পদ্মা সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি ফেরি ঘাটে সকাল থেকেই হাজার হাজার মানুষ সমাবেশে যোগ দিতে শুরু করেছেন। জনসভাস্থল ও এর আশপাশের এলাকা জুড়ে তৈরি হয়েছে উৎসবমুখর পরিবেশ।
পদ্মাসেতু উদ্বোধন উপলক্ষে মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী ফেরি ঘাটে এ জনসভার আয়োজন করা হয়েছে। সকাল সাড়ে ১১টায় আওয়ামী লীগ আয়োজিত এ বিশাল জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাষণ দেবেন।
ভোর থেকেই এ অঞ্চলের জেলাগুলো থেকে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীসহ হাজার হাজার মানুষ জনসভাস্থলে সমবেত হওয়া শুরু করেছে। সকাল ৭টার দিকে হাজার হাজার মানুষ সভাস্থলে ঢুকতে শুরু করে।
অধিকাংশ মানুষই বিভিন্ন জেলার দূরদূরান্ত থেকে বাস-ট্রাক মাইক্রোবাসসহ বিভিন্ন যানবাহন ভরে সমাবেশে আসছে। এছাড়া লঞ্চ নৌকা দিয়ে নদী পথে আসছে হাজার হাজার মানুষ। বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন জেলা থেকে শতাধিক লঞ্চ নিয়ে জনসভাস্থলে হাজার হাজার মানুষ আসার কথা রয়েছে।
বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে, ঢাকঢোল পিটিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশে কাঁঠালবাড়ি ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী ঘাট সংলগ্ন জনসভা মাঠে দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সাধারণ মানুষ।
এদিকে পদ্মাসেতুর উদ্বোধন করতে সকালে ঢাকা থেকে হেলিকপ্টার যোগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাওয়া আসেন। প্রথমে প্রধানমন্ত্রী মাওয়া প্রান্তে দুটি ফলক উন্মোচন করে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করবেন। এ ফলকের একটিতে থাকবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি এবং আরেকটিতে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি।
এরপর প্রধানমন্ত্রী সেখানে আয়োজিত সুধী সমাবেশে বক্তব্য রাখবেন। এ সুধী সমাবেশে রাজনৈতিক নেতারা, মন্ত্রী, এমপি, বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, দেশি বিদেশি সাংবাদিক ও বিশিষ্ট নাগরিকরা উপস্থিত থাকবেন। সুধী সমাবেশের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টোল দিয়ে পদ্মা সেতুর টোল প্লাজা উদ্বোধন করবেন। এরপর সেতুর ওপর দিয়ে সড়ক পথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শরীয়তপুরের জাজিরা পয়েন্টে পৌঁছাবেন এবং সেখান নাম ফলক উন্মোচন করবেন। দুই প্রান্তে পদ্মাসেতু উদ্বোধন অনুষ্ঠানের পর প্রধানমন্ত্রী মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী ফেরি ঘাটে সকাল সাড়ে ১১টায় আওয়ামী লীগ আয়োজিত বিশাল জনসভায় ভাষণ দেবেন।
এ জনসভায় ১০ লাখ লোকের সমাবেশ ঘটানো প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। বৃহত্তর ফরিদপুরসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এই জনসভায় অংশ নেবেন। শুধু তাই নয় সারাদেশ থেকেও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এই জনসভায় যোগ দেবেন।
এদিকে কাঁঠালবাড়ির জনসভাস্থল এর আশপাশের এলাকায় নেওয়া হয়েছে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পুরো এলাকা জুড়ে পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। সর্বত্রই আইন শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সদস্যরা সতর্ক অবস্থান রয়েছেন। জনসভার মাঠে বড় বড় বেলুন রশিতে বেঁধে উড়ানো হয়েছে। মঞ্চ থেকে বাজানো হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর এতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ। বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের নাম মুহুর মুহুর বিভিন্ন স্লোগান উচ্চারিত হচ্ছে চারিদিকে।
এক নজরে পদ্মা সেতুর স্বপ্ন থেকে বাস্তবায়ন
১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৮-৯৯ সালে প্রমত্তা পদ্মা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের প্রাক-সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয়। এরপর ২০০১ সালের ৪ জুলাই পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
২০০৩-২০০৫ সালে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয়। ২০০৪ সালে জাপানি উন্নয়ন সংস্থা জাইকা একটি সমীক্ষা চালিয়ে মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টে সেতু নির্মাণের পরামর্শ দেয়। এরপর ২০০৬ সালে পদ্মা সেতুর জন্য জমি অধিগ্রহণের প্রাথমিক প্রস্তুতি শুরু করা হয়।
২০০৭ সালে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সহায়তায় এ সেতু নির্মাণের আলোচনা শুরু করে। তখন একনেকে অনুমোদিত প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর পদ্মা সেতু নির্মাণে গতি পায়। দায়িত্বগ্রহণের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন আঙ্গিকে পদ্মা সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। পদ্মা সেতুকে শুধু সড়কে সীমাবদ্ধ না রেখে এতে রেল সংযুক্ত করেন। দুই তলা এ সেতুর ওপরে সড়ক এবং নিচ তলা দিয়ে রেল লাইন নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়।
২০০৯ সালে পদ্মা সেতুর জন্য ভূমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু হয়। ২০০৯ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে বিস্তারিত নকশা প্রণয়ন করা হয়। নকশা প্রণয়নের দায়িত্ব পায় নিউজিল্যান্ডভিত্তিক মাউনসেল লিমিটেড। ২০১০ সালের ১১ এপ্রিল মূল সেতুর দরপত্র আহ্বান করা হয়।
২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি রেলপথ যুক্ত করে একনেকে ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকায় পদ্মা বহুমুখী সেতু সংশোধিত নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়।
২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি হয়। একই বছরের ১৮ মে জাইকার সঙ্গে সরকারের ৪১ কোটি ৫০ লাখ ডলার এবং ৬ জুন এডিবির সাথে ৬১ কোটি ৫০ লাখ ডলারের ঋণচুক্তি করে সরকার।
২০১১ সালের ১০ অক্টোবর পদ্মা প্রকল্পে অর্থায়ন স্থগিত করেছে বিশ্ব ব্যাংক। দুর্নীতির অভিযোগ আনে সংস্থাটি।
২০১১ সালের ১৪ নভেম্বর সেতু বিভাগের সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে বদলি করে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়। একই বছরের ৫ ডিসেম্বর তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।
২০১২ সালের ২৯ জুন ঋণচুক্তি বাতিলের কথা জানায় বিশ্ব ব্যাংক। পরে অন্যান্য দাতা সংস্থাগুলোকে একই পথ ধরে। পদ্মা সেতুতে বিশ্ব ব্যাংক অর্থায়ন বন্ধে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দায়ী করে আসছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
২০১২ সালের ৪ জুলাই জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করার কথা বলেন। ৮ জুলাই নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ পরিকল্পনা সংসদে পেশ করেন তিনি।
২০১২ সালের ৯ জুলাই নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রিসভা। বৈঠকে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহের সিদ্ধান্ত হয়।
২০১২ সালের ২৩ জুলাই বিশ্ব ব্যাংকের দেওয়া শর্ত মেনে সৈয়দ আবুল হোসেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে পদত্যাগ করেন। ২৪ জুলাই আগেই সেতু সচিব থেকে সরিয়ে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান করে পাঠানো মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে ও এসডি করে ছুটিতে পাঠায় সরকার।
২০১২ সালের ২৫ জুলাই লন্ডনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্ব ব্যাংক আসুক আর না আসুক। আমরা পদ্মা সেতু করব। আমাদের নিজেদের প্রস্তুতি আছে।
২০১২ সালের ১৭ ডিসেম্বর সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে প্রধান আসামি করে সাত জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। ২৬ ডিসেম্বর রাজধানীর শাহবাগ এলাকা থেকে মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেয় দুদক। গ্রেপ্তার করা হয় আরও দু’জনকে। ২০১৩ সালের ১৬ জানুয়ারি মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে সাময়িক বরখাস্ত করে সরকার। ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি জামিনে মুক্ত হন তিনি।
২০১৩ সালের ৩১ জানুয়ারি পদ্মা সেতুতে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থ আর নেওয়া হবে না সরকার এমন সিদ্ধান্তের কথা জানায়।
২০১৪ সালের ১৭ জুন পদ্মা বহুমুখী সেতুটি নির্মাণে চায়না রেলওয়ে মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপের সঙ্গে চুক্তি করে সেতু বিভাগ।
২০১৪ সালে ১৭ সেপ্টেম্বর দুদক জানায় পদ্মা সেতুতে কোন দুর্নীতি হয়নি। ২৬ অক্টোবর পদ্মা সেতু দুর্নীতির মামলার অবসান হয়।
২০১৭ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি কানাডার গণমাধ্যম জানায়, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের যে অভিযোগ তুলে বিশ্ব ব্যাংক ঋণ বাতিল করেছিল তার প্রমাণ পায়নি কানাডার আদালত।
২০১৪ সালের ২৬ নভেম্বর মূল পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পদ্মা নেতুর পিয়ারে প্রথম স্প্যান বসানো হয়। এ প্রথম দৃশ্যমান হয় পদ্মা সেতু। এরপর একে ৪২টি পিয়ারে ৪১টি স্প্যান বসানো হয়। ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর শেষ স্প্যান বসানোর মাধ্যমে সংযুক্ত হয় মাওয়া-জাজিরা, দৃশ্যমান হয় ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটারের পদ্মা সেতু।
২০২১ সালের ১০ নভেম্বর পদ্মা সেতুতে পিচ ঢালাইয়ের কাজ শুরু হয়। ২০২২ সালের ৪ জুন প্রথম সেতুর ল্যাম্প পোস্টে আলো জ্বলে। ১৪ জুন মাওয়া থেকে জাজিরা পর্যন্ত ৪১৫ বাতি একযোগে জ্বালানো হয়। উদ্বোধনের জন্য প্রস্তুত করা হয় পদ্মা সেতু।