যেতে হবে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি কেন? জানতাম সেই বন্ধু চলে যাচ্ছেন। জবাব না দিয়ে তাকালাম। বললাম, আমাদের সবাইকে চলে যেতে হবে। চাইলেও আমরা কেউ থাকতে পারব না। শুধু সময়ের ব্যবধান দুই দিন আগে না পরে।
লেখক: সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।