#ভাগ্য বদলাবে তিন কোটি মানুষের। #সুফল ভোগ করবে সারা দেশ। #দূরত্ব কমবে ১০০ কি.মি.। #আঞ্চলিক বাণিজ্য সমৃদ্ধ হবে। #বাড়বে উন্নত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা।
বাঙালি জাতির বহুদিনের স্বপ্ন পূরণ হতে আর মাত্র দিন কয়েক বাকি। বিশেষ করে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের প্রতীক্ষার পালা শেষ পর্যায়ে। পদ্মা বহুমুখী সেতু উদ্বোধনের তারিখ ঘোষণা করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই সেতু চালু হলে শিল্পায়ন ও বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধির পাবে। যার মাধ্যমে সরাসরি সুবিধার কারণে পরিবর্তন আসবে দেশের তিন কোটিরও বেশি মানুষের জীবনে।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, দক্ষিণ জনপদের মানুষের স্বপ্নের এ সেতুর কাজ ৯৮ শতাংশ শেষ হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী সময় দিলেই তারিখ ঘোষণা করে আগামী মাসের (জুন) শেষভাগে এটি উদ্বোধন হবে। কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে তিনি জানান, মূল সেতুর প্রায় ৯৮ শতাংশ শেষ হয়েছে। সার্বিক কাজের অগ্রগতি ৯৩ দশমিক ৫০ শতাংশ। নদী শাসনের কাজ ৯২ শতাংশ ও সেতুর কার্পেটিংয়ের ৯১ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, দেশের মোট জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ বা তিন কোটিরও বেশি মানুষ সরাসরি এই সেতুর মাধ্যমে উপকৃত হবে। এতে বলা হয়, এই সেতুর মাধ্যমে আঞ্চলিক বাণিজ্য সমৃদ্ধ হবে, পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচন হবে এবং উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির গতি ত্বরান্বিত হবে। দেশের ওই অঞ্চল থেকে রাজধানী ঢাকার দূরত্ব গড়ে ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত কমবে। অপর এক সমীক্ষায় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) নির্মাণের ফলে দেশের আঞ্চলিক ও জাতীয় অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে লক্ষণীয় অগ্রগতি হবে। এই সেতু চালু হলে মানুষ ও পণ্য পরিবহনের সময় ও অর্থ সাশ্রয় হবে, যানবাহন রক্ষণাবেক্ষণ, জ্বালানি ও আমদানি ব্যয় হ্রাস পাবে।
এডিবির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এই সেতুর মাধ্যমে শিল্পায়ন ও বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড প্রসারের লক্ষ্যে পুঁজির প্রবাহ বাড়বে, পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের জন্য অর্থনৈতিক ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এছাড়া স্থানীয় জনগণ উন্নততর স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য খুব সহজেই রাজধানী ঢাকায় আসতে পারবে।
এডিবির মতে, এই সেতুর ফলে দেশের জিডিপি ১ দশমিক ২ শতাংশ এবং আঞ্চলিক জিডিপি ৩ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।
ভারতের ‘ইকোনমিক টাইমস’-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, এই সেতুটি (পদ্মা সেতু) বাংলাদেশের জন্য গৌরবের এবং অর্থনীতির জন্য যুগান্তকারী ঘটনা। নিউইয়র্কভিত্তিক আমেরিকান সোসাইটি অব মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার্স (এএসএমই)-এর মতে, এই সেতু রাজধানী ঢাকা ও তুলনামূলকভাবে উন্নত অন্যান্য এলাকার সাথে সংযুক্ত করার মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের রূপান্তর ঘটাবে। এতে আরো বলা হয়, ঢাকা-কলকাতা (ভারত) সংযোগ সড়কে অবস্থিত এই সেতুটি এশিয়ান হাইওয়ে এবং ইউরো-এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্ক সিস্টেমের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হবে।
এ বিষয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও শরীয়তপুরের সাবেক এমপি বিএম মোজাম্মেল বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলায় ‘শিল্প বিপ্লব’ ঘটবে। তিনি বলেন, ‘২০৫ একর জমি নিয়ে এই অঞ্চলে বিশেষ অর্থনৈতিক জোন হচ্ছে। এই অঞ্চলে ইপিজেড আবারও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। সবই হচ্ছে পদ্মা সেতুকে সামনে রেখে। খান জাহান আলী বিমানবন্দর এখন পূর্ণাঙ্গ বিমানবন্দর হতে যাচ্ছে। রেলের কাজও চলছে পুরোদমে। এর সঙ্গে চাহিদামতো গ্যাস সরবরাহ এবং পদ্মা সেতুতে যান চলাচল শুরু হলে দক্ষিণাঞ্চল হবে দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনৈতিক অঞ্চল।’
খুলনা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের প্রতিবেদন অনুযায়ী, পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা দ্রুততম হবে। এতে সময় ও যাতায়াত খরচ কমবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এ অঞ্চল থেকে দেশের দূর-দূরান্তে পণ্য পরিবহনে ব্যবসায়ীরাও দারুণভাবে উপকৃত হবেন। এতে আরো বলা হয়, ‘পদ্মা সেতু নির্মাণের সঙ্গে জ্বালানির চাহিদা নিশ্চিত হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যুগান্তকারী উন্নয়ন হবে। এ অঞ্চলের বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের গতি আসবে, আয় বৈষম্যও কমে যাবে।’ প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর মংলার গতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা অল্প সময়ের মধ্যে পণ্য পরিবহন করে মংলা বন্দরের মাধ্যমে রফতানি ও আমদানি করতে উৎসাহিত হবেন।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, পদ্মা সেতু নির্মাণের পর পায়রা বন্দরের গুরুত্বও বাড়বে। প্রয়োজনীয় আধুনিকায়ন করা হলে পদ্মা সেতুর মাধ্যমে এই বন্দরও এক বৃহত্তম বন্দরে রূপান্তরিত হবে। এমনকি ভুটান, পূর্ব নেপাল ও ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোর জন্য পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর হিসাবে ভূমিকা রাখতে পারবে। খুলনা চেম্বারের তথ্য অনুযায়ী, দেশের অন্যতম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হিমায়িত মৎস্য ও পাট শিল্প যার অধিকাংশ খুলনা থেকে রফতানির মাধ্যমে আয় হয়ে থাকে। পদ্মা সেতু হলে এই আয় আরো বাড়বে। পাশাপাশি কমে যাবে পণ্য পরিবহনের খরচও। একইভাবে পদ্মা সেতুতে রেল যোগাযোগের ব্যবস্থা থাকায় দেশের অভ্যন্তরীণ পণ্য পরিবহন, সাধারণ মানুষের যাতায়াতসহ পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গেও রেল যোগাযোগের মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যের এক নতুন সম্ভাবনার দিক উন্মোচিত হবে। অবশ্য দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শিল্পায়নের সুফল পেতে এখনই গ্যাস-বিদ্যুৎ ও অবকাঠামোর ওপর জোর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা মনে করেন, পদ্মা সেতু কেবল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নয়, পুরো বাংলাদেশের অর্থনীতির চেহারা বদলে দেবে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) মতে, ‘গ্যাস-বিদ্যুৎ ও অবকাঠামোর চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হলে দেশে পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। ভবিষ্যতে এই সেতু দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ, বাণিজ্য, পর্যটনসহ অনেক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিবেশী অন্যান্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে পারবে।’ ‘পদ্মা সেতুর সড়ক ও রেলপথ এই দুয়ের মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া অঞ্চলকে কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ, রফতানি বাড়াতে সহায়তা করবে। পাশাপাশি দেশের ভেতরে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আরো বাড়বে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, ‘স্বপ্নের এই সেতুকে মাথায় রেখে মানুষ নানা ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করে দিয়েছে। সামনে আরো নদীবন্দর, সমুদ্রবন্দর চালু হতে যাচ্ছে। মোংলা বন্দরেরও প্রসার ঘটছে, ইকোনমিক জোন হচ্ছে। এ কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শিল্পায়নের সুফল পেতে এখনই গ্যাস-বিদ্যুৎ ও অবকাঠামোর ওপর জোর দিতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মোংলা বন্দরের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ বাড়বে। ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থার একটা আমূল পরিবর্তন হবে। বেনাপোল, এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য বাড়বে।’
ড. আতিউর আরো বলেন, ‘পদ্মা সেতু হচ্ছে, এর সঙ্গে সঙ্গে গ্যাস আর বিদ্যুতের চাহিদা মেটানো গেলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল হবে শিল্পের নগরী। কয়েকটি সিমেন্ট ফ্যাক্টরি এই অঞ্চলে ইতিমধ্যেই গড়ে উঠেছে। নতুন করে জুটমিল গড়ে উঠছে। ইতোমধ্যে অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘোষণা হয়েছে, ইপিজেড করা হয়েছে। পায়রা বন্দরে গভীর সমুদ্র বন্দর গড়ে তোলা হচ্ছে।’