প্রয়াত যোগাযোগ সচিব সৈয়দ রেজাউল হায়াতের কথা মনে আছে? ডাকসাইটে আমলা, সিএসপি রেজাউল হায়াতই সম্ভবত স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের দীর্ঘসময়ের যোগাযোগ সচিব। সুদর্শন, দীর্ঘদেহী মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল হায়াত ৯৬-এর আওয়ামী লীগ সরকার ও পরবর্তী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে সব মিলিয়ে আট বছর যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সামলেছেন।
প্রথম আলোতে আমি যখন রিপোর্টার, তখন থেকেই তার সঙ্গে সখ্য। স্নেহ করেন, অনেক অজানা তথ্য দেন। বঙ্গবন্ধুর সহকারী একান্ত সচিব অবিভক্ত ঢাকার জেলা প্রশাসক হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। যত দিন যায় তার সাথে সম্পর্কের গভীরতা বাড়ে। পদ্মা সেতু নিয়ে যে দাতা সংস্থা শুরু থেকেই বাংলাদেশের পেছনে লেগেছিল, তার আদ্যোপান্ত না হলেও অনেকখানিই আমায় জানিয়েছিলেন ডাকসাইটে সিএসপি সৈয়দ রেজাউল হায়াত।
২০০৯ সালের প্রথম দিকের কথা। আমি প্রথম আলো ছেড়ে উপসম্পাদক হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিদিন-এ থিতু হওয়ার জন্য রাত-দিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করছি। হঠাৎ কোনো এক সকালবেলা হায়াত ভাইয়ের ফোন এলো- ‘তাড়াতাড়ি হোটেল সোনারগাঁওয়ে চলে আসেন। হাতে সময় নিয়ে আসবেন, অনেক কথা আছে। কথা শেষে একসঙ্গে দুপুরে খাব।’
বাংলাদেশ প্রতিদিন-এর তৎকালীন ব্যবস্থাপনা সম্পাদক নঈম নিজামকে নিয়ে গেলাম হায়াত ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে। দেখা হলো, লম্বা কথা হলো। তিনি যা বললেন তার সারমর্ম হলো, ‘শত্রুতা শুরু হয়ে গেছে। যোগাযোগমন্ত্রী (সৈয়দ আবুল হোসেন) কতটা বুঝতে পারছেন, জানি না। কিন্তু বিষয়টি খুবই গুরুতর। আদ্যোপান্ত সরকারের শীর্ষ মহল জানা দরকার, কিছু একটা করেন।’
কৌতূহল আরও বাড়ল। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল। আলাপচারিতার একপর্যায়ে অফিসের কাজে ব্যবস্থাপনা সম্পাদক উঠে পড়লেন। বিপুল আগ্রহে কাগজ কলম নিয়ে আমি আবার হায়াত ভাইয়ের জানা সব তথ্যের নোট নিলাম। এরপর তার পরামর্শেই কথা বললাম সরকারসংশ্লিষ্ট কয়েকজনের সাথে। অফিসে ফিরে নানা ব্যস্ততার ফাঁকে লিখে ফেললাম, সময়মতো পদ্মা সেতু হচ্ছে না। কেন? সেসবও অনেকটা পরিষ্কার করা হলো লেখায়।
পরের দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনে লিড স্টোরি হিসেবে ছাপা হলো। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীসহ কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করে অসন্তুষ্টির কথা জানালেন। মন্ত্রী বললেন, তার পিছু লাগার মানে হয় না। সঠিক সময়েই পদ্মা সেতু হবে। চায়ের আমন্ত্রণ জানালেন মন্ত্রী। বললেন, সামনাসামনি বোঝাবেন কেন সঠিক সময়ে হবে পদ্মা সেতু। গেলাম। চা খেলাম, সঙ্গে স্ন্যাক্সও। কিন্তু মন্ত্রী বোঝাতে ব্যর্থ হলেন। বরং তাকে অনুরোধ করলাম যে ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে গেছে। পারলে এটা নিয়ে শক্ত হাতে কাজ করেন।
পদ্মা সেতু নিয়ে শত্রুতা হচ্ছে, এটা ঠিক মানতে চাইলেন না মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন। কিন্তু দুর্নীতির মিথ্যা অপবাদ নিয়ে তাকে বিদায় নিতে হলো মন্ত্রিসভা থেকে। দলের সব রকম পদ হারালেন। এমপিগিরিও আর করা হলো না। কারাগারে গেলেন তৎকালীন সেতুসচিব মোশাররফ হোসেন। আরও কত কী!
দাতা সংস্থা বিশেষ করে বিশ্বব্যাংক যে কাল্পনিক দুর্নীতির গল্প ফেঁদে পদ্মা সেতু নিয়ে শত্রুতা করেছে, এটি আমরা সবাই জানি। দেশপ্রেম আছে বাংলাদেশের এমন প্রতিটি নাগরিক বিশ্বব্যাংকের ওই দানবীয় নোংরা আচরণের নিন্দাও জানায়। গোটা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে আমরা আমাদের টাকায় পদ্মা সেতু বানালাম। এটি আসলেই আমাদের সক্ষমতা, সমৃদ্ধি আর এগিয়ে যাওয়ার প্রতীক। পদ্মা সেতু নির্মাণ করে প্রধানমন্ত্রী যে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ নেতৃত্ব দেখিয়েছেন তা আজীবন প্রশংসার দাবিদার।
পদ্মা সেতুর সঙ্গে শত্রুতা করা যায়? পদ্মা সেতুর বিরোধী হওয়া যায়? এ নিছক বোকামি আর খামখেয়ালিপনা ছাড়া আর কী! বিএনপির নেতৃত্ব পদ্মা সেতু নিয়ে নেতিবাচক কথা বলেই যাচ্ছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র ফিরিয়ে দিয়ে আসলে প্রমাণ করেছে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা কতটা দেউলিয়া।
রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলাগুলোর মেলবন্ধন করেছে পদ্মা সেতু। সব শ্রেণির মানুষ নতুন করে স্বপ্ন দেখছে। মোংলা বন্দর আরও গতি ফিরে পাবে। কর্মচাঞ্চল্য বাড়বে পায়রা বন্দরে। বেনাপোল আর ভোমরা স্থলবন্দরে ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি, সমাজ ও জনজীবনে পদ্মা সেতু এক নতুন ইতিবাচক মাত্রা সৃষ্টি করবে। অর্থনীতিবিদ থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ উদ্বেলিত। বিএনপিসহ ক্ষুদ্র কয়েকটি গোষ্ঠীর মন খারাপ। এটা কিসের লক্ষণ? পদ্মা সেতুর সঙ্গে কিসের শত্রুতা? দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রার সঙ্গে কিসের বিরোধিতা? সাধারণ মানুষের মনোভাব বুঝতে না পারার এই রাজনীতি কি কোনো ভালো ফল দেবে?
সৌদি আরবের দাম্মাম শহরের সঙ্গে সমুদ্রের ওপর দিয়ে দীর্ঘ ২৫ কলোমিটার সেতু যুক্ত করেছে বাহরাইনকে। বাদশা ফাহাদ নামের এই সেতুর ওপর দিয়ে গাড়ি চড়ে বাহরাইন যেতে যেতে এর অপার সৌন্দর্য দেখে বিস্মিত হয়েছি। কিন্তু সে তো সৌদি আরব আর বাহরাইনের গর্ব। গুগল আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা টেলিভিশনের কল্যাণে গোল্ডেন গেট ব্রিজ, ব্রুকলিন ব্রিজ, সিডনি হারবার ব্রিজ, আকাশি-কাইকো ব্রিজ, টাওয়ার ব্রিজ, হাংজু বে ব্রিজ দেখেছি। সৌন্দর্য, নির্মাণশৈলী চোখে লেগেছে ভীষণ। এশিয়া, ইউরোপ ভ্রমণে নজর কেড়েছে বড় বড় সেতু। কিন্তু সেসব তো তাদের গর্বের ধন। আমাদের কিছু না। আর পদ্মা সেতু একান্তই আমাদের নিজস্ব। বাংলাদেশের সেতু, জনগণের টাকায় তৈরি সেতু। পদ্মা সেতু কেবলই আমাদের নিজেদের অর্জন। পদ্মা সেতু আমাদের বেড়ে ওঠা, পরিণত হওয়ারও প্রতীক।
পদ্মা সেতুর দুই পাশের ল্যাম্পপোস্টের জ্বলে ওঠা বাতিতে কেবল সেতু আর চারপাশ আলোকিত হয় না, দ্যুতি ছড়ায় আমাদের হৃদয়েও। আমরা আবেগে আপ্লুত হই, শিহরিত হই। আমরাও যে পারি- এ কথাই তো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় পদ্মা সেতু। বাংলাদেশ যে আর বটমলেস বাস্কেট নয়, এর প্রমাণও তো সেই পদ্মা সেতু। এ গর্ব, আনন্দ তো সবার।
পদ্মা সেতুর সঙ্গে বিরোধিতা কিংবা শত্রুতা কি কেবল রাজনৈতিক? এই রাজনীতি কি আমরা চাই? না, চাই না। পদ্মা সেতু কোন প্রান্তে হবে এ নিয়ে কিন্তু শুরু থেকেই দ্বিধান্বিত ছিলেন বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা। ২০০১ সালে জামায়াত সমর্থিত বিএনপি সরকারের নীতিনির্ধারকেরা চেয়েছিলেন আজকের জাজিরা পয়েন্টে পদ্মা সেতু না হোক। সেতুর প্রাক-সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা চেয়েছিলেন আরিচা-দৌলতদিয়া প্রান্তে পদ্মা সেতু হোক। কিন্তু দাতা সংস্থা জাইকার আর্থিক ও কারিগরি প্রতিবেদন শতভাগ জাজিরা পয়েন্টের পক্ষে ছিল।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, বিএনপি হয়তো ভেবেছিল, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, বাগেরহাট অঞ্চলের মানুষ বেশি লাভবান হবেন মাওয়া-জাজিরা দিয়ে পদ্মা সেতু হলে। আর ঐতিহাসিকভাবে এ জেলার মানুষের অধিকাংশই আওয়ামী লীগের আদর্শে উজ্জীবিত, যার ফলাফল প্রতিটি নির্বাচনেই পাওয়া যায়। তবে ভালো রুট হিসেব জাইকার সমীক্ষাকে বিএনপির তৎকালীন সরকার অগ্রাহ্য করতে পারেনি। হয়তো সে কারণেই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ২০০৫ সালে কার্যত বাধ্য হয়েই বলেছিলেন, মাওয়া-জাজিরা প্রান্তেই পদ্মা সেতু হবে। কিন্তু বিএনপি হয়তো সেভাবে আন্তরিক ছিল না। তাই ২০০৬ সালে বেগম জিয়ার ক্ষমতাকালের শেষ দিকে জমির অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন এবং পরিবেশ ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা নেওয়া হলেও সব কাজ হয় টিমেতালে।
আর এখানেই এগিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দ্বিতীয় দফা ক্ষমতায় এসে তিনিই ২০০৯ সালে আমাদের স্বপ্নের পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করেন। কিন্তু দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে অন্য সব দাতা সংস্থাকেও প্রভাবিত করে ২০১২ সালে বিশ্বব্যাংক এই সেতুর ঋণ বাতিল করে। এই চ্যালেঞ্জে হঠেননি আমাদের স্বপ্নের ফেরিওয়ালা বঙ্গবন্ধু-কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করে ২০১৫ সালে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আড়ালে-আবডালে দেশি-বিদেশি অনেকেই নেতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন। বলেছেন, সম্ভব না। হবে না। পারবে না। কিন্তু সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে দেশের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। বাংলাদেশের সক্ষমতা, মেধা, আত্মবিশ্বাস এখন সারা বিশ্বে প্রমাণিত।
পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল এই সেতু রুখে দেওয়ার প্রয়াশ। দেশি-বিদেশি তদন্তে প্রমাণিত হেয়ছে, এটি নির্মাণে কোনো দুর্নীতি হয়নি। বিশ্বব্যাংক সরে যাওয়ার পর যারা বলেছিলেন, সরকার পারবে না, তাদের অন্তত এখন সরকারকে সাধুবাদ জানানো উচিত। সরকারের বিরোধিতা করতে গিয়ে পদ্মা সেতুর বিরোধিতা হবে নিতান্তই বোকামি, রাজনৈতিক খামখেয়ালিপনারই প্রকাশ। বরং সারা দেশের মানুষের মধ্যে যে আনন্দ, উৎসাহ আর উদ্দীপনা, তাতে শরিক হয়ে বিরোধীদের প্রমাণ করা উচিত, তারা প্রকৃত জাতীয়তাবাদী।
যোগাযোগে নতুন মাত্রা আনবে পদ্মা সেতু, এ কথা বলাই বাহুল্য। দেশের পিছিয়ে পড়া দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আরও সমৃদ্ধ হবে। সমৃদ্ধ হবে বাংলাদেশ আর আমাদের অর্থনীতি ও যোগাযোগ ব্যবস্থা। একই সঙ্গে সমৃদ্ধ হোক রাজনৈতিক সংস্কৃতিও। অকারণ বিরোধিতা থেকে বেরিয়ে এসে ভালো কাজের প্রশংসার সংস্কৃতি চালু হোক। পদ্মা সেতু দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও নতুন সংযোগের মাধ্যম হোক। উদ্বোধনী আনন্দে শরিক হোক বিরোধীরাও। পদ্মা সেতুর সঙ্গে কিসের শত্রুতা?
লেখক: সম্পাদক, দৈনিক ঢাকা টাইমস, ঢাকাটাইমস২৪.কম ও সাপ্তাহিক এই সময়।