বিশাল পদ্মা নদী তার ধ্বংসযজ্ঞ, বয়ে চলা গতিপথ, হাজারো দুঃখ গাঁথা কিংবা সুখস্মৃতি সবকিছু আজ একটি সেতুকে এসে মিশেছে। আমাদের সবার অলক্ষ্যে সুবিশাল পদ্মা নদী সেতুর নামকরণে বদলে গেল। আগে যা শুধুমাত্র নদী হিসেবেই পরিচিত করতে নামটিকে, এখন থেকে সবার অলক্ষ্যে নামটি সেতুতে এসে মিশেছে।
কত লক্ষ কোটি তিক্ত আর কষ্টের অভিজ্ঞতার পাশাপাশি আমরা কি লক্ষ্য করেছি পদ্মা পারের ঘাটে প্রতিদিনকার মাইলের পর মাইল এ আটকে থাকা যানবাহনের সারি থেকে লঞ্চে কিংবা বিকল্প উপায়ে নদী পার হওয়ার জন্য মানুষের দীর্ঘ সারির কথা!! শরণার্থী বলতে আমরা বুঝি থেকে দেশ ছেড়ে বাস্তুচ্যুত মানুষের ঢল। এক দেশ থেকে আরেক দেশে প্রবেশ করা নির্যাতিত-নিপীড়িত সর্বহারা মানুষদের সারি।১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে আমরা লক্ষ লক্ষ মানুষ শরণার্থী হিসেবে পার্শ্ববর্তী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। সে শরণার্থী দলের স্রোতের কথা মনের মানসপটে ভেসে উঠলে আমরা দেখি জীর্ণ শীর্ণ মানুষ দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে হাতে বাক্স-পেটরা বাচ্চাদের কোলে কাঁধে মাইলের পর মাইল হেঁটে যাচ্ছে এমন মানুষদের। আমরা যারা মহান মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি সেই শরণার্থী মানুষের স্রোত দেখিনি, আমরা দেখেছি পদ্মার বুকে দীর্ঘ যানজটে আটকে থাকা অতিষ্ঠ মানুষ শরণার্থী স্রোতের মতোই অবুঝ বাচ্চাদের কোলে কাঁধে নিয়ে, বাক্স পেট্রা মাথায় নিয়ে নদীর পানে নিরন্তর ছুটে চলা সকালে বিকাল সন্ধ্যারাতে।
আমি পদ্মা পাড়ের মানুষ নই। কিন্তু চাকরির সুবাদে প্রতিনিয়ত পদ্মাপারের মানুষদের নদী পারাপারের অনেক দুঃখ কষ্টের স্মৃতির বাস্তব সাক্ষী। ঘাটে বসে কিংবা কাছাকাছি এসে স্রোতের মতো মানুষদেরকে পায়ে হেঁটে কয়েক মাইল রাস্তা প্রতিনিয়তই পার হতে দেখেছি। বিশেষ করে বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠান উপলক্ষে কয়েকদিন পর্যন্ত যানবাহনকে, মানুষদেরকে ঘাটে অপেক্ষা করতে হয়েছে। বিকল্প পথে পার হতে বহুদূর থেকে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বাচ্চাদের হাত ধরে কিংবা বয়স্কদের কাঁধে করে পার হওয়ার অভিজ্ঞতা যার না হয়েছে সে কি করে বুঝবে পদ্মা সেতুর গুরুত্ব!
স্বপ্নের পদ্মা সেতু কে ঘিরে কত লেখা কবিতা গল্প ইতোমধ্যেই বইয়ের পাতায় টিভির পর্দায় মানুষের মনে স্থান করে নিয়েছে। ইতোমধ্যেই যুক্ত হয়েছে পদ্মা সেতুর কথা।
মাঝেমধ্যে মনে হতো আমাদের এই প্রজন্ম যারা ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, শরণার্থী হয়নি, এমনকি শরণার্থীর ঢল দেখেনি, তারা হয়তো পদ্মা পার হতে গিয়ে সেই কষ্টের, দুঃখের, সেই লাঞ্ছনা-যন্ত্রণার কিছুটা উপলব্ধি করেছে। অপেক্ষা আর অনিশ্চয়তা জীবনকে কতটা বিষাদময় করতে পারে (!) পদ্মা পার হওয়া মানুষদের হয়তো সেরকমটাই স্মৃতি রয়ে যাবে।
পদ্মায় যাদের সলিল সমাধি হয়েছে তাদের স্বজনরা হয়তো আক্ষেপ করবে এ সেতুকে নিয়ে।
পদ্মা বিতর্ক::
স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে দেশি-বিদেশি কুশীলবদের ষড়যন্ত্র পুরোটাই দৃশ্যমান। মহান মুক্তিযুদ্ধে যেমন আমাদের বিরোধিতাকারী রয়েছে, তেমনি আমাদের বড় অর্জন বা ভালো অর্জনেও বিরোধী শক্তি রয়েছে। এটি প্রমাণিত বিষয়। পৃথিবীর সকল নায়কোচিত ঘটনার সাথে ষড়যন্ত্রকারী কুচক্রী বিদ্রোহীদের উপস্থিতি লক্ষণীয়। তেমনি কুচক্রী মহল পদ্মা সেতুকেও ঘিরে রয়েছে। এতে হতাশ হওয়ার, ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই, কারণ যুগে যুগে কোন কুচক্রীদের বিজয়ের ইতিহাস নেই।
যুগ যুগ ধরে বীরের প্রশংসা যেমন হয়ে থাকে এই সমস্ত ষড়যন্ত্রকারীদের প্রতি মানুষের ঘৃণা, বিদ্বেষ, নিন্দা যুগে যুগে কালে কালে ঘুরে বেড়াবে।
আজ বিজয়ের হাসির দিন। আজ নয় কোন দুঃখ গাঁথা, নয় কোন হতাশা, আজ শুধুই আনন্দ, উল্লাস, শুধুই এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়।
রাষ্ট্রের যা কিছু বড় অর্জন তার সবই মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়ার মানুষদের হাত ধরেই অর্জিত হয়েছে এ নিয়ে কারও কোনো চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ নেই।
সকল মেগাস্ট্রাকচার, মাথাপিছু আয়, প্রবৃদ্ধি, উন্নত রাস্তাঘাট সমূহ, মানব সম্পদ উন্নয়ন, বৈদেশিক কর্মসংস্থান, মানুষের গড় আয়, আয়ূ, জলে-স্থলে আকাশ পথে সবখানেই দৃশ্যমান পরিবর্তন।
বস্তুগত অর্জন যেমন দৃশ্যমান সারাদেশে, মহান মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত অর্জন হৃদয়ে, চেতনায়।
ধন্যবাদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা:
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অদম্য সাহস নির্ভীক মানসিকতা আমাদের এনে দিয়েছিল একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। একক নেতৃত্বে একটি জাতিকে স্বাধীনতা মুখি করে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করা হয়তো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে সম্ভব হয়েছে। তারই সুযোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে বাঙালি জাতির সুখ-সমৃদ্ধি মাথা উঁচু করে, গৌরব অর্জন করার সৌভাগ্য আপনার হাত ধরেই আমরা অর্জন করব। তারই অন্যতম স্বপ্নের পদ্মা সেতু। জয়তু শেখ হাসিনা, জয়তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। আমাদের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা, আন্তরিক অভিবাদন ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি। মহান আল্লাহ পাক আপনাকে দেশের কল্যাণে আরো ভালো কাজ করার সুযোগ দান করুক প্রার্থনা করি।।
(লেখাটি সাতক্ষীরার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমানের ফেসবুক থেকে নেওয়া)