সুনামগঞ্জের দুর্গম হাওর এলাকা শাল্লা উপজেলার বাসিন্দাদের জরুরি স্বাস্থ্যসেবা দিতে চার বছর আগে প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে একটি নৌ অ্যাম্বুলেন্স দেওয়া হয়েছিল। রোগী বহনের প্রথম দিনেই হাওরের মধ্যে গেলে অ্যাম্বুলেন্সটিতে ত্রুটি দেখা দেয়। এরপর থেকেই সেটি হাওরপাড়ে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল। সম্প্রতি বন্যায় অ্যাম্বুলেন্সটি হাওরের পানিতে ডুবে গেছে।
শাল্লার মতো জামালগঞ্জ উপজেলায় দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর আরেকটি উপহারের নৌ অ্যাম্বুলেন্স একইভাবে পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। শাল্লার অ্যাম্বুলেন্সে এক দিন রোগী উঠলেও জামালগঞ্জের অ্যাম্বুলেন্সটিতে কোনো রোগীই উঠতে পারেনি। উদ্বোধনী যাত্রায় অতিথিদের নিয়ে সেটি নদীতে আটকে যায়। এরপর থেকে অ্যাম্বুলেন্সটি সুরমা নদীর ঘাটে বাঁধা আছে। রোদ-বৃষ্টিতে অ্যাম্বুলেন্সটির যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে গেছে। ২০১৮ সালে হাওরপাড়ের বাসিন্দাদের সেবা দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে উপহারস্বরূপ অ্যাম্বুলেন্স দুটি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তা মানুষের কোনো উপকারে আসেনি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের 'কমিউনিটি বেজড হেলথ কেয়ার প্রকল্পের আওতায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে কেনা এই অ্যাম্বুলেন্সগুলোর একেকটির দাম ২৯ লাখ ৮০ হাজার টাকা।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও জেলার স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সুনামগঞ্জের দুর্গম হাওর উপজেলা শাল্লা। জেলা সদরের সঙ্গে এখনো শাল্লার সরাসরি সড়ক যোগাযোগ হয়নি। বর্ষাকালে নৌকাই মানুষের চলাচলের একমাত্র ভরসা। বর্ষায় জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজনে জেলা সদরে আসতে হলে তাদের প্রথমে নৌকায় করে দিরাই উপজেলায় আসতে হয়। এরপর সেখান থেকে অন্য বাহনে জেলা সদর কিংবা সিলেটে যান। শাল্লার হাওর এলাকায় বর্ষাকালে প্রসূতিদের নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়তে হয়। জরুরি প্রয়োজনে তাদের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে আসার জন্য অ্যাম্বুলেন্সটি ব্যবহার করা হতো। কিন্তু কেন অ্যাম্বুলেন্সটি অযত্ন-অবহেলায় এত দিন পড়েছিল, অবশ্যই তা তদন্ত করতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্ষায় উপজেলা সদর কিংবা জেলা সদরে জরুরি স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজনে যাতায়াত সুবিধার্থে ২০১৮ সালের ২ মে শাল্লায় একটি নৌ অ্যাম্বুলেন্স দেওয়া হয়। প্রথম দিন রোগী নিয়ে দিরাই যাওয়ার পথে সেটিতে ত্রুটি দেখা দেয়। বিপাকে পড়েন রোগীর স্বজনেরা। পরে অন্য একটি নৌকায় করে তাঁরা গন্তব্যে যান। এরপর অচল অ্যাম্বুলেন্সটি কোনোরকমে টেনে এনে উপজেলা সদরের ঘুঙ্গিয়ারগাঁও এলাকায় রাখা হয়। এরপর আর সচল হয়নি অ্যাম্বুলেন্সটি। দীর্ঘদিন পড়ে থেকে যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যায়। গত সপ্তাহে বন্যার পানি বাড়ায় সেটি ওই স্থানেই পানিতে তলিয়ে যায়। এরপর উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে চেষ্টা করেও সেটিকে তোলা যায়নি।
শাল্লা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবু তালেব জানান, স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে বিষয়টি তাকে জানানোর পর তিনি ১০ জন শ্রমিক দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সটি পানি থেকে তোলার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তারা উদ্ধার করতে পারেননি। তিনি বলেন, এতদিন অ্যাম্বুলেন্সটি নিয়ে কেউ কোনো কথা বলেনি। আমরা পানি থেকে অ্যাম্বুলেন্সটি উদ্ধারের চেষ্টা করছি।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, অ্যাম্বুলেন্সটি শাল্লার মানুষের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় ছিল। কিন্তু শুরু থেকেই অকেজো হয়ে পড়ে থাকায় তা মানুষের কোনো উপকারে আসেনি। উপজেলাবাসী কেন এটির উপকার পেলেন না, সেটি খতিয়ে দেখা উচিত। তবে স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, শুরুতে অ্যাম্বুলেন্সটির কোনো চালক ছিলেন না। গতিও ধীর, জ্বালানিও বেশি লাগে। এছাড়া ত্রুটি সারাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেও সাড়া মেলেনি। তাই এ অবস্থা হয়েছে।
শাল্লা উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান দীপু রঞ্জন দাস বলেন, শাল্লার হাওর এলাকায় বর্ষাকালে প্রসূতিদের নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়তে হয়। জরুরি প্রয়োজনে তাদের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে আসার জন্য অ্যাম্বুলেন্সটি ব্যবহার করা হতো। কিন্তু কেন অ্যাম্বুলেন্সটি অযত্ন-অবহেলায় এত দিন পড়েছিল, অবশ্যই তা তদন্ত করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর উপহারের অ্যাম্বুলেন্সের এ অবস্থার জন্য তারা লজ্জিত। বারবার কর্তৃপক্ষকে বলেও কোনো লাভ হয়নি। এখানে স্বাস্থ্য বিভাগের স্পষ্ট অবহেলা আছে।
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আল আমিন চৌধুরী বলেন, অ্যাম্বুলেন্সটি উল্টে পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ওজন বেশি হয়ে গেছে। আমরা কিছু লোক নিয়োগ করেছি। দুই দিনের মধ্যে তারা সেটি পানি থেকে তুলে দেবেন। শুধু শাল্লা নয়, জামালগঞ্জ উপজেলার নৌ অ্যাম্বুলেন্সটিও মানুষের কোনো কাজে আসেনি বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এ বিষয়ে জামালগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মহিউদ্দিন আলমগীর বলেন, অ্যাম্বুলেন্সটি শুরু থেকেই নষ্ট হয়ে আছে। একাধিকবার সংস্কারের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সংস্কার করা হলে অ্যাম্বুলেন্সটি চালানো যাবে।
জেলার সিভিল সার্জন মো আহম্মদ হোসেন বলেন, শুরু থেকেই শাল্লা ও জামালগঞ্জের নৌ অ্যাম্বুলেন্স দুটি অকেজো ছিল। কীভাবে শাল্লার অ্যাম্বুলেন্সটি তোলা যায়, বিষয়টি নিয়ে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও অন্যদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন।
অ্যাম্বুলেন্সগুলোর এ অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি স্থানীয় লোকজনের বরাত দিয়ে বলেন, অ্যাম্বুলেন্সগুলো হাওর এলাকায় চলাচলের উপযোগী নয়। হাওরের বিভিন্ন এলাকায় বাঁধ থাকায় বড় আকারের এই অ্যাম্বুলেন্স সব জায়গায় যাতায়াত করতে পারে না।