কিংবদন্তি সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী জাদুর কলম নিয়ে জন্মেছিলেন। তিনি অত্যন্ত মেধাবী, প্রথিতযশা সাংবাদিক ও লেখক ছিলেন। সমাজ, দেশ, রাষ্ট্র, বাঙালির কৃষ্টি-সংস্কৃতি- এমন কোন ক্ষেত্র নেই, যেখানে তাঁর পদচারণা ছিল না। ভাষা আন্দোলনের কালজয়ী গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ লিখে বাঙালির হৃদয়ে তিনি অমর হয়ে আছেন। যতদিন বাঙালি, বাংলা ভাষা এবং বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন আবদুল গাফফার চৌধুরী আমাদের প্রাণের সখা হয়ে থাকবেন।
আজ বৃহস্পতিবার (৯জুন) বিকাল সাড়ে ৪টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) অডিটোরিয়ামে কিংবদন্তি সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরীর স্মরণসভায় সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।
স্মরণসভায় আয়োজন করে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন গৌরব ’৭১। আয়োজনে সহযোগিতায় ছিল জাগরণ টিভি, বিবার্তা২৪.নেট ও নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত মাসিক অন্যদেশ।
স্মরণসভায় প্রধান আলোচক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার বিচার হবে আমরা কল্পনাও করতে পারেনি। তারপরেও এটা হয়েছে। আর যারা এই বিচার দাবি করেছেন তাদের মধ্যে পথিকৃৎ হলেন সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও রক্ষার কথা বলেছেন। একইসাথে বাঙালি সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর জোরালো ভূমিকা ছিল।
অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ বলেন, ১৯৯২ সালে এক আলোচনায় বিশিষ্ট সাংবাদিক গাজীউল হক বলেছেন, আমরা বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করতে পারিনি। কিন্তু আমাদের শেখ হাসিনাকে রক্ষা করতে হবে। পরবর্তীতে আবদুল গাফফার চৌধুরীও বিভিন্ন সময় একই কথা বলেছেন।
তিনি আরো বলেন, গাফফার ভাই আমাদের বিভিন্নভাবে উদ্বুদ্ধ করেছেন, সাহস যুগিয়েছেন। আজকে তাঁর জীবনী মোবাইলে টোকা দিলে বের হয়ে আসে। তাঁর জীবনী থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে।
বিশিষ্ট এই কবি ও শিক্ষাবিদ বলেন, যেই জ্ঞান আত্মশক্তি জোগায় না, সেই জ্ঞান বৃথা। কিন্তু তারপরেও আজকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, আজকে জ্ঞান নাই, বিদ্যা নাই কিন্তু ধূর্ত হচ্ছে সবাই। এখান থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
গাফফার চৌধুরীকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ১৯৫০ সাল সাংবাদিকতা করে ধাপে ধাপে তিনি এ পর্যন্ত এসেছেন। নিজেকে অমর করে রাখা মোটেও সহজ কাজ নয়। কিন্তু তিনি সেই কাজটাই করতে পেরেছেন। আজকে শুধু বাংলাদেশে নয়, সিয়েরালিওনের লোকেরা তাঁর গান আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফ্রেবুয়ারি নিজেদের ভাষায় ও বাংলা ভাষায় গাইছে।
নাট্যকার ও অভিনেতা মামুনুর রশীদ বলেন, কিংবদন্তি সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী জাদুর কলম নিয়ে জন্মেছিলেন। তাঁর লেখার এমন টান যে শুরু করলে শেষ না করা পর্যন্ত নিস্তার নাই। প্রবল স্মৃতিশক্তিই তাঁর অসাধারণ সম্পদ।
স্মৃতিচারণ করে মামুনুর রশীদ বলেন, আবদুল গাফফার চৌধুরী ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে গত হওয়ার আগ পর্যন্ত লেখনি দিয়ে বিশাল ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। তাঁর লেখনী রক্তক্ষয়ী বাংলাদেশকে ধারণ করে আছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ এবং বাংলা ভাষা যতদিন থাকবে ততদিন আবদুল গাফফার চৌধুরী আমাদের মাঝে অমর হয়ে থাকবেন।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, আবদুল গাফফার চৌধুরী অত্যন্ত স্পষ্টবাদী মানুষ ছিলেন। তিনি কখনো নিরপেক্ষ ছিলেন না। তিনি মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন। তাঁর এই গ্রহণযোগ্যতার কারণ ছিলো স্পষ্টবাদীতা। তাঁর সমালোচনা ছিলো বন্ধুর উপদেশের মতো।
গোলাম কুদ্দুছ বলেন, তিনি প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু, বাঙালির বন্ধু, বাঙালি সংস্কৃতির বন্ধু এবং বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সরকারের বন্ধু ছিলেন।
স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, আবদুল গাফফার চৌধুরী বাঙালিত্বকে মগজে-মননে কৈশোর থেকেই ধারণ করেছেন এবং মৃত্যু পর্যন্ত বিচ্যুত হননি। বাংলাদেশ, বাঙালি, বাঙালির সংস্কৃতি তাকে প্রতিটি মুহূর্তে জাগ্রত রাখত। আবদুল গাফফার চৌধুরীকে হারিয়ে আমরা আমাদের শেষ বাতিঘর হারিয়ে ফেললাম। তাঁর মতো একজন কবে তৈরি হবে জানি না।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি বলেন, আবদুল গাফফার চৌধুরী কলাম, বক্তব্য, গান দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি শারীরিকভাবে লন্ডন থাকলেও অন্তরে বাঙালিত্বকে অনুভব করতেন এবং তিনি আমাদের চেয়ে সঠিকভাবে অনুভব করতেন। তার লেখাগুলো ছিলো অনুকরণীয়, অনুসরণীয়। কারণ তিনি বাঙালির অন্তরের ভাবনা জানতেন।
তিনি বলেন, বাঙালি, বাঙালি সংস্কৃতি, একুশে ফেব্রুয়ারির মধ্য দিয়ে আপনি বেঁচে থাকবেন। আমাদের চেতনা থেকে কখনো হারিয়ে যাবেন না। তাকে ভুলিয়ে দেয়া কারো পক্ষে সম্ভব নয়।
বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট স্বদেশ রায় বলেন, লেখক ও সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী সম্পর্কে সবাইকে জানতে হবে। কারণ তিনি বাঙালির দীর্ঘ পথপরিক্রমায় অন্যতম ব্যক্তি।
স্বদেশ রায় বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা যখন শরণার্থী শিবিরে, তখন তিনি আমাদের মানসিক শক্তি জোগাতেন। আর তাঁর বক্তব্য শুনে আমাদের মনের ভিতর একটা অন্যরকম প্রত্যয় আসত।
তিনি আরো বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর আমরা লন্ডনে বসে এক সাহসী গাফফার চৌধুরীকে দেখতে পেলাম। তিনি লন্ডন থেকে একটা পত্রিকা বের করতেন। আর ওই পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিষয়ে কথা বলতেন।
আবদুল গাফফার চৌধুরীর স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, গাফফার ভাই ছিলেন দেশপ্রেমিক যোদ্ধা। দেশের ও সমাজের দুর্দিনের উপলব্ধির দূর থেকেও করতে পারতেন। আজকের তরুণদের তাঁর জীবনী থেকে শিক্ষা নিতে হবে। তাহলে তাঁরা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে পারবে।
গৌরব ‘৭১ এর সভাপতি মনিরুল ইসলাম মনির সভাপতিত্বে এবং জাগরণ টিভির প্রধান সম্পাদক ও গৌরব ‘৭১ এর সাধারণ সম্পাদক এফ এম শাহীনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন বিবার্তা২৪.নেট-এর সম্পাদক বাণী ইয়াসমিন হাসি, বাংলা জার্নালের প্রকাশক ও বিবার্তা২৪ডটনেটের বার্তা সম্পাদক হাবিবুর রহমান রোমেল, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিশেষ সহকারী গুলশাহানা ঊর্মি, গৌরব ’৭১ এর সাংগঠনিক সম্পাদক রবিউল ইসলাম রুপম, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বরিকুল ইসলাম বাঁধন প্রমুখ।
উল্লেখ্য, ভাষা আন্দোলনের কালজয়ী গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’র রচয়িতা বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সাহিত্যিক আবদুল গাফফার চৌধুরী ১৯ মে যুক্তরাজ্যের স্থানীয় সময় সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে উত্তর লন্ডনের বার্নেট হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ১৯৩৪ সালের ১২ ডিসেম্বর বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ থানার উলানিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন নিয়ে তাঁর লেখা ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানটি তাকে খ্যাতি এনে দেয়।